আমিনুল ইসলাম মল্লিক
১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:৪১ পিএম
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে পনের বছরে রাজনৈতিকভাবে লক্ষাধিক মামলা করা হয়েছে বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান থেকে শুরু করে তাদের দলের তৃণমূলের অনেক কর্মীর বিরুদ্ধেও শত শত মামলা হয়েছে। বছরের পর বছর জেল খাটার পাশাপাশি সামাজিকভাবে নাজেহাল হয়েছেন তারা। সরকার পরিবর্তন হলেও মামলার ঘানি থেকে এখনও পরিত্রাণ মেলেনি কারও। সাজাপ্রাপ্ত অনেক নেতাকর্মী বিদেশ থেকে দেশে আসতে পারছেন না। কারণ তাদের সাজা স্থগিত বা বাতিল করা হয়নি। দলের হাই কমান্ড থেকে তালিকা চাওয়া হয়েছে মামলার। সেগুলো নিয়ে দিনরাত পরিশ্রম করছেন ভুক্তভোগীরা। কোন আদালতে কতগুলো মামলা, কোন মামলার কি অবস্থা, হাইকোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ আছে কী না, মামলাগুলো যে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক ছিল তা প্রমাণে প্রয়োজনীয় নথি সংগ্রহ করতে ঘাম ছুটে যাচ্ছে সংশ্লিষ্টদের।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানির বিরুদ্ধে ঢাকাসহ সারাদশের বিভিন্ন আদালতে শ’খানেক মামলা করা হয়েছে। ঢাকার সিএমএম আদালতে ৩৫টি, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ২টি, মহানগর দায়রা আদালতে ২৪টি, ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলার আদালতে করা হয়েছে ৮টি মামলা। এই নেতার বিরুদ্ধে করা মামলাগুলোর একটিরও রায় ঘোষণা করা হয়নি। সবগুলোই বিচারাধীন। আবার কিছু মামলা উচ্চ আদালতের নির্দেশে রয়েছে স্থগিত। সবগুলো মামলা প্রতাহার করতে তালিকা চেয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কোর্ট থেকে কোর্ট ও আইনজীবীদের চেম্বারে গিয়ে মামলার তালিকা করছেন শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানির পরিবারের সদস্য মনজু চৌধুরী।
জানতে চাইলে তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকার পতনের পর আমার ভাই শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীর বিরুদ্ধে যত মামলা রয়েছে সেগুলোর তালিকা করার কাজ করছি। আদালত থেকে আদালত ও আইনজীবীর চেম্বারে ঘুরে এসব তালিকা করছি। এতদিন মামলাগুলোতে হাজিরা দিতে কষ্ট করেছি। এখন আবার এগুলো তালিকা করতে ঘাম ছুটছে। তারপরও খুশি যে হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে।
বিএনপির এই নেতার রাজনৈতিক মামলা নিয়ে যেসব আইনজীবী কাজ করেছেন তাদের অন্যতম ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী তানজিম চৌধুরী। তিনি বলেন, মাসখানেক সময় লেগেছে সব মামলার নথি খুঁজে বের করে তালিকা করতে। শহীদ উদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে ২০০৭ সাল থেকে মোট ৬৯টি মামলা করা হয়েছে। সবগুলো মামলার নথি সংগ্রহ করতে ও আপডেট নিতে আমরা টানা মাস সময় কাজ করেছি। তিনি বলেন, কোন আদালতে কতগুলো মামলা, কোন মামলার কি অবস্থা, হাইকোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ আছে কী না, মামলাগুলো যে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক ছিল তা প্রমাণে প্রয়োজনীয় নথি সংগ্রহ করতে অনেক শ্রম দিতে হয়েছে। এখানও দিচ্ছি।
কোন কোন নেতার মামলায় আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি তিনি বলেন, আমি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি এবং বিএনপি-জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের বেশ কয়েকজন নেতার মামলা পরিচালনায় অংশ নিয়েছি। এদের মধ্যে যারা সচ্ছল ছিলেন তারা কিছু ফি দিয়েছেন। যারা গরীব ও অসমর্থ ছিলেন তারা শুধু কাগজপত্র ঠিকঠাক করতে কিছু পয়সা দিয়েছেন। তা দিয়েই কাজ করেছি।
জানতে চাইলে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট গাজী কামরুল ইসলাম সজল ঢাকা মেইলকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১৩টি। এছাড়া রাজনৈতিকভাবে হয়রানির শিকার অনেকেই আমার কাছে এসেছেন। সরকার পতনের পর আমার ব্যক্তিগত ও মক্কেলের মামলার তালিকা প্রস্তুত করতে সময়ে দিতে হচ্ছে প্রচুর। আমি মনে করি, বর্তমান সরকার রাজনৈতিক মিথ্যা মামলাগুলো কলমের এক খোঁচায় তুলে নিতে পারে। কিন্তু নিচ্ছে না। যে প্রক্রিয়ায় মামলাগুলো প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া চলছে তা অত্যন্ত কঠিন ও জটিল পদ্ধতি। যার কারণে আমাদের মামলা প্রত্যাহারের জন্য অনেক সময় দিতে হচ্ছে।
মামলার জাঁতাকল থেকে রেহাই পাননি বিরোধীমতের আইনজীবীরাও। একজন বললেন, আমার বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা করা হয়েছে। অনেকগুলো মামলার রায় হয়েছে। রায়ে খালাস পেয়েছি। কিছু মামলায় অব্যাহতি পেয়েছি। কোনো কোনো মামলা চার্জ গঠন বা সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে আছে।
বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে নানাভাবে নাজেহালের শিকার হয়েছি। এখন মামলাগুলো তালিকা করতেও সময় দিতে হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন সিরাজগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান মাসুদ। তিনি বলেন, আমি ও আমার মক্কেলের বিরুদ্ধে যেসব মামলা দেওয়া হয়েছিল সেসব মামলা প্রত্যাহারের সময় এসেছে। আমরা মামলাগুলোর তালিকা করছি। মামলাগুলোর আপডেট তথ্য নিচ্ছি। কোর্টে কোর্টে ঘুরে মামলার আপডেট তথ্য সংগ্রহ করতে হচ্ছে। এসব করতে সময় অর্থ-শ্রম সবই যাচ্ছে।
সিরাজগঞ্জ জেলা জজ আদালতের আইনজীবী ও সদর থানা জামায়াতের সেক্রেটারী মোহাম্মাদ নাজিম উদ্দিন, নিজের বাড়িঘর ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, ব্যবসায় ক্ষতিসহ নানাবিধ সমস্যায় পার করেছি বিগত সাড়ে ১৫ বছর। বিরোধীমতের হওয়ার কারণে আমার বিরুদ্ধে প্রায় ৩২টি মামলা হয়েছে। মামলাগুলোতে কোনোটায় অব্যাহতি, কোনোটায় খালাস পেয়েছি। আবার কোনোটা এখনও চলমান আছে। আমি একজন আইনজীবী, রাজনৈতিক মামলার কারণে জেল-জুলুমসহ নানাবিধ ক্ষতির মধ্য দিয়ে দিন পার করেছি।
তিনি আরও বলেন, এসব মামলায় কত রাত বাড়ির বাইরে থেকেছি তার হিসাব করা কঠিন। পেশা পরিচালনা করতে পারিনি নির্বিঘ্নে। আমার পরিবারের অনেক সদস্যের বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে। সব খরচ আমি ম্যানেজ করেছি। সংগঠন কিছু কিছু খরচ দিয়েছে। আমার মতো অনেকের বিরুদ্ধেই মামলা হয়েছে, সংগঠনকে খরচ বহন করতে হয়েছে।
এক তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৭১টি মামলা রয়েছে। এসব মামলা আসামির সংখ্যা ৪০ লাখের ওপরে। বিএনপির মামলার তথ্য ও সংরক্ষণ শাখা এ হিসাব দিয়ে জানিয়েছে, ২০০৯ সাল থেকে গত ২৫ জুলাই পর্যন্ত এসব মামলা হয়েছে।
এআইএম