আমিনুল ইসলাম মল্লিক
২৯ আগস্ট ২০২৪, ০৯:৩১ পিএম
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের, ভারতে পাড়ি জমান শেখ হাসিনা। এরপর গ্রেফতার হন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সালমান এফ রহমান, আনিসুল হক, দীপু মনিসহহ অনেকে। তাদেরকে আদালতে তোলার পর আদালত চত্বরেই তাদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে।
সম্প্রতি সীমান্তে আটক হওয়ার পর সিলেটের আদালতে তোলার সময় সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের ওপর হামলা হয়। আদালতে প্রবেশের সময় আদালত প্রাঙ্গণে থাকা কিছু ব্যক্তি শামসুদ্দিন চৌধুরীকে বেধড়ক কিলঘুষি মারেন। অনেকে ডিম ছোড়ার পাশাপাশি জুতাও নিক্ষেপ করেন। কেউ কেউ শামসুদ্দিন চৌধুরীর নাম উল্লেখ করে ‘ভুয়া ভুয়া’সহ বিভিন্ন স্লোগান দেন।
এর আগে ২০ আগস্ট ঢাকার একটি আদালত থেকে কারাগারে নেওয়ার পথে আদালত প্রাঙ্গণে সাবেক সমাজ কল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি এবং সাবেক যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়ের ওপর হামলার অভিযোগ উঠে।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, রিমান্ড আবেদনের শুনানি শেষে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সুলতান সোহাগ উদ্দিনের আদালত দীপু মনির চার দিনের ও জয়ের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এরপর তাদের কারাগারে নেওয়ার সময় একদল আইনজীবী তাদের ওপর হামলা করেন। সেই সময় তারা ‘খুনি, খুনি, ফাঁসি চাই’সহ নানা ধরনের স্লোগান দেন।
অন্যদিকে গত মঙ্গলবার বিকেলে কড়া নিরাপত্তায় দুটি মাইক্রোবাসে করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননকে আদালত চত্বরে নেওয়া হয়। তখন আদালত চত্বরে উপস্থিত বিএনপি-জামায়াত সমর্থক অন্তত একশ আইনজীবী এই দুই নেতার শাস্তির দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন। একপর্যায়ে তাদের বহনকারী মাইক্রোবাসের ওপর ডিম নিক্ষেপ করা হয়।
এক ঘণ্টা পর বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য হাসানুল হক ইনুকে প্রথমে হাজতখানা থেকে বের করেন। এরপর বের করা হয় রাশেদ খান মেননকে। দুজনের মাথায় ছিল পুলিশের হেলমেট। আর শরীরে পরানো হয় বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট। যখন তাদের দুজনকে আদালতের প্রধান ফটকের সামনে আনা হয়, তখন তাদের লক্ষ্য করে ডিম ছোড়া হয়। একপর্যায়ে একজন জুতাও ছুড়ে মারেন।
শুধু সাম্প্রতিক এসব ঘটনাবলীই নয়, গত শেখ হাসিনা সরকারের আমলেও আদালত চত্বরে আসামির ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে।
২০১৮ সালে কুষ্টিয়ার আদালতে ‘আমার দেশ’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ওপর হামলা হয়। বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও টিউলিপ সিদ্দিককে নিয়ে কটূক্তি করে বক্তব্যে দেওয়ায় কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ইয়াসির আরাফাত ওরফে তুষারের করা মানহানি মামলায় জামিন নিতে যান মাহমুদুর রহমান। এসময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তার ওপর হামলা করেন। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয় তার। ভেঙ্গে দেওয়া হয় তার গাড়ি। পরে তিনি অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় ফিরে আসেন।
আদালত চত্বরে আসামির নিরাপত্তা নিয়ে জানতে চাইলে ডেপুটি পুলিশ কমিশনার (আদালত) আনিসুর রহমান বলেন, আমরা আসামিদের নিরাপত্তায় অনেক পুলিশ ফোর্স রাখছি। আসামিদের হেলমেট ও ভেস্ট পরানো হচ্ছে। তারপরও কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। সব পক্ষকে সহনশীল হতে হবে। তা না হলে এগুলো রোধ করা সম্ভব নয়।
অন্যদিকে আদালত চত্বরে এমন হামলাকে অশনিসংকেত বলে মনে করছেন আইনজ্ঞরা।
সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সভাপতি ও বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীদের সংগঠন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় সভাপতি জয়নুল আবেদিন বলেন, বর্তমানে দেশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আর কিছুদিন পার হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে এমন মন্তব্য করে।
তিনি আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণে আসেনি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসলে এসব ঠিক হয়ে যাবে। তবে কোনো আইনজীবী আদালত চত্বরে কোনো আসামির ওপর হামলা করলে সেটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এটা তারা করতে পারেন না।
সাবেক বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার এবিএম আলতাফ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, আদালত চত্বরে আসামির ওপর যেন হামলা না করে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও সজাগ হতে হবে। আদালত চত্বরে হামলা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নিরাপত্তার পরও যদি কেউ আক্রান্ত হন তার দায় কে নেবে— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে জনরোষ রয়েছে। মানুষের ক্ষোভ আছে, কিন্তু তারপরও আদালত চত্বরে কোনো আসামির ওপর হামলা করা উচিত না।
জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক গাজী কামরুল ইসলাম সজল বলেন, শুধু বর্তমানে নয়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও আদালত চত্বরে হামলা হয়েছে। আসামিকে ফাঁসি দেওয়ার পরও তার ওপর জুতা নিক্ষেপ করা হয়েছে। কোনো অবস্থাতেই আদালত প্রাঙ্গণে আসামির ওপর হামলা সমর্থন করি না। বর্তমানে জনরোষ তৈরি হওয়ায় মানুষ এগুলো কাজ করছে। আশা করি, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসলে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, আসামির ওপর হামলা ফৌজদারী অপরাধ। যে বা যারা এই হামলা করবে তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে ভিডিওর মাধ্যমে হাজিরা নেওয়া উচিত।
এআইএম