আমিনুল ইসলাম মল্লিক
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:১৩ পিএম
সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ও সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান ছাড়াও আরও কয়েকজন বিচারপতি বাংলায় বিভিন্ন মামলার রায় ঘোষণা করেছেন। তবে নিয়মিত বাংলায় রায় ঘোষণা করেন না কেউ। শুধুমাত্র ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করেই দুই-একজন বিচারপতি বাংলায় রায় ঘোষণা করেন।
২০২৪ সালে এসেও অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। ভাষা শহীদদের প্রতি সম্মান জানিয়ে সম্প্রতি বাংলায় একটি মামলার রায় ও আদেশ দেন বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ। একইদিন বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ দুটি মামলার রায় বাংলায় দেন। ১ ফেব্রুয়ারি আদালতের কার্যক্রম শুরু হলে সকালে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের নেতৃত্বাধীন দ্বৈত বেঞ্চ আইনজীবীদের উদ্দেশে বলেন, ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিন আজ। আমরা আজ বাংলা ভাষায় সিদ্ধান্ত দেব।
হাইকোর্টের দুটি বেঞ্চ পৃথকভাবে বাংলায় রায় ঘোষণা করলেও বাকি বেঞ্চগুলো এখন পর্যন্ত একটি রায়ও বাংলায় ঘোষণা করেননি।
কেন বাংলায় রায় বা আদেশ দেওয়া হয়নি— এ বিষয়ে আদালতের বেঞ্চ অফিসাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, বাংলা ভাষায় রায় দেওয়া সহজ। কিন্তু এ রায় লেখা আমাদের জন্য অনেক কষ্টের। কারণ আইনের ভাষাগুলো ব্রিটিশ, ল্যাটিন ও ইংরেজি টার্মে। এগুলো বাংলায় লেখা অনেক কঠিন। বাংলায় রায় বা আদেশ দিলে আদালতের সময় নষ্ট হবে, সেগুলো প্রস্তুত করতে।
বাংলায় রায় লেখা নিয়ে যা বলছেন বিচারপতিরা
গত বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলায় রায় নিয়ে সে সময়ের প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেছিলেন, বাংলা ভাষায় রায় প্রকাশ করার কাজ চলমান রয়েছে।
তিনি বলেছিলেন, ভাষা অনুবাদে সুপ্রিম কোর্টে নতুন একটি প্রযুক্তি সংযোজিত হয়েছে। আমাদের কর্মকর্তারা যে রায়গুলো ইতোমধ্যে লিখেছেন সেগুলো যাতে সুষ্ঠুভাবে অনুবাদ করা হয়, আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। নতুন এই প্রযুক্তির কারণে রায় অনুবাদ করে বাংলায় পড়া যাবে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।
অভিযোগ ছিল- টাকার বিনিময়ে আইনজীবীরা আদালতের রায় বাংলায় তরজমা করে সংশ্লিষ্ট বিচারপ্রার্থীকে বুঝিয়ে দিতেন। এমন অভিযোগ থেকে বিচারপ্রার্থীকে মুক্ত করতে আদালতে ইংরেজিতে রায় লেখার প্রথা সর্বপ্রথম ভাঙেন বিচারপতি আমীরুল ইসলাম চৌধুরী। এরপর আরো দুজন বিচারপতি দু-চারটি রায় দিয়েছেন বাংলা ভাষায়। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক আগের বিচারপতিদের প্রয়াসকে পূর্ণতা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল, স্বাধীনতার ঘোষণা, স্বাধীনতাযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণ, স্থানীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের ব্যানারে অংশ নেওয়া এবং প্রতি বছরের ডিসেম্বর মাসে নিম্ন আদালতে অবকাশকালীন প্রতি আদালতে একজন করে বিচারকের বিচার কাজ পরিচালনা সংক্রান্ত রায়সহ বেশকিছু রায় বাংলায় দেন বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক।
জানা যায়, ১৯৮৯-৯০ সালের দিকে বিচারপতি হাবিবুর রহমান প্রথম বাংলা ভাষায় রায় প্রদান করে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেন। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময় বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, বিচারপতি হামিদুল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বাংলা ভাষায় রায় দিয়েছেন।
আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, আমি বিচারপতি হওয়ার পর বাংলা ভাষায় রায় দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করি। কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে, আদালতে যে ভাষায় সাধারণত রায় দেওয়া হয় তা বেশিরভাগ জনগণ বোঝে না। জনগণের স্বার্থে ও প্রয়োজনে এই সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন বেশকিছু রায় বাংলা ভাষায় দিয়েছেন। ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তিনি একটি রায়ও ইংরেজিতে লেখেননি বলে জানা গেছে।
বাংলায় রায় নিয়ে যা বলছেন আইনজীবীরা
বাংলা ভাষায় রায় এই প্রজন্মের কাছে পুরোপুরি আশা করা কঠিন। আস্তে আস্তে চেষ্টা করলে পরবর্তী প্রজন্ম সুপ্রিম কোর্টে বাংলা ভাষায় রায়ের বিষয়টি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারবেন। কারণ এই প্রজন্মের বিচারপতি, আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টরা ইংরেজি ভাষায় আদালত অঙ্গনে কাজ করতে করতে অভ্যস্ত। তারা প্রতিনিয়ত ইংরেজি ভাষা চর্চা করেন। এজন্য ইংরেজি ভাষায় রায় দিতে তারা অভ্যস্ত। এর পরিবর্তন রাতারাতি সম্ভব না। এখন থেকে শুরু করলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম বাংলা ভাষায় রায়ের চর্চা করতে পারবে। এমন মতামত দিয়েছেন আইনজীবীরা।
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও হিউম্যান রাইডস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মনজিল মোরসেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, বাংলায় রায় দেওয়ার বিতর্কটা অনেকটাই সমাধান হয়ে গেছে। সাধারণত ইংরেজিতে রায় দিলে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারেন না। মানুষ যেন বুঝতে পারেন এজন্য বাংলায় রায় দেওয়া দরকার— এমন একটা দাবি ছিল। কিন্তু আমাদের জুডিশিয়াল সিস্টেমটাই ইংরেজিতে চলে আসছে। এজন্য বাংলায় রায় দেওয়াটা একটু কঠিন। তবে আস্তে আস্তে সেটি ঠিক হয়ে যাবে সময়ের ব্যবধানে।
এই আইনজীবী আরও বলেন, বিচারকদের বাংলায় রায় দেওয়ার প্র্যাকটিস নাই। এজন্য তারা বাংলায় রায় দিতে পারেন না। তবে সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপের মাধ্যমে রায় বাংলায় অনুবাদ করা যায়। ইংরেজিতে যখনই রায়টা ঘোষণা করা হয়, তখনই এটি বাংলায় করে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে যেন প্রকাশ করা হয় সেটি খেয়াল রাখা উচিত। আমরা যারা সুপ্রিম কোর্টে প্র্যাকটিস করছি, তারা সবাই ইংরেজিতে লিখে অভ্যস্ত। বাংলায় রায় লেখার অভ্যাসটা চালু করতে হবে। বাংলা রায় লেখার প্রয়োজনীয়তা কমে গেছে অ্যাপসের কারণে।
মনজিল আরও বলেন, আমি পরিবেশ ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করি। আমার বেশকিছু মামলার রায় বাংলায় দেওয়া হয়েছে। নদীর মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক সাহেব বাংলায় রায় দিয়েছেন। হাতিরঝিলের একটি মামলায় বাংলায় রায় দেওয়া হয়েছে।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে মাতৃভাষায় রায় না দিয়ে ইংরেজিতে রায় ঘোষণা করা হয়। কারণ ইংরেজি হচ্ছে আন্তর্জাতিক ভাষা— এমনটাই মতামত দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফরহাদ উদ্দিন আহমেদ ভূঁইয়া। তিনি বলেন, কেউ যদি রায় যদি দিতে চায় আপত্তি নেই। উচ্চ আদালতের রায় ইংরেজিতে হতে হবে। আমাদের আইনের ভাষাটা বাংলা অনুবাদ করা কঠিন। রায়গুলো বিচারপ্রার্থীদের জন্য না। এটি সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা বুঝলেই হবে।
তিনি বলেন, ইন্ডিয়াতেও ইংরেজিতে রায় দেওয়া হয়। তাদেরও মাতৃভাষা আছে। কিন্তু তারা ইংরেজিতে রায় দেয় কেন? আমরা ফেব্রুয়ারি আসলে বাংলার প্রতি বেশি আবেগী হয়ে যাই। কিন্তু অন্য সময় বাংলা ইংরেজি মিলে মিশে বলি। আমরা তো টোটাল ভাষাটা একদম বাংলায় বলি না, বা বলার চেষ্টাও করি না। কিন্তু আদালতের রায়ের ক্ষেত্রে এসে বাংলার প্রতি বেশি আগ্রই দেখাই কেন? উচ্চ আদালতে কেউ চাইলে বাংলায় রায় দিতে পারবেন। সেটি তার ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু আমাদের জুডিশিয়ারিতে ইংরেজি সিস্টেম চলে এসেছে।
তবে বাংলায় রায় দিলে বিচারপ্রার্থীদের উপকার হবে— এমন মন্তব্য করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনিরুল ইসলাম মিয়া ঢাকা মেইলকে বলেন, বাংলা ভাষায় রায় প্রদান একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। একইসঙ্গে বাংলা ভাষায় বিভিন্ন মামলার আবেদন গ্রহণে আইনজীবীদের উৎসাহ প্রদান করলে বাংলা ভাষায় রায় প্রদানের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে ও বিচারপ্রার্থীরা উপকৃত হবে। আদালতের রায়ে বাংলা ভাষার প্রচলন হবে ‘ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রেষ্ঠ উপহার’। একইসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের উদ্যোগে বাংলা ভাষায় রায় অনুবাদ সংক্রান্ত একটি হেল্প ডেস্ক থাকা উচিত বলে আমি মনে করি। যার সাহায্যে কোনো বিচারপ্রার্থী চাইলে মামলার রায় বাংলায় অনুবাদ করে নিতে পারবে এবং তা সব আদালতে গ্রহণযোগ্য হবে।
বিচারপ্রার্থীদের মন্তব্য
সুপ্রিম কোর্টের এক বিচারপ্রার্থী আবুল কালাম আজাদ ঢাকা মেইলকে বলেন, হাইকোর্ট ইংরেজিতে রায় দেন। আমরা সেটি বোঝার জন্য মোবাইলের অ্যাপে যাই। অ্যাপে গিয়ে বাংলা করে বিষয়টি বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করি। এই বিচারপ্রার্থী আরও বলেন, আমার ভ্যাট সংক্রান্ত একটি মামলা আছে। সে মামলায় রুল দিয়েছে। রুলের কপি ইংরেজিতে লেখা। আমার মামলার আদেশ আমি ব্যাংকের ম্যানেজারের কাছে গিয়ে বুঝে আসি। হাইকোর্ট রায় বাংলায় দিলে সবাই বুঝতে পারত।
যা বলছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন
সুপ্রিম কোর্টের ইংরেজি রায় সহজে বুঝতে অ্যাপ ব্যবহার করছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। এতে বিচারপ্রার্থীদের অনেক উপকার হচ্ছে বলে জানান সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল অফিসার মোয়াজ্জেম হোছাইন। তিনি বলেন, ইংরেজি রায়টি বাংলায় পরিবর্তন করতে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন দুটি অ্যাপ ব্যবহার করছে। একটি হচ্ছে ‘আমার ভাষা’। আরেকটা হচ্ছে গুগল থেকে অনুবাদ করা হয়। ‘আমার ভাষা’ অ্যাপ ব্যবহার করে বাংলায় অনূদিত রায়গুলো সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে দেওয়া হচ্ছে। রায়গুলো আমরা নিজেরা জজ সাহেবরা দেখে আপলোড করছি। একদম খাটি বাংলায় রায়গুলো আপলোড করা হচ্ছে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে।
এআইএম