আমিনুল ইসলাম মল্লিক
০১ আগস্ট ২০২৩, ০২:২৩ এএম
আমাদেরে দেশের প্রায় সবগুলো আইনই প্রণয়ন করেছে ব্রিটিশ। কারণ, তারা এদেশ শাসন করেছে প্রায় ২০০ বছর। তাদের সময়ে করা আদালত পাড়ার ডেকোরাম এখনও চলমান, যেগুলো পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী। বাংলাদেশ স্বাধীনের অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও ব্রিটিশ শাসিত সেই ডেকোরাম এখনও পরিবর্তন হয়নি। আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে আছে এগুলো। বিশ্বের অন্যান্য দেশে আদালতের ডেকোরাম কি হবে অর্থাৎ কোন নামে ম্যাজিস্ট্রেট, জজ, জাস্টিসদের সম্বোধন করতে হবে সে সুনির্দিষ্ট আইন আছে। নেই আমাদের দেশে, এমনকি সুপ্রিম কোর্ট রুলসেও নেই কোর্ট ডেকোরাম। তবে শতাবধি ধরে চলে আসছে ‘মাই লর্ড’ শব্দ।
সুপ্রিম কোর্টের যেকোনো বেঞ্চে মামলা শুনানি করতে গেলে বিচারপতিদের সম্বোধন করতে হয় ‘মাই লর্ড’ বলে। আসলে ‘মাই লর্ড’ শব্দের ব্যাখ্যা কি সেটিও পরিষ্কার করে বলতে পারেন না অনেকেই। কেউ বলছেন প্রভু আবার কেউ বলছেন সম্মানসূচক শব্দ এটি। তবে লর্ড শব্দের অর্থ হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চে পরিষ্কার করেছেন। ওই বেঞ্চের মতে লর্ড অর্থ হচ্ছে প্রভু। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দেশে বিচারপতিকে ‘প্রভু’ মানতে নারাজ অনেক আইনজীবী। তবে কোনো নামে বিচারপতিদের সম্বোধন করলে যুক্তিযুক্ত হবে সেটি নিয়ে রয়েছে ভিন্ন মত।
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি ও সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার এবিএম আলতাফ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘মাই লর্ড’ বলা আমাদের আদালত পাড়ার ঐতিহ্য। আমরা কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলো আদালত পাড়ায় এ শব্দগুলি (ব্রিটিশ টার্ম) ব্যবহার করে থাকি। এটা আমাদের একটা কাস্টমস (ঐতিহ্য)। বিশ্বের অন্যান্য দেশে ম্যাজিস্ট্রেট, বিচারক, বিচারপতিদের কি পদবীতে সম্বোধন করা হবে সে বিষয়ে বলা আছে, সুনির্দিষ্ট আইন আছে। কিন্তু আমাদের দেশে এ বিষয়ে কোনো আইন না থাকলেও আছে কাস্টমস বা প্রথা। সেটি হলো আমরা আদালতে বিচারপতিদের ‘মাই লর্ড’ বলে সম্বোধন করে থাকি। এটা আমাদের কাস্টমস। আর কাস্টমস থেকেই তৈরি হয় আইন।
হাইকোর্ট রুলস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হাইকোর্ট রুলস ১৯৭৩ সংশোধিত ২০১২ চ্যাপ্টার ১৬(এ) তে বলা আছে, কোর্টের ডেকোরাম কি হবে। রুলস ১(৩) অ্যাডভোকেট অথবা অন্য যেকোনো ব্যক্তি কোর্টকে সম্বোধন করবে দীর্ঘ দিনের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী।
আদালতে মাই লর্ড বলাতে কোনো লাভ বা ক্ষতি দেখছেন না সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। তিনি বলেন, আদালতে মাই লর্ড বলাটা সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই চলে আসছে। এটা দীর্ঘদিনের প্র্যাকটিস। আমরা সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগে কোনো মামলা শুনানির সময় আদালতে বিচারপতিদের উদ্দেশ্যে সম্বোধন করে থাকি মাই লর্ড। তিনি বলেন, আমার দৃষ্টিতে ‘মাই লর্ড’ বলাতে কোনো লাভ ক্ষতি নেই। তবে মাই লর্ড বলাটা নির্ধারণ করে দিবেন আদালত, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ও আইনজীবী সমিতি।
‘মাই লর্ড’ বলে সম্বোধন অপছন্দ মন্তব্য করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আজমাল হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা জাতি হিসেবে মুসলিম। আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মের অনুসারী। আদালতে গিয়ে বিচারপতিদের মাই লর্ড শব্দ ব্যবহারে আমার আপত্তি আছে। তিনি বলেন, আমি এর আগে আপিল বিভাগের বিচারপতি মোহাম্মাদ আব্দুল ওয়াহহাব মিঞার কাছে গিয়েছিলাম। মাই লর্ড শব্দ আদালত পাড়ায় ব্যবহার না করার অনুরোধ জানাতে। দীর্ঘদিন পর আজ হাইকোর্ট মাই লর্ড প্রসঙ্গে যে মন্তব্য করেছেন এতে আমি খুশি। কারণ, মুসলিমরা কখনোই বিচারপতিকে মাই লর্ড বলে সম্বোধন করতে পারেন না। এতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে।
সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের নবীন আইনজীবী মো. মনিরুল ইসলাম মিয়া ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে ৫০ বছর ধরে। আমরা নিজেদের কৃষ্টি কালচার ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে চাই। আমাদের কালচার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পারব। আজকে আদালত মাই লর্ড প্রসঙ্গে যে মন্তব্য তুলে ধরেছেন তার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত পোষণ করছি। আদালতের এমন সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছি।
আদালতের এমন মন্তব্যের পর সুপ্রিম কোর্টসহ দেশব্যাপী অনেক আইনজীবী আনন্দ প্রকাশ করেছেন। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন জায়গায় মাই লর্ড নিয়ে পজিটিভ মন্তব্য করেছেন।
বিচারপতিকে ‘মাই লর্ড’ না বলতে হাইকোর্ট বেঞ্চের নির্দেশনা
আদালতে মামলা শুনানির সময় বিচারপতিকে ‘মাই লর্ড’ বা ‘ইওর লর্ড শিপ’ না বলে ‘ইওর অনার’ বা ‘স্যার’ সম্বোধন করতে নির্দেশনা দিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছেন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। মঙ্গলবার বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি একেএম জহিরুল হকের বেঞ্চ থেকে —এ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়।
এর আগে, বিচার চলাকালে এই বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি বলেন, ‘দাসত্বের সময় নেই, প্রভুরা চলে গেছে। এখন থেকে মাই লর্ড/লর্ড শিপ নয়, ইওর অনার বা স্যার সম্বোধন করবেন।’
এ সময় উপস্থিত সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘এটা সম্মানার্থে’।
আদালত বলেন, ‘ইওর অনার বা স্যার সম্বোধন করলেও আমরা সম্মানিত বোধ করব।’
পরে ওই আদালতকক্ষের বাইরে এ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি সেঁটে দেওয়া হয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট আদালতের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মাহফুজুর রহমান লিখন বলেন, ‘এই নির্দেশনা কেবল এই একটি বেঞ্চের জন্য।’
এআইএম/এমএইচটি