সাখাওয়াত হোসাইন
০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৫:১৮ পিএম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের ২০১৮-২০১৯ সেশনের শিক্ষার্থী সীমা আক্তার। তাঁর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ঢাকার একটি বস্তিতে। এ পর্যন্ত আসতে তাকে করতে হয়েছে অনেক পরিশ্রম ও লড়াই-সংগ্রাম। তারপরও দমে যাননি সীমা আক্তার। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের কাছে অনুপ্রেরণার নাম ‘সীমা আক্তার’। তিনি দেখিয়েছেন অভাব-অনটন এবং নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কীভাবে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে সীমা আক্তারকে দেখা যায় সামনের সারিতে। ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তিনি ছিলেন সাহসী ভূমিকায়। আন্দোলনে হামলার শিকার হয়েও দমে যাননি তিনি। লড়াই করে আন্দোলনে সামনের সারিতে থেকেছেন এই অকুতোভয় শিক্ষার্থী। সবকিছু ছাড়িয়ে সীমা আক্তার এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে সমাজসেবা সম্পাদক পদপ্রার্থী হয়েছেন। ঢাকা মেইলের সঙ্গে আলাপকালে বললেন এই নির্বাচনে বিজয়ী হলে চালু করতে চান অপেক্ষাকৃত আর্থিকভাবে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাবৃত্তি। জানালেন বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তার নানা পরিকল্পনার কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা মেইলের নিজস্ব প্রতিবেদক সাখাওয়াত হোসাইন।

ঢাকা মেইল: আপনার শৈশব নিয়ে জানতে চাই।
সীমা আক্তার: আমার বাবা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আর আমার পরিবারে মা এবং ভাই-বোন আছেন। আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ঢাকার মিরপুরের একটি বস্তিতে। আমি সুবিধা বঞ্চিতদের স্কুল থেকে পড়াশোনা করেছি। আমাদের পাঠশালা থেকে প্রাথমিক সম্পন্ন করেছি। আর এসএসসি ডক্টর মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ স্কুল, তারপর সরকারি বাংলা কলেজ থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করেছি। এসব ক্ষেত্রে ‘স্কুল হেল্প মি আউট’ আমাকে সাহায্য করেছে। আর শিক্ষকরা আমাদের অনেক সহযোগিতা করেছেন আর্থিক এবং মানসিকভাবে।
ঢাকা মেইল: কয়েকদিন ডাকসু প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছেন। সাড়া পাচ্ছেন কেমন?
সীমা আক্তার: আমি অফলাইনে খুবই ভালো সাড়া পাচ্ছি এবং অনলাইনেও। তবে অনলাইনে টার্গেট করে ব্যাশিং (তীব্র আক্রমণ) করা হচ্ছে। কারণ ভিন্ন মতের মানুষদেরকে তো এখন পর্যন্ত বিশেষ করে নারীদেরকে যে ‘স্লাট-শেমিং’ (যৌন অপবাদ) করা হচ্ছে, সেটার শিকার হচ্ছি এবং প্রতিনিয়ত বুলিং করা (কটূক্তি) হচ্ছে। আর সেই জায়গা থেকে আমি অফলাইনে খুবই ভালো সাড়া পাচ্ছি। শিক্ষার্থীরা আমার উপর ভালো আস্থা রাখছেন এবং মনে হচ্ছে আমি জিতে আসতে পারবো।

ঢাকা মেইল: নির্বাচনে অনেকের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘণের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রার্থী হিসেবে কোনো শঙ্কা দেখছেন কি না?
সীমা আক্তার: এখন বিভিন্নভাবে আচরণবিধি লঙ্ঘন করা হচ্ছে। মুড়ি পার্টি হচ্ছে, এই পার্টি-সেই পার্টি হচ্ছে, আবার কেউ কাচ্চি খাওয়াচ্ছে...। অনেক অভিযোগ আবার প্রমাণিতও। কথা হচ্ছে বড় দলগুলো আচরণবিধি মানতেছে না, সেটার জবাবদিহিতা নির্বাচন কমিশন চাইছে কি না— আমার প্রশ্ন। আমি যে অভিযোগটা করেছি, বিজয় একাত্তর হলের একজন সদস্য প্রার্থীও আমাকে নিয়ে ‘স্লাট-শেমিং’ করছেন। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সহপাঠীই এগুলো করছে। সেটার বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন এখন পর্যন্ত কোনো কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
ঢাকা মেইল: আপনি নির্বাচিত হলে শিক্ষার্থীদের জন্য কী কী করবেন?
সীমা আক্তার: আমি নির্বাচিত হলে ক্যাম্পাসকে কীভাবে মানবিক ও শিক্ষার্থীবান্ধব করা যায় সেটা নিয়ে কাজ করবো। বিশেষ করে যারা শারীরিকভাবে অক্ষম। তারপর সংখ্যালঘুদেরকে নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আছে। আর যারা আছে নারী শিক্ষার্থী এবং বিশেষ করে মা শিক্ষার্থী, তাদেরকে আমি উচ্চ শিক্ষায় কীভাবে অন্যদের সঙ্গে সুযোগ-সুবিধা সমানে নিয়ে আসতে পারি, এটা একটা লক্ষ্য থাকবে। আর এমন একটি সাপোর্ট সিস্টেম তৈরি করব যেন আমার মতো যারা প্রান্তিক অঞ্চল বা সুবিধা-বঞ্চিত ছেলেমেয়েরা আছে তারা যাতে এগিয়ে যেতে পারে। অর্থনৈতিকভাবে যারা পিছিয়ে রয়েছে, তাদেরকে নিয়ে কাজ করবো। অনেক শিক্ষার্থীকে পার্ট টাইমস চাকরি বা টিউশনি করে চলতে হয় এবং পরিবারকে সাহায্য করতে হয়। তাদের কষ্টটা কমিয়ে আনার জন্য শিক্ষাবৃত্তি চালু করবো। আর এই ফান্ড তৈরি করা হবে বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের এলামনাই অ্যাসোসিয়েশন বিশ্ববিদ্যালয়, সরকার এবং সামাজিক সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে।

ঢাকা মেইল: শিক্ষার্থীদের মধ্যে হল এবং একাডেমিক এলাকায় রাজনীতি থাকা না থাকা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। এক্ষেত্রে আপনি নির্বাচিত হলে কী ভূমিকা রাখবেন?
সীমা আক্তার: আমি নির্বাচিত হলে প্রকৃত সাধারণ শিক্ষার্থীরা যা চাইবে তাই হবে। ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি কী হবে সেইটার একটা আচরণবিধি থাকবে। একটা সংগঠনের কী কী লিমিট (সীমাবদ্ধতা) থাকবে এবং কী কী করতে পারবে; সংগঠনগুলোকে নিয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটা নিয়ম-কানুন তৈরি করা হবে।

ঢাকা মেইল: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে নারী প্রার্থীদেরকে নানাভাবে হেয় করা হচ্ছে। এ বিষয়টা আপনি কীভাবে দেখছেন?
সীমা আক্তার: আমিও সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছি। আর আমি প্রথম থেকেই অনলাইনে ব্যাশিং খাচ্ছি, বিভিন্ন ধরনের মবের শিকার হচ্ছি। রিসেন্টলি আমি যখন প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছি, তারপরেই দেখা গেল আরো বেশি ব্যাশিং আর স্লাটশেমিং করা হচ্ছে। আমাকে হেয়প্রতিপন্ন করা এবং আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা করা হচ্ছে। আমি একজন নারী প্রতিদ্বন্দ্বী এবং লড়াই করছি, করে যাচ্ছি। আমি মনে করছি যে, নারীদের ক্ষেত্রে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হয়নি।
দেখবেন, ছেলেদের ক্ষেত্রে সবসময় তারা ছেলেদের সব হলে বিচরণ করতে পারে। আর ছেলেদের হল নারীদের হল সংখ্যার চেয়ে বেশি। সেই ক্ষেত্রে ছেলেদের সুবিধাও বেশি এবং তাদের কোনো টাইম লিমিট নাই। মেয়েদের হলগুলোতে আমি যদি অন্য হলে বা নিজের হলে গেলেও আমার সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা টাইম লিমিট করে দিচ্ছে। টাইম লিমিট করার কারণে প্রচারণা সঠিকভাবে চালাতে পারছি না। মেয়েরা হলে আসে রাত ৮টা বা ৯টার পরে। এক ঘণ্টায় কীভাবে সব রুমে যাওয়া যাবে? আমরা প্রচারণা কীভাবে চালাতে পারব? আবার ওয়ান টু ওয়ান লিফলেট দিয়ে কোন রকমের ব্যানার ছাড়া প্রচারণা চালাতে হচ্ছে। এখন কীভাবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করছে, সেটা নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে।

ঢাকা মেইল: এই যে আচরণবিধি লঙ্ঘন হচ্ছে। কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন কি না?
সীমা আক্তার: বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আচরণবিধি নির্ধারণ করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে এই যুগের সঙ্গে অনেক আচরণবিধি যায়ও না। যেমন অনলাইনের আচরণবিধি নাই স্পষ্ট। তারপর অফলাইনে চা-কফি খাওয়ানো যাবে না, কিন্তু মুড়ি পার্টি ঠিকই হচ্ছে। আচরণবিধি যুগোপযোগী নয় অনেকটাই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে পারে নাই। আবার হচ্ছে এই আচরণবিধি লঙ্ঘন হলে কি কি ব্যবস্থা নেয়া হবে এবং সেটাও আমাদেরকে জানানো হয়নি।
ঢাকা মেইল: নির্বাচিত হলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদেরকে গবেষণামুখী করতে কোন পদক্ষেপ বা ভূমিকা রাখবেন কিনা?
সীমা আক্তার: আমি একজন শিক্ষার্থী হিসেবে মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয় একটা গবেষণার মূল জায়গা। যেখানে শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষার পাশাপাশি গবেষণায় মনোযোগ দিতে পারবে এবং এই শিক্ষার্থীরা গবেষণামুখী তখন হবে যখন হচ্ছে গবেষণার সেক্টরগুলো বাড়বে। এখন গবেষণা সেক্টরে দেখা যাচ্ছে অনেক বেশি লিংক লবিং ভিত্তিক গবেষণা হয়। আর গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট নাই, বিজ্ঞানের গবেষণার জন্য অত্যাধুনিক ল্যাব নাই এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধার অভাব। যার কারণে শিক্ষার্থীরা গবেষণাবিমুখ। আমি চেষ্টা করবো এগুলো নিয়ে কাজ করার। শিক্ষার্থীরা যাতে গবেষণায় আগ্রহী হয়।

ঢাকা মেইল: ভোটারদের উদ্দেশে কী বলতে চান এবং তাদেরকে কী বার্তা দিতে চান।
সীমা আক্তার: আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে অনুরোধ করবো, এইবার অভ্যুত্থানের পরে এমন একটা সুযোগ এসেছে, যেখানে নিরপেক্ষ ডাকসু করা যাবে। এই ডাকসুতে আপনারা অবশ্যই ভোট দিতে আসবেন, যাকে খুশি তাকে ভোট দেন। তবে শিক্ষার্থীবান্ধব প্রার্থীদেরকে ভোট দেবেন।
ঢাকা মেইল: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
সীমা আক্তার: আপনাকেও ধন্যবাদ।
এসএইচ/ক.ম/