images

সাক্ষাৎকার

‘খবরদারি নয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বাধীনভাবে চলতে দেওয়া উচিত’

মো. আব্দুস সবুর (লোটাস)

২০ আগস্ট ২০২৫, ০৮:৩৭ পিএম

অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ। দেশের প্রবীণ শিক্ষাবিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপক বিশ্ববিদ্যালয়টির ২৬তম উপাচার্য। গত বছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর তিনি উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন- ইউজিসির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েছেন। দেশের উচ্চশিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে তাঁর মুখোমুখি হয়েছেন ঢাকা মেইলের নিজস্ব প্রতিবেদক আব্দুস সবুর লোটাস

ঢাকা মেইল: দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইউজিসি প্রত্যাশা অনুযায়ী কতটুকু অর্জন করতে পেরেছে এবং কীভাবে কাজ করছে?

অধ্যাপক ফায়েজ: বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি) রেগুলেটরি বডি হিসেবে বলা হলেও আমি সহযোগিতা প্রদানের একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সর্বদা চিন্তা করি। ইউজিসি বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে, যেগুলোর সঙ্গে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় সরাসরি যুক্ত থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ শিক্ষার সঙ্গে জড়িত সবাইকে নিয়ে মূলত টিম স্পিরিটের আলোকে এগিয়ে যাওয়ার কাজও করে এই প্রতিষ্ঠান। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা, আবাসন, নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে সব কাজে সব ধরনের সহযোগিতার কাজ করে ইউজিসি। দেশের শিক্ষার্থীরা যাতে সত্যিকার অর্থে শিক্ষা লাভ করে দেশের কাজে আসতে পারে, সেদিক গুরুত্ব দিয়ে আমরা কাজ করছি।

ঢাকা মেইল: গত কয়েক বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা রাতারাতি বেড়েছে। দেশের জন্য আসলে এটা কতটা জরুরি ছিল?

অধ্যাপক ফায়েজ: একটি দেশের মধ্যে অনেকসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়া সমস্যার কিছু নয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আসলে কত বেশি গুণগত মানের শিক্ষা দিতে পারছে, সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার ক্ষেত্রে গুণগতমান ঠিক করতে না পারলে তেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের দরকার নেই। অন্যদিকে আমাদের দেশে অনেক শিক্ষার্থী, তাদের সবার ভালো শিক্ষা অর্জনের জন্য প্রতিষ্ঠানের দরকার রয়েছে। এছাড়া প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে, এটিও ইতিবাচক শিক্ষার জন্য।

ঢাকা মেইল: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি লাগামছাড়া হয়ে যাচ্ছে, এ ব্যাপারে নীতিগত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ আছে কি?

অধ্যাপক ফায়েজ: দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা এসেছিল। আমরা পরিষ্কার বলে দিয়েছি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে সম্পূর্ণ অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এটি করতে না পারলে আমরা সেটি বন্ধ করে দেব। শিক্ষার্থীদের থেকে এমনভাবে টিউশিন ফি আদায় করা যাবে না যেটা তাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া সমাজের মাধ্যমে বিত্তশালীরা এসব প্রতিষ্ঠান খুলেছে, তাদেরও সমাজের প্রতি দায় রয়েছে। কারণ সমাজের মাধ্যমে তারা বিত্তশালী হয়েছে। আমরা চাই, অন্তত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী স্কলারশিপের মাধ্যমে বিনামূল্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ পাবে।

অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ট্যাক্সও থাকা উচিত নয়। শিক্ষায় কোনো ট্যাক্স থাকতে পারে না। কারণ এটি শিক্ষার্থীদের ওপরই পড়বে। তাই অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ট্যাক্স ফ্রি করতে পারে।

আরও পড়ুন

‘বিশ্ববিদ্যালয়ের যেখানেই হাত দিই, সেখানে নতুন করে কাজ শুরু করতে হচ্ছে’

‘কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষার আধুনিকায়নে আমরা জোর দিচ্ছি’

ঢাকা মেইল: দেশে উচ্চ শিক্ষার ডিগ্রি অর্জনের পর বড় একটা অংশ বেকার থাকে। এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কতটা দায়ী?

অধ্যাপক ফায়েজ: দেশের আর্থসামাজিক নানা কারণে অনেকে বেকার থাকে। আবার কর্মসংস্থানের অভাবে অনেককে কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না। তবে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য সুযোগ যেকোনো সময় আসতে পারে। শিক্ষার একটা আলাদা গুরুত্ব আছে, এটি অতিরঞ্জিত করে বলার কিছু নেই। তবে দেশের তরুণ শিক্ষার্থীদের এমনভাবে শিক্ষা প্রদান করা দরকার, যাতে তারা যেকোনো সময় দেশের কাজে আসতে পারে। বর্তমানে নিড বেসড শিক্ষা খুবই জরুরি। তাই দেশের তরুণদের দক্ষ করতে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আরও বাড়াতে হবে।

ঢাকা মেইল: দেশের উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো পরীক্ষাকেন্দ্রিক। শিখন ও নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে এই প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা অবদান রাখতে পারছে?

অধ্যাপক ফায়েজ: আমরা চেষ্টা করছি বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সিলেবাস আপডেট রাখতে। এছাড়া দেশীয় জব মার্কেটের চাহিদা অনুসারে নতুন নতুন বিষয় সংযুক্ত করতে। শিখনপদ্ধতি নিশ্চিত করার জন্যও কাজ চলছে। এছাড়া আমরা হিট প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি, যার মধ্যে একাডেমি ও ইন্ডাস্ট্রির সমন্বয় করা হচ্ছে।

ঢাকা মেইল: তুলনামূলক অল্প বয়সী বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পাবলিকের তুলনায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কীভাবে ভালো করছে?

অধ্যাপক ফায়েজ: বর্তমান সময়ে কোনটা পাবলিক বা প্রাইভেট এভাবে দেখার আর সুযোগ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় মানে বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কে কত বেশি শিক্ষায় অবদান রাখতে পারছে, সেটা আসল বিষয়। এসব কিছু নির্ভর করে প্রতিষ্ঠানের প্রধান, শিক্ষা কাঠামো, শিক্ষক, মেধাবী শিক্ষার্থী ও গবেষণায় কতটুকু সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা হচ্ছে সেটির ওপর। গবেষণার মূল বিষয় হলো, সমাজের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে একটা সমাধান বের করে দেওয়া। আন্তর্জাতিকভাবে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কত বেশি ইন্টারকানেকটেড হতে পারে সেটির ওপর র‌্যাঙ্কিং নির্ভর করে। তাই এসবে যারা ভালো করছে তারাই বিশ্ব পরিসরে ভালো করছে।

DU
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৬তম উপাচার্য। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা মেইল: দেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন শিক্ষার ক্ষেত্রে কতটা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে?

অধ্যাপক ফায়েজ: স্বায়ত্তশাসন আইনের মধ্যে কোনো সমস্যা দেখি না। আমি দেখতে চাই, আইন কীভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। প্রথমেই উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধা ও যোগ্যতার বিষয়গুলো বিবেচনা করে নিয়োগ দিতে হবে। যার এই পদের প্রতি মোহ আছে সে প্রথমেই অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে সার্বিক কাজে যিনি দল-মতের ঊর্ধ্বে যেতে পারবেন তার উপাচার্য হওয়া দরকার। উপযুক্ত মানুষকে বেছে এটি করা গেলে ভালো হবে। আর বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারের মধ্যে সম্পর্ক হবে সহযোগিতার। কিন্তু খবরদারির সম্পর্ক হলেই সমস্যা হবে। তাই দেশের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন থাকা ভালো। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজের স্বাধীন মতো চলতে দেওয়া উচিত।

ঢাকা মেইল: বিগত সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দলীয় বিবেচনায় অনেক শিক্ষক নিয়োগ হয়েছেন। এই সংখ্যাটি বিশাল। এ ব্যাপারে আপনারা কী ভাবছেন?

অধ্যাপক ফায়েজ: বিগত সময়ে এমন অনেক কিছু ঘটেছে যেটা হওয়া উচিত ছিল না। এমন অবস্থা দীর্ঘ সময় ধরে চলেছে। মেধাকে প্রায়োরিটি না দিয়ে একটা সীমালঙ্ঘন করা হয়েছে। যার ফলে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। এই অভ্যুত্থানে আসলে আরও পরিষ্কারভাবে বোঝা গেছে, আমাদের তরুণদের মেধা কত ভালো। বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়ার পর যারা সেখানে শিক্ষার্থী ও সহকর্মীদের মধ্যে অনেক বাড়াবাড়ি করেছে, তাদের ব্যাপারে কোনো আপস নয়। অনেকে চলেই গেছেন। আর যারা আছেন তাদের নতুন করে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে না। এই যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিশাল আকারে ক্ষতি হয়েছে, সেগুলো পুষিয়ে নেওয়া ব্যাপক চ্যালেঞ্জের। এখন থেকে খুব ভালোভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া পরিচালনা করতে পারলে চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করা সম্ভব হবে।

আরও পড়ুন

স্থায়ী সনদ নেই ৯৬ বিশ্ববিদ্যালয়ের, কী ব্যবস্থা নেবে ইউজিসি

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট ১০ লাখের ৪০ ভাগই বেকার!

ঢাকা মেইল: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার জন্য আসলে কী কী ধরনের যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?

অধ্যাপক ফায়েজ: বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরুতে লেকচারার হওয়ার জন্য প্রথম তার একাডেমিক প্রফিসেন্সি দেখতে হবে। বিগত পাঁচ বছরে সে কত বেশি একাডেমিক ও গবেষণায় যুক্ত থেকে ভালো করেছে সেটা দেখতে হবে। এছাড়া পাবলিকেশন ও সাইটেশনও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রফেশনের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তার পিএইচডি ডিগ্রি।

ঢাকা মেইল: দীর্ঘদিন পর ডাকসু, রাকসু ও জাকসু নির্বাচনের আয়োজন চলছে। এই নির্বাচনগুলো কতটা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

অধ্যাপক ফায়েজ: এই নির্বাচনগুলোর অনেক ইতিবাচক দিক রয়েছে। কারণ ছাত্ররাই হলো দেশের ভবিষ্যৎ। তাই তারা যোগ্যতাসম্পন্ন নেতা হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া ও দেশ পরিচালনার সহযোগী হবে-এটি বেশ ভালো। এছাড়া শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সময়ের দাবি-দাওয়া জানানোর প্ল্যাটফর্ম প্রয়োজন। সেটির বিবেচনায় ছাত্র সংসদ খুবই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে।

ঢাকা মেইল: এত ব্যস্ততার মধ্যেও সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

অধ্যাপক ফায়েজ: আপনাকেও ধন্যবাদ।

এএসএল/জেবি