images

সাক্ষাৎকার

‘পরিবেশ নিয়ে আমরা হয়ত একটা রিট করতে পারি, মুখ্য ভূমিকা তো সরকারের’

আমিনুল ইসলাম মল্লিক

১৭ মার্চ ২০২৫, ০৪:২২ পিএম

images

মানবাধিকার ও পরিবেশ রক্ষায় প্রায় ২৫ বছর ধরে কাজ করছেন সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। এখন পর্যন্ত এ সংক্রান্ত প্রায় ৩০০ মামলা করেছেন আলোচিত এই আইনজীবী। এর মধ্যে শতকরা ৯৯ ভাগ মামলায় তার পক্ষে রায় এসেছে। আমৃত্যু পরিবেশ নিয়ে কাজ করার প্রত্যয় জানিয়েছেন প্রবীণ এই আইনজীবী। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা মেইলের সিনিয়র রিপোর্টার আমিনুল ইসলাম মল্লিক

ঢাকা মেইল: পরিবেশ দূষণের কবল থেকে বের হতে পারছে না রাজধানী ঢাকা। বিশ্বে প্রতিদিনই দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষ অবস্থানে থাকে ঢাকার নাম। এর কারণ কী বলে মনে করেন আপনি?

মনজিল মোরসেদ: পরিবেশ দূষণের দিক থেকে বিশ্বে প্রথম শহর হচ্ছে ঢাকা। আজকে প্রথম, কালকে দ্বিতীয়, পরশু তৃতীয়। এরকমভাবেই অবস্থান করছি আমরা। এটা ইচ্ছা করলেই আমরা দূর করতে পারি। দূর করার উদাহরণ আমরা সৃষ্টি করেছিলাম ২০১৯-২০ সালে। যখন আমরা ইটভাটা বন্ধের আদেশ পেয়েছিলাম। তখন ঢাকার আশপাশের অনেক ইটভাটা বন্ধ করা হয়েছিল। এ বিষয়ে নয় দফা নির্দেশনা ছিল। সেই নয় দফা নির্দেশনার কারণে তখন দূষণের শহরের তালিকা থেকে আমরা অনেকটাই মুক্ত হয়েছিলাম। বিশেষজ্ঞের করা নয় দফা ছিল। যদি এই দফাগুলো যথাযথভাবে পালন করা হয় তাহলে আমার বিশ্বাস, এই যে দুর্ভোগ আমাদের থাকবে না। অবশ্যই এটা থাকবে না। এর পজিশনে আমরা অনেক নিচে চলে যাবো। আমাদের ভালো বাতাস পাওয়ার একটা সুযোগ হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, এটা করা হচ্ছে না। প্রশাসন এটার সঙ্গে জড়িত। যাদের প্রতি নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে তাদের একজনও এই কাজটা করে না।

ঢাকা মেইল: সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সড়কের ময়লা পরিষ্কারের বাইরে মূল সড়কে মাঝেমধ্যে পানি ছিটানো হয়। দূষণ ঠেকাতে এই উদ্যোগ কতটা কাজে আসতে পারে?

মনজিল মোরসেদ: সিটি করপোরেশনকে পানি ছিটানোর কথা বলা হলে তারা প্রধানমন্ত্রীর অফিসের আশপাশে বা হাইকোর্টের আশপাশে পানি ছিটায়। কিন্তু গাবতলী যাত্রাবাড়ী পূর্বাচলসহ যেসব জায়গায় ধুলার মহোৎসব চলছে সেসব জায়গায় কোনো পানি ছিটানো হচ্ছে না। পরিবেশ সুষ্ঠু রাখতে যাদের দায়িত্ব তারা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন না করার কারণে আমরা দূষণে আছি। পানি ছিটাতে সরকারি নির্দেশনা আছে। আমরা লেগে আছি। আবারো আদালতে যাবো। আদালত একটা ডেট দিয়েছে। আমরা সময় অনুযায়ী আবারও আদালতে যাবো। ঢাকা শহর দূষণের পেছনে যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি বা সুস্পষ্ট কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে এই শহর দূষিত হচ্ছে।

আর ময়লা আবর্জনা নিয়ে কী বলবো। কিছুদিন আগে একজন বিচারক গাজীপুরে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে দেখেন একটা মহাসড়কের পাশে নোংরা অবস্থা। ব্যাপক দূষণ হচ্ছে। তখন তিনি দেখলেন গাজীপুর সিটি করপোরেশন রাস্তার পাশে পচা-বাসি ময়লা ফেলছে। তখন তিনি এডিশনাল কমিশনারকে জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কীভাবে সম্ভব? আমরা নাকি উন্নত হচ্ছি। উন্নত দেশে আমরা যে ঘরে বাস করছি তার পাশেই তো ময়লা। ময়লার পাশ দিয়েই আমরা হাঁটছি। সিটি করপোরেশনের ময়লা অপসারণের যে পদ্ধতি সেটি যদি আধুনিকায়ন করা না হয়, এই ময়লাটা এমনভাবে সরাতে হবে যাতে করে আপনার বাসার যে ময়লাটা আছে সেটি সঠিকভাবে অপসারণ করা হয়। এর মাধ্যমে দূষিত বাতাস কোথাও বের হবে না। এরকম সিস্টেম করতে হবে। সেটি এখনো করা হয়নি। এখনো ঢাকা শহরের মধ্যে দেখবেন ময়লার স্তুপ পড়ে আছে। এগুলো তো সিটি করপোরেশন ইচ্ছ করলে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আইন করে দিতে পারে। আপনার বাসার সামনে যদি কোনো ময়লা পাওয়া যায় তাহলে আপনার বাসার মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইভেন রাজউকও ওই ভবন বসবাসের অনুপযোগী ঘোষণা করে দিতে পারে। মোবাইল কোর্টের শাস্তি বা জরিমানার বিধান তো আছেই। ঢাকাসহ এর আশপাশে যে বায়ু দূষণের কারণ সেটা কিন্তু রিপোর্টে এসেছে।

ঢাকা মেইল: ঢাকার আশপাশে প্রচুর পরিমাণ ইট ভাটা, শিল্প কারখানার কালো ধোঁয়া বাতাসকে দূষিত করে। মাঝেমধ্যে অভিযান চালানো হয়। জরিমানা করা হয়। আপনার কি মনে হয় এটাই প্রতিকারের একমাত্র উপায়?

মনজিল মোরসেদ: এ বিষয়ে আমাদের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ঢাকার আশপাশের পাঁচটি জেলার অবৈধ ইটভাটা গুঁড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরকম ৭০০ ইটা ভাটা আছে। আদালতের আদেশের পর ইটভাটাগুলো ভাঙা শুরু হয়েছিল। আদালতেরও একটা ভালো অবস্থা ছিল। এবং তারা দৃঢ়ভাবে বলেছিল, এগুলো ভাঙতেই হবে। প্রায় ২০০ অবৈধ ইটভাটা ভাঙা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে করোনা আসার পরে ভাঙার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরে আবার এগুলো আস্তে আস্তে থেমে যায়।

এখনো এ মামলাগুলো যেসব আদালতে আছে, সেই আদালতও বিষয়টি পজিটিভ নিচ্ছে। কিন্তু ধীরে ধীরে এখন আর রিপোর্ট আসছে না। আমি পরে সাংবাদিকদের মাধ্যমে দেখেছি, তারা আবার পরিবেশ দূষণের বিষয়ে দায়সারাভাবে কাজ করছে। তারা সরকারি চাঁদাবাজি অর্থাৎ ওখানে গিয়ে বলে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে সরকারের কোষাগারে নেয়। এই ৫০ হাজার টাকা জরিমানা দেওয়ার পর তারা আবার অবৈধ ইটভাটাগুলো চালায়। কিন্তু কেন চালাচ্ছে এর কোনো খোঁজখবর নেই। অবৈধ ইটভাটার চালু রাখার কারণে দোষীদের কিন্তু থানায় নিচ্ছে না। পুলিশ তাদের আটক করছে না। এগুলো না করার কারণে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে মারাত্মকভাবে। চাঁদা নেওয়ার কালচার বন্ধ না করা পর্যন্ত পরিবেশ দূষণ কন্ট্রোলে আসবে না। আমাদের আবেদন হলো, যারা ইটভাটা চালাচ্ছে তাদের সরাসরি জেলে পাঠাতে হবে। আইনে কিন্তু দুই বছরের জেলের কথা বলা আছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেক ইটভাটার সঙ্গে রাজনৈতিক দলের নেতারা জড়িত। এমপি মন্ত্রীরা জড়িত। এজন্য এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। পরিবেশ রক্ষা করতে হলে অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করতে হবে। এটার সঙ্গে রাজনীতি বা অন্য কোনো নীতি খাটালে সেটা বাস্তবায়ন হবে না।

Morshed3

ঢাকা মেইল: দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা, পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো কি যথাযথ ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন।

মনজিল মোরসেদ: রাজউক একটা অকার্যকর প্রতিষ্ঠান। তেমনই পরিবেশ অধিদফতরও একটা অকার্যকর প্রতিষ্ঠান। এটা অবশ্য পরিবেশ অধিদফতরের একার দোষ না। এটা সরকারের দায়ও আছে। কারণ হলো, তাকে আপনি যুদ্ধে পাঠাবেন কিন্তু কোনো অস্ত্র দেবেন না, তাতো হতে পারে না। কাজের ক্ষেত্রে তারা অনেক ফাঁকিঝুঁকি করছে। কোর্টে রিপোর্ট দিচ্ছে যে, আমরা অবৈধ ইটভাটা ভেঙেছি। কিন্তু আমি সাংবাদিকের মাধ্যমে জানতে পারি, অনেক অবৈধ ইটভাটা চলছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে পরিবেশ অধিদফতরের যিনি হেড। তাকে তো  ডেপুটেশনে পাঠানো হয় প্রশাসন থেকে। তাকে তিন বছরের সময় বেঁধে দিয়ে। এরপর উনি চলে আসেন। কিন্তু এখানে যদি ওই পরিবেশ অধিদফতরের নিজস্ব লোককে আপনি ট্রেন্ডআপ করতে পারেন সেটা ভালো হয়। বাইরে থেকে লোক নিয়ে সঠিকভাবে পরিবেশ অধিদফতরের কাজ করা যাবে না।

ঢাকা মেইল: দূষণের হাত থেকে ঢাকাসহ দেশকে বাঁচাতে পরিবেশ অধিদফতরের কার্যক্রম কীভাবে মূল্যায়ন করবেন। তাদের যে আইনি ক্ষমতা দেওয়া আছে তা কি যথেষ্ট? না পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে?

মনজিল মোরসেদ: পরিবেশ অধিদফতরের জন্য একটা মহাপরিকল্পনা করা দরকার। তাদের অর্থ তাদের লোকবল এবং তাদের লজিস্টিক সাপোর্ট লাগবে। সব কিছু দিলে তখন তারা ভালো কাজ করতে পারবে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে যারা কাজ করছেন তাদের সঙ্গে ইটভাটার মালিকদের একটা যোগসূত্র আছে। যোগসূত্রের কারণে তাদের তথ্যটা হেড অফিসে এসে সঠিকভাবে পৌঁছে না। পরিবেশ অধিদফতরের বিরুদ্ধে শত শত মামলার ফাইল আছে। এসব মামলা সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য কমিডেট ল ইয়ারের অভাব।

দেখুন সরকারের ভূমিকাই এখানে মুখ্য। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এগুলো নিয়ে জোরালো তেমন কিছু করতে পারবে না। আমাদের কাছে তো ঢাল তলোয়ার নাই। আমরা যে যেভাবে পারি আদালতে গিয়ে মামলা করি প্রতিকার চাওয়ার জন্য। আমরা হয়ত রিট করে একটা আদেশ নিয়ে দিতে পারি। কিন্তু আমরা তো নিজেরা সবকিছু বাস্তবায়ন করতে পারব না। তবে সচেতনতা বাড়াতে পারি। এক্ষেত্রে মিডিয়ার একটা বড় ভূমিকা আছে। অনেক অনেক জায়গায় মিডিয়াও কিন্তু ম্যানেজ হয়ে যায়। তারা রিপোর্ট করে না। এই জায়গাতে আমি বলব, যারা মিডিয়ার শীর্ষে আছেন তারা যেন সারাদেশের জনগুরুত্ব ও পরিবেশসংক্রান্ত্র বিষয়গুলো ভালো করে দেখেন। নিউজ করেন। স্থানীয় সাংবাদিকদেরকে সচেতন করে তোলেন।

ঢাকা মেইল: পরিবেশ নিয়ে জনস্বার্থে আপনি কতগুলো মামলা করেছেন?

মনজিল মোরসেদ: আমি এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০০ মামলা করেছি পরিবেশ নিয়ে। এর মধ্যে শতকরা ৯৯ ভাগ মামলায় আমার পক্ষে রায় এসেছে। আমি আজ থেকে ২৫ বছর আগে এই পরিবেশ নিয়ে কাজ করছি। আমৃত্য কাজ করে যাব।

এআইএম/জেবি