আন্তর্জাতিক ডেস্ক
২৪ ডিসেম্বর ২০২২, ০৩:২৭ পিএম
ইরানে মাহশা আমিনি নামে এক ২২ বছর বয়সী কুর্দি তরুণীর মৃত্যুর ঘটনায় দেশটিতে হিজাববিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। তেহরানে গত ১৩ সেপ্টেম্বর ঠিকভাবে হিজাব না পরার অভিযোগে ইরানের ‘নৈতিকতা রক্ষা পুলিশ’ তাকে আটক করার পরে হেফাজতে থাকা অবস্থায় মারা যান মাহশা আমিনি।
এরপর ইরানের ৩১টি প্রদেশের ১৬১টি শহরে হিজাববিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে এবং ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর এটাকে সবচেয়ে গুরুতর সরকারবিরোধী বিক্ষোভ বলে বিবেচনা করা হচ্ছে।
এই বিক্ষোভে এ পর্যন্ত নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে অন্তত ৪৮৮ জন বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছে এবং মানবাধিকার কর্মীদের হিসাব মতে এ পর্যন্ত ১৮,২৫৯ জনকে আটক করা হয়েছে। এছাড়া এ সময় নিরাপত্তা বাহিনীর ৬২ জনও মারা গেছেন।
ইরানের নেতারা এ বিক্ষোভকে ‘বিদেশি শত্রুদের উসকে দেওয়া দাঙ্গা’ বলে অভিহিত করে থাকেন।
প্রেক্ষাপট
মাহশা আমিনিকে ‘অপূর্ণাঙ্গ হিজাব’ পরিধানের জন্যে ২০২২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ‘গাইডেন্স পেট্রোল’ বা নৈতিকতা রক্ষা পুলিশ গ্রেফতার করে। অভিযোগ করা হয়, পুলিশের মারধরে মাথার খুলিতে আঘাতের কারণে তিনি ‘ব্রেন ডেড’ হয়ে পড়েছিলেন। দু’দিন পর ১৬ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান। তার জানাজার পর ইরানের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ হয়। পরে ১৮ সেপ্টেম্বর কুর্দিস্তান প্রদেশ থেকে তেহরানে দেশব্যাপী ধর্মঘট ডাকা হয়। ইরানি কুর্দিস্তান দল এবং কুর্দিস্তানের নাগরিক ও রাজনৈতিক কর্মীরা একটি সাধারণ ধর্মঘট দিবস ঘোষণা করে।
এরপর কুর্দিস্তান প্রদেশের সাক্কেজ, সানন্দাজ, দিভান্দার্রেহ, বানেহ ও বিজার শহরে বিক্ষোভ শুরু হয়। পরে ইরানের অন্যান্য অংশে তা ছড়িয়ে পড়ে। এই বিক্ষোভ-আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং তেহরান, হামাদান, কেরমানশাহ, মাশহাদ, সবজেভার, আমোল, বাবোল, এসফাহন, কেরমান, শিরাজ, তাবরিজ, রাশৎ, সারি, কারাজ, চালুস, নওশহর, টোনেকাবন, আরাক, ইলাম, কিশ দ্বীপ প্রভৃতি শহরসহ অন্য অনেক শহরে বিক্ষোভ শুরু হয়।
হিজাববিরোধী বিক্ষোভ
ইরানজুড়ে নারীরা নিজেদের হিজাব পুড়িয়ে এবং চুল কেটে বিক্ষোভ করছেন। বিবিসি বলছে, ইরানের হিজাববিরোধী এই বিক্ষোভে নারীরা সামনের সারিতে অবস্থান করছেন। এছাড়া বহু বিক্ষোভকারী দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা খামেনির পদত্যাগের দাবি জানান।
পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ইরানের এবারের বিক্ষোভ দেশটির অন্য বিক্ষোভের তুলনায় পুরোপুরি ভিন্ন। এটা দেশটির বহু নারীর এত দিনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। তারা তাদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া আইন থেকে মুক্তি পেতে চাচ্ছেন।
বিক্ষোভের বিষয়ে যা বলছে ইরান
ইরানে সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে দায়ী করেছেন আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। দেশটির সর্বোচ্চ নেতা বলেছেন, ইরানে সহিংসতা ও নৈরাজ্যের পেছনে রয়েছে মার্কিন ও ইসরায়েলি গোয়েন্দারা। তাদের পরিকল্পনাতেই এসব হয়েছে।
তিনি বলেন, এ ঘটনা তদন্তের আগেই কোনো বিষয়ে নিশ্চিত না হয়েই কিছু লোক প্রতিক্রিয়া হিসেবে রাস্তায় নেমে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে, কুরআনে আগুন দেবে, পর্দানশীন নারীদের মাথা থেকে হিজাব টেনে খুলে ফেলবে, মসজিদ ও মানুষের গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করবে- এগুলো স্বাভাবিক কোনো প্রতিক্রিয়া নয়।
পরিকল্পিতভাবে এমন নৈরাজ্য ও সহিংসতা চালানো হয়েছে উল্লেখ করে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন, এ ইরানি তরুণীর মৃত্যুর ঘটনা না ঘটলেও তারা অন্য অজুহাত সৃষ্টি করত যাতে দেশটিতে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা যায়।
তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমন নৈরাজ্য ও সহিংসতার ঘটনা অনেক ঘটে। ইউরোপে বিশেষ করে ফ্রান্সের প্যারিসে কিছু দিন পরপরই এমন সহিংসতা দেখা দেয়। কিন্তু এ পর্যন্ত কি এমন ঘটেছে যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ সেখানকার এমন ঘটনার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে এবং বিবৃতি দিয়েছে? এমন ইতিহাস কি আছে যে তারা বার্তা দিয়ে বলেছে, আমরা তোমাদের (বিক্ষোভকারী ও দাঙ্গাকারী) পাশে আছি? এমন ইতিহাস কি আছে যে মার্কিন পুঁজিবাদ এবং সৌদি আরবসহ আঞ্চলিক কিছু সরকারের মতো মার্কিন অনুচরদের মদদপুষ্ট গণমাধ্যম ওইসব দেশের বিশৃঙ্লখা ও সহিংসতা সৃষ্টিকারীদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে? কখনও কি এমনটা হয়েছে যে মার্কিনিরা ওইসব দেশের বিশৃঙ্লখা সৃষ্টিকারীদেরকে বিশেষ হার্ডওয়্যার ও সফ্টওয়্যার সরবরাহের ঘোষণা দিয়েছে যাতে তারা সহজে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে পারে? কিন্তু ইরানে বিশৃঙ্লখা সৃষ্টিকারীদের প্রতি এ ধরনের সহযোগিতা ও সমর্থনের ঘটনা বহুবার ঘটেছে। তাহলে কিছু মানুষ কিভাবে এসব ঘটনায় বিদেশি হস্তক্ষেপ দেখতে পায় না এবং কেন তারা বুঝতে পারে না এসব ঘটনায় অন্যদের হাত রয়েছে?
নৈতিকতা পুলিশের কার্যক্রম স্থগিত
ইরান তাদের নৈতিকতা পুলিশের কার্যক্রম স্থগিত করেছে। দেশটিতে প্রায় তিন মাস ধরে বিক্ষোভ চলার পর এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ইরানের নৈতিকতা পুলিশ, যা আনুষ্ঠানিকভাবে গাশত-ই এরশাদ বা ‘গাইডেন্স পেট্রোল’ নামে পরিচিত। দেশটির সাবেক কট্টরপন্থী প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদের আমলে ‘শালীনতা এবং হিজাবের সংস্কৃতি’ ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
বিক্ষোভকারীদের শাস্তি ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিক্রিয়া
মাহশা আমিনির মৃত্যুর প্রতিবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে ৪০০ জনকে ২ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে ইরানের বিচার বিভাগ।
তেহরানের বিচার বিভাগের প্রধান আলী আলঘাসি-মেহের বলেছেন, তেহরান প্রদেশে দাঙ্গাকারী ১৬০ জনকে ৫-১০ বছরের কারাদণ্ড, ৮০ জনকে ২-৫ বছর এবং ১৬০ জনকে ২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া বিক্ষোভে সহিংসতা ও হত্যার অভিযোগ এনে সর্বশেষ দু'জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে ইরান। এ নিয়ে বিভিন্ন দেশ নিন্দা প্রকাশ করেছে। এই দু'টি মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে ইরানের বিচার বিভাগ বলেছিল, তারা বিক্ষোভের কারণে ১১ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে।
এদিকে গত ১৬ সেপ্টেম্বর বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর হাজার হাজার মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে দাবি করেছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো। গত ৩ ডিসেম্বর ইরানের শীর্ষ নিরাপত্তা সংস্থা জানায়, এই অস্থিরতায় ২০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।
এ বিষয়ে নরওয়ে-ভিত্তিক ইরান হিউম্যান রাইটসের পরিচালক মাহমুদ আমিরি-মোগাদ্দাম টুইট করেছেন, ইরানের কর্তৃপক্ষ ‘আন্তর্জাতিকভাবে দ্রুত বাস্তব পরিণতির’ মুখোমুখি না হলে প্রতিদিন বিক্ষোভকারীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা শুরু হবে।
মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, ‘গণবিক্ষোভ দমন করতে’ এবং ‘জনগণের মধ্যে ভীতি সৃষ্টির’ লক্ষ্যে এসব মৃত্যুদণ্ডের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
এমইউ