আন্তর্জাতিক ডেস্ক
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৫:৩৮ পিএম
সমসাময়িক মুসলিম বিশ্বের প্রখ্যাত পণ্ডিত ড. ইউসুফ আবদুল্লাহ আল-কারজাবি ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তিনি ইসলামিক বিভিন্ন বিষয়ে বহু লেখা রেখে গেছেন যেগুলোর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী মুসলিমরা উপকৃত হচ্ছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর।
ইউসুফ আল-কারজাবির ইন্তেকালের খবর নিশ্চিত করেছে তার প্রতিষ্ঠিত মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিকদের অভিজাত সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ মুসলিম স্কলারস (আইইউএমএস)। রাষ্ট্রীয় নিগ্রহের শিকার হয়ে তিনি দীর্ঘদিন ধরে কাতারে নির্বাসনে ছিলেন।
আধুনিক উদ্ভূত নানা জটিল সমস্যার সাবলীল ও গভীর ইজতিহাদভিত্তিক সমাধানমূলক শতাধিক গবেষণা-গ্রন্থ রচনা করেছেন এই মুসলিম পণ্ডিত। তার গ্রন্থগুলো প্রকাশের পরপরই পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে জ্ঞানী, গবেষক, বোদ্ধামহল ও সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে।
আইইউএমএস তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে টুইটবার্তায় জানিয়েছে, 'মুসলিম জাতি তার সবচেয়ে আন্তরিক এবং গুণী স্কলারদের একজনকে হারিয়েছে।'
৯ সেপ্টেম্বর ১৯২৬ সালে মিশরের গারবিয়্যা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তবে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় তিনি কাতারে কাটিয়েছেন। সেখানেই তার মৃত্যু হয়।
ইউসুফ আল-কারজাবির বিভিন্ন লেখায় আধুনিক বিশ্বে মুসলিমদের অনেক সমস্যার সমাধান দেওয়া হয়েছে। তিনি ফিলিস্তিনিদের পাশে দৃঢ় অবস্থান নেন এবং পশ্চিমাদের নিন্দা করেন।
কাতার এবং সৌদি আরবের মধ্যে উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে তার জীবনের শেষভাগে কারজাবি শিয়াদের প্রতি তার অবস্থান নরম করেন এবং দুই চিন্তাধারার মানুষের মধ্যে বোঝাপড়ার আহ্বান জানান। বর্ণিল জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও জ্ঞান-গরিমা, গবেষণা-এষণা ও তথ্য এবং তত্ত্বের এই দেদীপ্যমান বাতিঘর সমহিমায় উজ্জ্বল ছিলেন তিনি।
বর্ণ্যাঢ্য জীবন
শায়খ কারাজাভির জন্ম ১৯২৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। মিশরের উত্তর নীলনদের তীরবর্তী সাফাত তোরাব গ্রামে। দুই বছর বয়সে বাবা ইন্তিকাল করলে চাচা তার লালন-পালন করেন। দশ বছর বয়সের আগেই তিনি সম্পূর্ণ কোরআন হিফজ করেন।
হিফজ সম্পন্ন করে আল-আজহার কারিকুলামে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনা করেন। উচ্চ মাধ্যমিকে জাতীয় মেধায় দ্বিতীয় হন। প্রাচীন ইসলামী বিদ্যাপীঠ আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উসুলুদ দ্বীন অনুষদ থেকে অনার্স, আরবি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা এবং পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
মিশরের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘Institute of Imams’ এর পরিদর্শক হিসেবে কর্মজীবনে পদার্পণ করেন। কিছুদিন তিনি আওকাফ মন্ত্রণালয়ের ‘Board of Religious Affairs’ এ কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৭ সালে তিনি কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শরীয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদের প্রতিষ্ঠাকালীন ডীন নিযুক্ত হন। ১৯৯০ পর্যন্ত তিনি এখানে কর্মরত থাকেন এবং একই বছর তার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘সীরাত ও সুন্নাহ গবেষণা কেন্দ্র’।
১৯৯০-৯১ সালে আলজেরিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের Scientific Council এর চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করেন। ১৯৯২ সালে কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সীরাত ও সুন্নাহ গবেষণা কেন্দ্রের ডিরেক্টর হিসেবে পুনরায় কাতার ফিরে আসেন।
শায়খ ইউসুফ কারজাবি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন একাডেমিক সংস্থার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি জর্ডানের রয়্যাল অ্যাকাডেমি ফর ইসলামিক কালচারাল অ্যান্ড রিচার্জ (Royal academy for Islamic culture and research), ইসলামি সম্মেলন সংস্থা (OIC), রাবেতা আল-আলম আল-ইসলামি এবং ইসলামিক স্টাডিজ সেন্টার, অক্সফোর্ড এর সম্মানিত সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি আয়ারল্যান্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর ফাতওয়া অ্যান্ড রিচার্জের (European Council For Fatwa and Research) প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
ইউসুফ কারজাবি ১৪১১ হিজরিতে ইসলামী অর্থনীতিতে অবদান রাখায় ব্যাংক ফয়সল পুরষ্কার লাভ করেন। ইসলামি শিক্ষায় অবদানের জন্য ১৪১৩ হিজরিতে মুসলিম বিশ্বের নোবেল খ্যাত কিং ফয়সাল অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।
১৯৯৭ সালে ব্রুনাই সরকার তাকে ‘হাসান বাকলি’ পুরষ্কারে ভূষিত করে। এছাড়াও তার বৈচিত্র্যময় পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি নানা পদক ও সম্মাননায় ভূষিত হন।
বাংলায় অনুদিত হওয়া তার বইয়ের মধ্যে রয়েছে- সুন্নাহর সান্নিধ্যে, ইসলামী পুনর্জাগরণ: সমস্যা ও সম্ভাবনা, ইসলামে হালাল হারামের বিধান, ঈমান ও সুখ, বুদ্ধিদীপ্ত জাগরণের প্রত্যাশায়, ইসলামের বিজয় অবশ্যম্ভাবী, আধুনিক যুগ ইসলাম কৌশল ও কর্মসূচী, ইসলাম ও চরমপন্থা, ইসলাম ও শিল্পকলা, ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থাঃ তত্ত্ব ও প্রয়োগ, ইসলামে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, ইসলামে এবাদতের পরিধি, ইসলামে দারিদ্র বিমোচন, ইসলামের যাকাতের বিধান ১ম ও ২য় খণ্ড, জেরুজালেম বিশ্ব মুসলিম সমস্যা, ইসলাম ও মানবিক মূল্যবোধ, (আমাদের দাওয়াত) জীবনবিধান ও ইসলাম, মানুষ মর্যাদা ও সৃষ্টির উদ্দেশ্য, উমর ইবনে আবদুল আজিজ, আলিম ও স্বৈরশাসক, ইমাম হাসান আল বান্না, ইসলামের ব্যাপকতা, তাকফির: কাফির ঘোষণায় বাড়াবাড়ি ও মূলনীতি, ইমাম বান্নার পাঠশালা, অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে যাকাতের ভূমিকা ইত্যাদি।
সূত্র: মিডলইস্ট আই, আল আরাবিয়্যাহ, উইকিপিডিয়া
একে