images

আন্তর্জাতিক

শিনজো আবেকে কীভাবে মনে রাখবেন জাপানিরা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

০৮ জুলাই ২০২২, ০৯:১৭ পিএম

শিনজো আবে জাপানের সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি আক্রমণাত্মক পররাষ্ট্র নীতি ও বিশেষ ধরনের অর্থনীতি প্রচলন করার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তার এমন অর্থনৈতিক নীতি অ্যাবেনোমিক্স নামে পরিচিত ও জনপ্রিয় ছিলো। অধিকাংশ জাপানির মতে তিনি একজন রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদী ছিলেন। ৬৭ বছর বয়সী আবে তার রাজনৈতিক দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টিকে (এলডিপি) দু’বার বিজয়ী করেছেন।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার প্রথম কার্যকাল সংক্ষিপ্ত ছিল। ২০০৬ সালে তিনি প্রথমবারের মতো জাপানের প্রধানমন্ত্রী হন। ওই সময় এক বছরের কিছু বেশি সময় ধরে দেশটিতে তার শাসন চলেছিল। তার এ এক বছরের শাসনামল ছিলো বিতর্কিত। কিন্তু, ২০১২ সালে তিনি সবাইকে বিস্মিত করে আবার ক্ষমতায় এসেছিলেন। এরপর তিনি টানা আট বছর ক্ষমতায় থেকে পরে ২০২০ সালে স্বাস্থ্যগত কারণে পদত্যাগ করেন।

তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে যখন ক্ষমতায় আসেন তখন জাপান একটি মন্দার মধ্যে ছিলো। এ সময় তার অর্থনৈতিক নীতির কারণে জাপানি অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি হয়। তিনি মুদ্রা ব্যবস্থা সহজ করা, রাজস্ব উদ্দীপনা এবং কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে দেশটির অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেন।

তিনি ২০১১ সালে তোহোকুতে একটি বিশাল ভূমিকম্প ও সুনামি থেকে জাপানের পুনরুদ্ধারের তত্ত্বাবধান করেছিলেন। ওই দুর্যোগে প্রায় ২০ হাজার লোক নিহত হয়েছিলেন এবং এ কারণে ফুকুশিমার পারমাণবিক চুল্লিগুলো গলতে শুরু করে।

কয়েক সপ্তাহের জল্পনা-কল্পনার পরে তিনি ২০২০ সালে পদত্যাগ করেন। এ সময় তিনি আলসারেটিভ কোলাইটিস রোগে আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানান। অন্ত্রের রোগে ২০০৭ সালেও তিনি পদত্যাগের করেছিলেন। ওই সময় তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন ঘনিষ্ঠ দলীয় মিত্র ইয়োশিহিদে সুগা। কিন্তু, তারপরও তাকে জাপানের রাজনীতিতে একজন শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে দেখা হয়।

ক্ষমতার চূড়ায় গেলেন আবে

শিনজো আবের বাবা ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিনতারো আবে। তার নানা অর্থাৎ মাতামহ ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী নবুসুকে কিশি। সুতরাং জাপানের একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারে ছিল তার জন্ম এবং বড় হওয়া।

জাপানের পার্লামেন্টে তিনি প্রথম নির্বাচিত হন ১৯৯৩ সালে। পরে ২০০৫ সালে মন্ত্রিসভার সদস্য হন যখন তৎকালীন প্রধনমন্ত্রী জুনিচিরো কোইজুমি তাকে প্রধান কেবিনেট সচিব পদে নিয়োগ দেন।

পরের বছরই অর্থাৎ ২০০৬ সালে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের সবচেয়ে কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে চমকে দিয়েছিলেন।

কিন্তু ক্ষমতা নেয়ার পরপরই বিশাল সংখ্যায় পেনশন রেকর্ড নষ্ট হয়ে যাওয়ার মত বেশ কিছু স্পর্শকাতর কেলেঙ্কারির মধ্যে পড়ে যায় তার সরকার। তার জেরে ২০০৭ সালের জুলাইতে পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের নির্বাচনে বড় ধরণের পরাজয় হয় ক্ষমতাসীন এলডিপির। সেপ্টেম্বরে 'আলসারেটিভ কলিটিস' রোগে আক্রান্ত হওয়ার কথা জানিয়ে পদত্যাগ করেন শিনজো আবে।

কিন্তু ২০১২ সালে তিনি ঘোষণা দেন তিনি সেরে উঠেছেন এবং আবারও প্রধানমন্ত্রী পদে ফিরে আসেন।

পরে ২০১৪ সালে ও ২০১৭ সালে তিনি পুনঃনির্বাচিত হন। হয়ে ওঠেন জাপানের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী প্রধানমন্ত্রী।

যদিও তার জনপ্রিয়তার পারদ ওঠা-নামা করেছে। কিন্তু এলডিপিতে তার একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে ক্ষমতা ধরে রাখতে তেমন কোনো বড় চ্যালেঞ্জ তাকে মোকবেলা করতে হয়নি। তৃতীয় দফাতেও যেন তিনি এলডিপির নেতা হতে পারে সেজন্য দলের নীতি পর্যন্ত পরিবর্তন করা হয়েছিল।

একজন কট্টর জাতীয়তাবাদী

একটি আক্রমণাত্মক পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতির সূচনা করেন আবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান সংবিধানিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয় তারা কোনো যুদ্ধ-বিগ্রহ করবে না। ক্ষমতায় এসে আবে ওই সংবিধান সংশোধন করতে উদ্যোগ নেন। যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র জাপানের ওই সংবিধানের খসড়া করে দিয়েছিল। ফলে দেশটির রক্ষণশীলদের কাছে ওই সংবিধান ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের লজ্জাজনক পরাজয়ের একটি প্রতীক।

আবের এ কট্টর জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার কারণে চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে জাপানের সম্পর্কে খারাপ হয়। বিশেষ করে ২০১৩ সালে আবে টোকিওর বিতর্কিত ইয়োসুকুনি মন্দিরে গেলে তা নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। ওই মন্দিরকে জাপানের সামরিক আধিপত্যবাদের ইতিহাসের একটি প্রতীক হিসেবে দেখা হয়।

একবার নয় আবে বারবার ওই মন্দিরে গেছেন। যা নিয়ে জাপানের বাম ধরার দলগুলো পর্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা বলতে শুরু করে আবে যুদ্ধের সময় জাপানি নৃশংসতার ইতিহাস অস্বীকার করতে চাইছেন। ২০১৫ সালে তিনি জাপানের 'যৌথ আত্মরক্ষার অধিকারের' নীতি নেওয়ার জন্য চেষ্টা শুরু করেন যাতে জাপান তার নিজের ও মিত্রদের প্রতিরক্ষায় দেশের বাইরে সৈন্য পাঠাতে পারে।

প্রতিবেশী দেশগুলোর আপত্তি এবং দেশের মধ্যে বহু মানুষের আপত্তি সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবিত নতুন ওই বিতর্কিত প্রতিরক্ষা নীতি পার্লামেন্টে পাশ হয়ে যায়।

তবে জাপানের সামরিক বাহিনীকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সংবিধান পরিবর্তনে তার ইচ্ছা অপূর্ণ রয়ে যায়।

হোক্কাইডো উপকূলের কাছে কিছু দ্বীপের মালিকানা নিয়ে রাশিয়ার সাথে জাপানের বহু দিন ধরে মতবিরোধ চলছে। সেগুলো নিয়ন্ত্রণে আসার যে সংকল্প তার ছিল, তাও পূরণ হয়নি।

করোনা মোকাবেলা ও জাপানের অর্থনীতি

২০১২ সালের পর ক্ষমতার প্রথম মেয়াদে যে অর্থনৈতিক নীতি আবে নিয়েছিলেন - যা আবেনোমিক্স নামে পরিচিত পেয়েছিল - তা বেশ প্রশংসা পেয়েছিল। বলা হয়, তিনিই ওই সময় জাপানকে মন্দা থেকে উদ্ধার করেছিলেন।

সুদের হার কমিয়ে দিয়ে সাধারণ ভোক্তাদের ও কোম্পানিগুলোকে সস্তায় ঋণ নেওয়ার সুবিধা করে দেয়া হয়। সরকার নিজে বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরিতে ব্যায় বাড়িয়ে দিয়েছিল। ব্যবসায় কর ছাড় দেয়া হয়। শ্রমবাজারে বিভিন্ন সংস্কার এনে তিনি নারীদের চাকরির সুবিধা বাড়িয়ে দেন। একইসাথে, বিদেশী শ্রমিক নিয়োগ প্রক্রিয়া সহজ করে দেন। এসবের লক্ষ্য ছিলো - উৎপাদন ও ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে অর্থনীতিতে যেন প্রবৃদ্ধি ফিরে আসে।

কিন্তু ২০২০ সালে জাপান আবারও মন্দার কবলে পড়ে যায়। ফলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে আবের অর্থনৈতিক নীতি আসলে কতটা টেকসই।

করোনা মহামারি সমালানোর ক্ষেত্রেও তার সরকারের ভুমিকা নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন ওঠে এবং তার জনপ্রিয়তায় ধস নামে। সমালোচনা শুরু হয়, অভ্যন্তরীন পর্যটন বাড়াতে গিয়ে সংক্রমণ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সমালোচকরা বলেন, নারীদের শ্রমবাজারের নিয়ে আসা বা স্বজনপ্রীতি কমাতে যেসব বব্যস্থা আবে নিয়েছিলেন তাতে তেমন কাজ হয়নি।

তবে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দু’প্রান্তের দেশগুলোর মধ্যে ব্যবসা বাড়াতে ১১টি দেশের একটি জোট থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকাকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর যেভাবে আবে জোটটিকে ধরে রেখেছিলেন, সেজন্য দেশের বাইরে তিনি অনেক প্রশংসিত হন।

পদত্যাগ
 
গত বছর ২৮শে আগস্ট যখন আবে পদত্যাগ করেন তখন তার দলের মধ্যে প্রচণ্ড কোন্দল শুরু হয়ে যায়। কারণ, তিনি নিজে কাউকে উত্তরসূরি হিসেবে পছন্দ করে যাননি। তবে তার জায়গা নেন অভিজ্ঞ রাজনীতিক ও মন্ত্রীসভার সদস্য ইয়োশিহিদে সুগা। পরে সুগাকে সরিয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা ক্ষমতা নিলেও জাপানের অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে আবের প্রভাব অব্যাহত থাকে।

মৃত্যু

সকালে পশ্চিম জাপানের নারা শহরে একটি নির্বাচনী জনসভায় বক্তব্য দেওয়ার সময় শিনজো আবের ওপর গুলি চালায় এক আততায়ী। পরে তাকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায়ই তিনি মারা যান।

নারা শহরের স্থানীয় দমকল বিভাগ জানায়, সময় সাড়ে ১১টায় নারা শহরের ইয়ামাতোসাইদাইজি স্টেশনের কাছে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণার জন্য বক্তৃতা করছিলেন শিনজো আবে। এ সময় দু’টি গুলির শব্দের পর মাটিতে লুটিয়ে পড়েন আবে। তার দেহ থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল বলে জানিয়েছে দমকল বিভাগ।

সাবেক জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেকে যে ব্যক্তি গুলি চালিয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে তাকে শনাক্ত করেছে জাপানি গণমাধ্যমগুলো। আবের হত্যাকারী হলেন নারা শহরের বাসিন্দা তেতসুয়া ইয়ামাগামি (৪১)। তিনি জাপানের নৌ-বাহিনীর মেরিটাইম সেলফ-ডিফেন্স ফোর্সের সাবেক সদস্য বলে জানা গেছে। কিন্তু, জাপানি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি নিশ্চিত করেনি।

দেশটির সরকারি টিভি এনএইচকে তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, জাপানি পুলিশকে ইয়ামাগামি বলেছেন যে তিনি আবের প্রতি অসন্তুষ্ট। এ কারণে তিনি তাকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন।

এখন আবে হত্যাকাণ্ডে জড়িত এ ব্যক্তি পুলিশের হেফাজতে আছেন।

এ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, তারা দেখেছেন যে এক ব্যক্তি বড় একটি বন্দুক বহন করছে এবং আবেকে পিছন থেকে দু’বার গুলি করছে।

সূত্র : বিবিসি

এমইউ