images

আন্তর্জাতিক

প্রতিরক্ষায় সৌদি-পাকিস্তানের ‘এক আত্মা’, বদলাবে আঞ্চলিক হিসাব-নিকাশ?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:৪২ এএম

সাম্প্রতিক এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপে, পাকিস্তান ও সৌদি আরব কৌশলগত প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। বুধবার, সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের উপস্থিতিতে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। ‘কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি’ নামে পরিচিত এই সমঝোতাকে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের সামরিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কের নতুন অধ্যায় হিসেবে দেখা হচ্ছে।

চুক্তি স্বাক্ষরের সময় প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফকে সৌদি রাজপরিবারের পক্ষ থেকে পূর্ণ রাজকীয় প্রটোকল দেওয়া হয়। রিয়াদে পৌঁছানোর পর তাকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয় এবং আকাশে সৌদি এফ-১৫ যুদ্ধবিমান দিয়ে সালাম জানানো হয়। রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে তাকে অভ্যর্থনা জানানো হয়— আল-ইয়ামামাহ প্রাসাদে, যেখানে সৌদি সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।

বিশ্লেষকদের মতে, এই চুক্তি শুধু সামরিক সহযোগিতার নয়, বরং এটি মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তা সংকটের প্রেক্ষাপটে একটি কৌশলগত বার্তা বহন করে। চুক্তির আওতায় বলা হয়েছে, কোনো একটি দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসন ঘটলে, তা উভয় দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসন হিসেবে বিবেচিত হবে। অর্থাৎ একে অপরের বিরুদ্ধে হামলার প্রতিক্রিয়ায় যৌথ প্রতিরোধ গড়ে তোলার বিষয়টি চুক্তিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে।

চুক্তিটি এমন সময় স্বাক্ষরিত হয়েছে, যখন পুরো অঞ্চলজুড়ে অস্থিরতা বিরাজ করছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের গাজা অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি সংঘাত চলছে। সম্প্রতি কাতারের রাজধানী দোহায় ইসরায়েল হামলা চালায়, যেখানে হামাস নেতাদের টার্গেট করা হয়। কাতারে অবস্থিত মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের (সেন্টকম) ঘাঁটির কাছাকাছিই এই হামলা সংঘটিত হয়। এর আগে, ইসরায়েল ইরানেও হামলা চালিয়েছে, যার জবাবে দুই দেশের মধ্যে ১২ দিনের একটি উত্তেজনাকর সংঘাত ঘটে।

একই সময় দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কও মারাত্মকভাবে অবনতি হয়েছে। গত মে মাসে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কয়েক দিনের সামরিক সংঘাত হয়। একে অপরের সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালানো হয়। এতে দুই দেশের সম্পর্ক ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে উত্তপ্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়। পরে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।

এই অবস্থার মধ্যে পাকিস্তানের সৌদি আরবের সঙ্গে একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা চুক্তিতে উপনীত হওয়া কেবল প্রতিরক্ষা বা সামরিক প্রস্তুতির বিষয় নয়, বরং এটি এক ধরনের কূটনৈতিক অবস্থান পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা হিসেবেও দেখা হচ্ছে। চুক্তির ফলে দুই দেশের মধ্যে যৌথ সামরিক প্রশিক্ষণ, অস্ত্র উৎপাদনে সহযোগিতা, প্রতিরক্ষা শিল্পে বিনিয়োগ এবং সেনা মোতায়েনের মতো বিষয়গুলোতে সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। ইতোমধ্যেই পাকিস্তান ৮ হাজারের বেশি সৌদি সেনাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে এবং অতীতে বিভিন্ন সময়ে সৌদি আরবে পাকিস্তানি সেনা মোতায়েন ছিল।

চুক্তির বাস্তবায়ন হলে পাকিস্তানের সামরিক উপস্থিতি সৌদি আরব ও উপসাগরীয় অঞ্চলে আরও বাড়তে পারে। এতে উপসাগরীয় নিরাপত্তা কাঠামোয় পাকিস্তান একটি কার্যকর অংশীদার হয়ে উঠবে। বিশেষ করে, উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (GCC) সদস্য দেশগুলো ইতোমধ্যে যৌথ প্রতিরক্ষা উদ্যোগের কথা বলেছে। ইসরায়েলের আক্রমণাত্মক নীতির প্রেক্ষাপটে এসব দেশ নিজেদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যাস করতে চাইছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই প্রতিরক্ষা চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হবে। কারণ, পাকিস্তানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র অতীতে একাধিকবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং ২০২১ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে একাধিক নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করেছে। ফলে পাকিস্তান-সৌদি ঘনিষ্ঠতা যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক কৌশলে নতুন প্রশ্ন তুলতে পারে।

এছাড়া, চুক্তির সময় ও প্রেক্ষাপটের কারণে অনেকেই এটিকে সৌদি আরবের সম্ভাব্য ‘পারমাণবিক ছাতা’র সঙ্গে সম্পর্কিত করে দেখতে শুরু করেছেন। যদিও চুক্তিতে সরাসরি পারমাণবিক সহযোগিতার কোনো কথা বলা হয়নি, তবুও অতীতে সৌদি যুবরাজের মন্তব্য, ‘আমার যদি বোমা দরকার হয়, পাকিস্তান থেকে কিনে নেব’—এই ধারণাকে উস্কে দেয়। তবে পাকিস্তান কখনোই নিজস্ব পরমাণু শক্তিকে অন্য কোনো দেশের জন্য সুরক্ষা চাদর হিসেবে ব্যবহারের ঘোষণা দেয়নি।

অন্যদিকে ভারতও এই চুক্তির বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, তারা এই চুক্তি পর্যবেক্ষণ করছেন এবং এর আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রভাব বিশ্লেষণ করবেন। ভারতের উদ্বেগের জায়গাটি এই যে, পাকিস্তান যদি সৌদি আরবের কৌশলগত অংশীদারে পরিণত হয়, তবে এটি দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা ভারসাম্যে নতুন চ্যালেঞ্জ আনবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সৌদি আরবের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কও বেশ ঘনিষ্ঠ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একাধিকবার রিয়াদ সফর করেছেন এবং সৌদি বিনিয়োগও ভারতে বেড়েছে। ফলে পাকিস্তান-সৌদি এই নতুন সামরিক চুক্তি রিয়াদ-নয়াদিল্লি সম্পর্ককেও নতুনভাবে চিন্তা করতে বাধ্য করতে পারে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই চুক্তি মূলত রাজনৈতিক বার্তা বহন করে, যেখানে পাকিস্তান নিজের আঞ্চলিক গুরুত্ব আবারও প্রমাণ করতে চায়। পাশাপাশি, সৌদি আরবও স্পষ্ট করছে যে, শুধু পশ্চিমা জোটের ওপর নির্ভর করে তারা চলতে চায় না। বরং মুসলিম বিশ্বের মধ্যেই সামরিক ও কৌশলগত বিকল্প জোট গড়ার পথ অনুসন্ধান করছে।

তবে বিশ্লেষকেরা সতর্ক করে বলছেন, এই ধরনের চুক্তি বাস্তবে কতটা কার্যকর হয়, তা নির্ভর করবে পরবর্তী পদক্ষেপ ও পারস্পরিক প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নের ওপর। এখনো এই চুক্তির অনেক দিক অস্পষ্ট। বিশেষ করে, যদি ভবিষ্যতে সৌদি আরব ইরানের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে কিংবা পাকিস্তান আবার ভারত বা তালেবান-শাসিত আফগানিস্তানের সঙ্গে সামরিক উত্তেজনায় পড়ে, তখন এই চুক্তির প্রয়োগ কেমন হবে, তা-ই হবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

তবে এটুকু স্পষ্ট, পাকিস্তান-সৌদি এই প্রতিরক্ষা চুক্তি বর্তমান ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যা শুধু দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নয়, বরং পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক ভারসাম্যে নতুন মাত্রা যোগ করবে। সূত্র: আল জাজিরা

এইউ