images

আন্তর্জাতিক

আজ পাকিস্তানের ৭৮তম স্বাধীনতা দিবস

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

১৪ আগস্ট ২০২৫, ১২:১৩ পিএম

আজ ১৪ আগস্ট। পাকিস্তানের ৭৮তম স্বাধীনতা দিবস। ১৯৪৭ সালের এই দিনে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম নেয় পাকিস্তান। তবে এই রাষ্ট্র গঠনের পেছনের ইতিহাস কেবল ধর্মভিত্তিক বিভাজনের নয়। বরং তা ছিল দীর্ঘ রাজনৈতিক লড়াই, সাংস্কৃতিক ভিন্নতা এবং পৃথক জাতিসত্ত্বার এক গভীর অধ্যায়। সময়ের স্রোতে যার অনেকটাই বিবর্ণ হয়ে গেছে।

পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের অন্যতম ভিত্তি ছিল ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব। এই প্রস্তাবেই প্রথম মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের দাবি ওঠে। মুসলিম লীগের সেই সম্মেলনে প্রস্তাবটি পেশ করেছিলেন বাংলার সূর্য সন্তান শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক। তখন তিনি ছিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। ইতিহাসে যেটিকে লাহোর প্রস্তাব বলা হয়, সেটির আসল রূপ দাঁড়ায় মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র চাওয়া। এটিই পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।

আয়েশা জালালের লেখা ‘দ্যা সোল স্পোকম্যান’ বইয়ে উল্লেখ করা হয়, সেই প্রস্তাব উত্থাপনের পরপরই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শুরু হয় তীব্র বিতর্ক। হিন্দু নেতারা একে ভারতবিভাজনের ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করেন। কংগ্রেস নেতৃত্ব এটিকে প্রত্যাখ্যান করেন। তারা মনে করেছিলেন, ভারত একটি অভিন্ন ভূখণ্ড। এখানে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের কোনো জায়গা নেই।

এদিকে মুসলিম লীগের ভেতরেও সবাই একমত ছিলেন না। বিশেষ করে বাংলার অনেক মুসলমান, যারা স্থানীয় সংস্কৃতি, ভাষা ও স্বদেশিকতা নিয়ে ভাবতেন, তারা পাকিস্তান নামক ধারণাটিকে সন্দেহের চোখে দেখছিলেন। তাদের ভয় ছিল, এই রাষ্ট্রে বাঙালি মুসলমানদের স্থান কোথায় হবে? ভাষা ও সংস্কৃতি কি সেখানে টিকে থাকবে?

হুমায়ুন কবিরের লেখা ‘দ্যা বাঙালী মুসলিম অ্যান্ড দ্যা লীগ’ বইয়ে উল্লেখ করা হয়, তারপরও রাজনৈতিক বাস্তবতায় পাকিস্তান গঠনের আন্দোলন জোরদার হয়। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনেও মুসলিম লীগ বিপুলভাবে জয়লাভ করে। মুসলিম জনগণের বড় অংশ তখন বিশ্বাস করেছিল, পাকিস্তান মানেই হবে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জায়গা। সেই বিশ্বাস থেকে বাংলার বহু মানুষ পাকিস্তানের পক্ষে রায় দেন। বাঙালি মুসলমানদের এই সমর্থন পাকিস্তান আন্দোলনের জন্য ছিল বড় শক্তি।

বাংলা পিডিয়ার তথ্যমতে, ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগের সময় বাঙালিদের সামনে আসে আরেকটি কঠিন সত্য—বেঙ্গল বিভক্তির প্রশ্ন। বাংলা, যেটি ছিল একটি ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগতভাবে অভিন্ন প্রদেশ, সেটিকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পূর্ববঙ্গ হয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাই তা পাকিস্তানের অংশ হয়। আর হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গ ভারতের সঙ্গে যায়।

আরও পড়ুন

পাকিস্তানে শূন্যে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়ে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন, নিহত ৩

এই বিভাজনের বিরোধিতা করেছিলেন বহু বাঙালি, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে। তারা চেয়েছিলেন একতাবদ্ধ বাংলা। অনেক মুসলিম বুদ্ধিজীবীও সেই সময় বলেছিলেন, ধর্ম নয়, ভাষা ও সংস্কৃতি হোক বাঙালির পরিচয়। তারা পাকিস্তানের অংশ হতে চাননি। এমনকি একটি ‘স্বাধীন অবিভক্ত বাংলা রাষ্ট্র’-এর কথাও আলোচিত হয়েছিল তখন।

কিন্তু সেই সব প্রচেষ্টা হারিয়ে যায় বড় রাজনীতির চাপে। ব্রিটিশদের বিদায় এবং ভারত-পাকিস্তান বিভাজন ত্বরান্বিত করতে গিয়ে বাংলা আর পাঞ্জাব—দুই ঐতিহাসিক প্রদেশই ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে জন্ম নেয় পাকিস্তান। যার পূর্ব অংশ হয় আজকের বাংলাদেশ।

বশীরউদ্দিন মাহমুদের লেখা ‘পাকিস্তান: দ্য ফর্মেটিভ ফেইজ’ বইয়ে উল্লেখ করা হয়, ১৪ আগস্ট, পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ হন দেশের প্রথম গভর্নর জেনারেল। মুসলিমদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনের যে স্বপ্ন নিয়ে লাহোর চুক্তি হয়েছিল, তার রূপায়ণ হয় এই দিন। কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য বাস্তুচ্যুতি, দাঙ্গা, মৃত্যু আর দীর্ঘশ্বাসের এক অধ্যায়।

পূর্ববঙ্গ থেকে বহু হিন্দু পরিবার পশ্চিমবঙ্গে চলে যেতে বাধ্য হন। একইভাবে পশ্চিমবঙ্গ থেকেও বহু মুসলমান পালিয়ে যান পূর্ব পাকিস্তানে। এই সময়ে লাখ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়ে ওঠে। পরিবার ভেঙে যায়, সম্পদ হারায়, স্বজন হারায় অসংখ্য মানুষ। বাংলার মানচিত্র বদলে যায়। শুধু মানচিত্র নয়, বদলে যায় মানুষের মন, বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও রাজনীতি।

পাকিস্তান গঠনের সময়ই বোঝা যাচ্ছিল, এই রাষ্ট্র দুটি ভিন্ন সংস্কৃতি নিয়ে গঠিত। পশ্চিম পাকিস্তান ছিল উর্দুভাষী, পাঞ্জাবি নেতৃত্বাধীন; আর পূর্ব পাকিস্তান ছিল বাংলাভাষী, সাংস্কৃতিকভাবে আলাদা। এই বিভাজন দ্রুতই রাজনৈতিক সংকটে রূপ নেয়। বাঙালিরা বুঝতে পারেন, তাদের যে স্বপ্ন দেখিয়ে পাকিস্তানে টেনে আনা হয়েছিল, বাস্তবে সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে যাচ্ছে।

লাহোর চুক্তিতে যে বাঙালি নেতৃত্ব দিয়েছিল, পাকিস্তান রাষ্ট্রব্যবস্থায় তাদের জায়গা আর তৈরি হয়নি। উল্টো তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে শুরু হয় দমন-পীড়ন। এর সূত্র ধরেই শুরু হয় ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ।

আজ যখন পাকিস্তান তাদের স্বাধীনতা দিবস পালন করে, তখন অনেকেই ভুলে যায় সেই চুক্তির ভাষা কে লিখেছিল, কারা প্রথম ‘আলাদা রাষ্ট্র’-এর চিন্তা বাস্তবে রূপ দিয়েছিল। বাঙালি সেই ইতিহাসে ছিল চালকের আসনে, কিন্তু পরবর্তী ইতিহাসে সে স্থান ছিল প্রান্তিক। সূত্র: দ্যা ডন 

এইউ