images

আন্তর্জাতিক

ক্লাউডবার্স্ট বা মেঘভাঙা বৃষ্টি আসলে কী এবং কেন হয়?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

০৬ আগস্ট ২০২৫, ০৬:১১ পিএম

মেঘভাঙা বৃষ্টি এবং অকস্মাৎ বন্যার জেরে বিদ্ধস্ত ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের উত্তরকাশী। তীব্র বেগে ধেয়ে আসা ক্ষীরগঙ্গা নদীর জল এবং সঙ্গে বয়ে আসা বড় পাথর আর কাদার স্রোতের প্রভাবে কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে উত্তরকাশীর ধরালি গ্রামের বিস্তীর্ণ অংশ। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে হর্ষিল উপত্যকা সংলগ্ন অঞ্চলে।

মঙ্গলবার (০৫ আগস্ট) এই ভয়াবহ ঘটনার এক ঝলক মোবাইল ক্যামেরায় বন্দি করেছিলেন প্রত্যক্ষদর্শীদের কেউ কেউ। মুহূর্তে সামিাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সেই দৃশ্য।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গ্রামের বহু বাড়ি, হোটেল এবং হোমস্টে ওই ফ্ল্যাশ ফ্লাড বা আকস্মিক বন্যায় ভেসে গেছে।

জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত চারজনের মৃত্যু হয়েছে, বহু মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন। মৃতদের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। সেনাবাহিনী, ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্স (এনডিআরএফ), স্টেট ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্স (এসডিআরএফ), জেলা প্রশাসনের তরফে দ্রুত উদ্ধারের কাজ শুরু করা হয়েছে।

জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, গত কয়েদিন ধরেই উত্তরাখণ্ডে বৃষ্টিপাত হচ্ছিল। তারই মাঝে মঙ্গলবার মেঘভাঙা বৃষ্টি দেখা দেয়, যার জেরে এই বিপর্যয়।

প্রশ্ন আসতে পারে, ক্লাউডবার্স্ট বা মেঘভাঙা বৃষ্টি আসলে কী এবং কেন এটা হয়?

মেঘভাঙা বৃষ্টি কী?

আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, কোনো ছোট এলাকায় (এক থেকে দশ কিলোমিটার বিস্তৃত) এক ঘণ্টায় ১০ সেন্টিমিটার বা তার বেশি বৃষ্টিপাত হলে সেই ঘটনাকে ক্লাউডবার্স্ট বা মেঘ ভাঙা বলে চিহ্নিত করা হয়।

ক্লাউডবার্স্ট-এর কারণে অতি ভারী বৃষ্টি দেখা যায়। তবে এর সঙ্গে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পার্থক্য আছে। একটা ছোট্ট এলাকায় মেঘ হঠাৎ ঘনীভূত হওয়ার কারণে মেঘভাঙা বৃষ্টি দেখা দেয়। এর তীব্রতা এবং প্রভাব স্বাভাবিক অবস্থায় ভারী বা অতিভারী বৃষ্টির চাইতে অনেক বেশি, ক্ষতি করার শক্তিও বেশি।

এই জাতীয় বৃষ্টির ফলে পার্বত্য অঞ্চলে প্রায়শই ফ্ল্যাশ ফ্লাড বা আকস্মিক বন্যা এবং ল্যান্ডস্লাইড বা ভূমিধস দেখা যায়। প্রাণনাশ এবং বড় আকারে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কাও রয়েছে। 

ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, মেঘভাঙা বৃষ্টির পূর্বাভাস দেওয়া অত্যন্ত কঠিন বিশেষত উত্তরাখণ্ডের মতো পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষেত্রে। কখনো কখনো এক জায়গায় একাধিক মেঘ ভাঙার ঘটনাও ঘটতে পারে, যেমনটা ২০১৩ সালে উত্তরাখণ্ডে হয়েছিল।

প্রসঙ্গত, এক ঘণ্টায় ১০ সেন্টিমিটার ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে খুব বেশি ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। তবে ওই এলাকায় যদি আগে থেকেই যদি কোনো নদী বা লেক থাকে এবং সেখানে ইতোমধ্যে জলের পরিমাণ বেশি থাকে তাহলে আশপাশের আবাসিক এলাকায় ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি হয়।

কারণ কী?

আবহাওয়াবিদদের মতে, উষ্ণ বায়ু ঠান্ডা বায়ুর সংস্পর্শে এলে ঘন মেঘের সৃষ্টি হয়। উষ্ণ বাতাস ওপরের দিকে উঠতে থাকার কারণে মেঘে সঞ্চিত জলকণা বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়তে পারে না। বৃষ্টির জলকণাকেও ক্রমে শুষে নিয়ে ওপরে উঠতে থাকে গরম বাতাস।

নিচু অঞ্চল থেকে উচ্চ ভূখণ্ডের দিকে উঠতে থাকার এই প্রক্রিয়াকে 'অরোগ্রাফিক লিফ্ট' বলে। এক্ষেত্রে উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আপেক্ষিক আর্দ্রতাও পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে এবং মেঘ তৈরি হয়। ছোট অঞ্চলে বেশি পরিমাণে মেঘ ঘনীভূত থাকে এবং এক সময় সেই মেঘ আর জল ধরে রাখতে পারে না। তখন তীব্র গতিতে জল নেমে আসতে থাকে। এসময় ভারী থেকে অতি বৃষ্টি দেখা দেয়, যাকে ক্লাউডবার্স্ট বলে। আক্ষরিক অর্থে কোনো 'বিস্ফোরণ' হয় না।

পার্বত্য অঞ্চলে সময় এই ঘটনা ঘটলে জলের স্রোতের সঙ্গে পাহাড়ের বড় পাথর, কাদা জল নেমে এসে বিপর্যয়ের তীব্রতা বাড়ায়। আশপাশে নদী বা লেক থাকলেও বিপর্যয়ের ব্যাপক প্রভাব পড়ে। যেমনটা এর আগে উত্তরাখণ্ডে, সিকিমে ও লাদাখে দেখা গিয়েছিল।

আবহাওয়াবিদদের মতে, ভারতে মনসুন এবং প্রি-মনসুনে মেঘভাঙা বৃষ্টির প্রকোপ দেখা যায়। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে মেঘভাঙা বৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। সমতলেও মেঘভাঙা বৃষ্টি হতে পারে, তবে পার্বত্য অঞ্চলে এর সম্ভাবনা বেশি। কারণ পার্বত্য অঞ্চল 'অরোগ্রাফিক লিফ্ট'-এর জন্য অনুকূল।

আকৃতিগত কারণে পাহাড় বায়ুপ্রবাহের পথে বাধা হিসেবে কাজ করে। আর্দ্র বাতাসের পথে পার্বত্য অঞ্চল থাকলে বায়ু পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠতে বাধ্য হয়। পাশাপাশি বায়ু শীতল এবং ঘনীভূত হতেও সাহায্য করে।

বাতাস পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ওপরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে প্রসারিত এবং ঠান্ডা হয়। এর ফলে তার আর্দ্রতা ধরে রাখার ক্ষমতা হ্রাস পায়। একসময় তা মেঘে পরিণত হয় এবং ঘনীভূত হওয়ার পর অবশেষে বৃষ্টিপাত দেখা যায়।

পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব?

এক থেকে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে অঞ্চলে হঠাৎ আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে মেঘভাঙার ঘটনা দেখা যায়। এই কারণে আগাম পূর্বাভাস পাওয়া অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর রাডারের সাহায্যে বিস্তীর্ণ এলাকায় অতি ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিলেও কোন এলাকায় মেঘভাঙা বৃষ্টিপাত হবে তা অনুমান করা কঠিন। তবে এক্ষেত্রে পূর্বাভাসের জন্য যেসব অঞ্চলে মেঘভাঙার আশঙ্কা প্রবল, সেখানে ঘন রাডার নেটওয়ার্ক প্রয়োজন বা আবহাওয়ার পূর্বাভাসের অতি উচ্চ-রেজোল্যুশনযুক্ত মডেল প্রয়োজন যা ছোট মাত্রার ঘটনাকেও ক্যাপচার করতে পারে।

আবহাওয়াবিদদের মতে, এক্ষেত্রে ডপলার রাডার সহায়কের ভূমিকা পালন করতে পারে। ডপলার রাডার দূরবর্তী বস্তুর বেগ সম্পর্কে তথ্য দিতে পারে। কিন্ত হিমালয় সংলগ্ন অঞ্চলের সব জায়গায় এই রাডার নেই।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এমএইচআর