আন্তর্জাতিক ডেস্ক
১২ জুলাই ২০২৫, ০৪:৫৮ পিএম
গত মাসে ভারতে এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট ১৭১ বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনার প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে শনিবার। প্রকাশিত ১৫ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে।
ভারতের এয়ারক্রাফট অ্যাক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরোর (এএআইবি) প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, ওড়ার কয়েক সেকেন্ড পরেই ১২ বছরের পুরনো বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনারের ‘ফুয়েল-কন্ট্রোল সুইচ’ (জ্বালানি নিয়ন্ত্রক সুইচ) হঠাৎ হয়ে বন্ধ বা ‘কাট-অফ’ পজিশনে চলে যায় বা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যে কারণে বিমানের ইঞ্জিনে জ্বালানি একেবারেই পৌঁছেনি। সাধারণত বিমান ল্যান্ড করা বা অবতরণের পরেই ‘কাট-অফ’ পজিশনে এ সুইচ করা হয়।
ককপিটের ভয়েস রেকর্ডিং-এ শোনা গেছে, একজন পাইলট অন্যজনকে জিজ্ঞাসা করছেন ‘কেনো তিনি ওই সুইচ কাট-অফ করেছেন’। উত্তরে অপর পাইলট জানান, তিনি করেননি।
তবে রেকর্ডিংয়ে স্পষ্ট করে বলা হয়নি, কে কোন কথাটা বলেছেন। ওড়ার সময় কো-পাইলট বিমান চালাচ্ছিলেন এবং ক্যাপ্টেন পর্যবেক্ষণ করছিলেন।
সুইচগুলো তাদের স্বাভাবিক ‘ইনফ্লাইট’ অবস্থানে ফিরে এসেছিল। স্বয়ংক্রিয় ইঞ্জিন ‘রিলাইট’ ট্রিগার করেছিল। বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার সময় একটা ইঞ্জিন পুনরায় ‘থ্রাস্ট’ ফিরে পেলেও অন্যটায় ‘রিলিট’ হলেও তার কর্মক্ষমতা ফিরে পায়নি। এক্ষেত্রে ‘রিলিট’ বলতে বোঝায় কোনো কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বিমানের ইঞ্জিন পুনরায় চালু হওয়া।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট নম্বর ১৭১ আকাশে ৪০ সেকেন্ডেরও কম সময়ের জন্য উড়ানের পর আহমেদাবাদেরই একটা জনাকীর্ণ এলাকায় বিধ্বস্ত হয়। উদয়নের ঠিক পরপরই কী সমস্যা হয়ে থাকতে পারে, সে বিষয়ে জানতে ধ্বংসাবশেষ ও ককপিট রেকর্ডারে রেকর্ড হওয়া সমস্ত তথ্য খতিয়ে দেখেছেন তদন্তকারীরা।
এয়ার ইন্ডিয়ার ওই বিমান স্বাভাবিক আবহাওয়ায় ৬২৫ ফুট উপরে উঠে ৫০ সেকেন্ডের মধ্যে 'লোকেশন ডেটা' হারিয়ে ফেলে বলে 'ফ্লাইটর্যাডার২৪' থেকে জানা গিয়েছে।
ভারতীয় নিয়ন্ত্রকদের পাশাপাশি এই ঘটনার তদন্তে বোয়িং, জিই, এয়ার ইন্ডিয়া, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশানাল ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ড (জাতীয় পরিবহন সুরক্ষা বোর্ড) এবং যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞরাও অংশ নিয়েছেন। প্রকাশিত তদন্ত রিপোর্ট বেশ কয়েকটা প্রশ্ন তুলেছে।
তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, ‘লিভার-লক ফুয়েল সুইচগুলো’ এমনভাবে ডিজাইন করা যাতে দুর্ঘটনাবশত তাদের ‘অ্যাক্টিভেশন’ বা সক্রিয় হয়ে ওঠা রোধ করা যায়। এই সুইচ ‘ফ্লিপ'’করার আগে ‘আনলক’ করতে সেটা ধরে অবশ্যই টানতে হয়। সুরক্ষা সংক্রান্ত এই বৈশিষ্ট্য চালু করা হয়েছিল ১৯৫০ এর দশকে।
‘লিভার-লক ফুয়েল সুইচ’ সঠিক মানের কথা মাথায় রেখে নির্মিত এবং তা অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। যাতে ধাক্কা লেগে বা কোনোভাবে দুর্ঘটনাবশত তাদের নির্ধারিত অবস্থানের যাতে পরিবর্তন না হয়, তা নিশ্চিত করতে প্রতিরক্ষামূলক গার্ড বন্ধনীও রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কানাডা-ভিত্তিক এক বিমান দুর্ঘটনা তদন্ত কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, ‘একটা হাত দিয়ে একবারে দুটো সুইচ টানা প্রায় অসম্ভব এবং তাই সেটা দুর্ঘটনাবশত হয়ে থাকতে পারে সেই সম্ভাবনাও তৈরি হয় না।’
ঠিক এই বিষয়টাই এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনাটাকে অন্যান্য ঘটনা থেকে আলাদা করে তুলেছে।
সাবেক বিমান দুর্ঘটনা তদন্তকারী এবং ওহায়ও স্টেট ইউনিভার্সিটির বিশেষজ্ঞ শন প্রুচনিকি বলেন, ‘এটা একটাই প্রশ্ন উত্থাপন করে- কেন ওই পাইলট বা যে সে অর্থে কোনো পাইলটই আসলে সুইচগুলো অফ পজিশনে ঠেলে দেবেন?’
তিনি বলেন, ‘ইচ্ছাকৃত ছিল না কি এটা কোনো বিভ্রান্তির ফল? বিষয়টা অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে, কারণ পাইলটরা অস্বাভাবিক কিছু রিপোর্ট করেননি। অনেক ক্ষেত্রে ককপিটে জরুরি অবস্থায়, পাইলটরা ভুল বোতাম টিপতে বা ভুল নির্বাচন করতে পারেন। তবে এখানে সে জাতীয় পরিস্থিতির কোনও ইঙ্গিত ছিল না, বা ফুয়েল সুইচগুলো ভুলভাবে নির্বাচন করা হয়েছিল- এমন কোনো আলোচনারও হদিশ মেলেনি।’
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির সঙ্গে কথোপকথনের সময় প্রুচনিকি ব্যাখ্যা করেছেন, ‘সাধারণত কিছু স্পষ্ট সমস্যা ছাড়া এই ধরনের এরর (ভ্রান্তি) দেখা যায় না।’
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ডের সাবেক ম্যানেজিং ডিরেক্টর পিটার গোয়েলজও একই মত পোষণ করেন। তার কথায়, ‘একজন পাইলট বিমান ওড়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ফুয়েল সুইচ বন্ধ করে দিয়েছেন এমন তথ্য জানতে পারাটা খুবই বিচলিত করে। ককপিটের ভয়েস রেকর্ডারে থাকা যে তথ্য শেয়ার করা হয়েছে, তার চেয়ে বেশি কিছু থাকতে পারে। কেন সুইচ কাট অফ করে দিলেন-এর মতো এটা মন্তব্য কিন্তু এক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়।’
‘নতুন বিবরণ থেকে বোঝা যাচ্ছে ককপিটে উপস্থিত কেউ ওই ভালভগুলো বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কে করেছিলেন এবং কেন করেছিলেন? দুটো সুইচই বন্ধ করা হয়েছিল এবং তার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পুনরায় চালু হয়েছিল। ভয়েস রেকর্ডারে বন্দি তথ্য আরও অনেক কিছু প্রকাশ্যে আনবে- যিনি বিমান পরিচালনা করছিলেন, তিনিই কি ইঞ্জিনগুলো আবার চালু করার চেষ্টা করছিলেন, নাকি যিনি পর্যবেক্ষণ করছিলেন তিনি এমনটা করেছিলেন?’
ককপিট ভয়েস রেকর্ডারে পাইলট মাইক, রেডিও কল এবং অ্যাম্বিয়েন্ট ককপিটের সাউন্ড (ককপিটের পারিপার্শ্বিক শব্দ যার মাধ্যমে রেকর্ড হয়)-সহ সমস্ত অডিও থাকার কথা। তাই এটাই ধাঁধার মূল চাবিকাঠি বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা।
গোয়েলজ বলেন, ‘ওরা এখনো কণ্ঠস্বরগুলো শনাক্ত করতে পারেনি, যেটা হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত, যখন ভয়েস রেকর্ডারটা পর্যালোচনা করা হয়, তখন পাইলটদের কণ্ঠস্বর চেনেন, এমন ব্যক্তিদের সাহায্য নেওয়া হয়। এখনো পর্যন্ত আমরা জানি না কোন পাইলট সুইচ বন্ধ করে দিয়ে আবার চালু করেছিলেন।’
সংক্ষেপে বলতে গেলে তদন্তকারীরা মনে করেন এই মুহূর্তে যেটা জানা প্রয়োজন, সেটা হলো কণ্ঠস্বরকে স্পষ্টভাবে শনাক্ত করা, দুই পাইলটের মধ্যে কে কী বলেছেন তা চিহ্নিত করে ককপিটে হওয়া কথোপকথনের সম্পূর্ণ ককপিট ‘ট্রান্সক্রিপ্ট’ (কথোপকথনের পূর্ণ বিবরণ) এবং উদয়নের আগে থেকে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার সময় পর্যন্ত সমস্ত যোগাযোগ সংক্রান্ত তথ্যকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করা।
এই বিশেষজ্ঞরা আরও জানিয়েছেন, এই ঘটনা এনটিএসবির সুপারিশ অনুযায়ী ককপিট ভিডিও রেকর্ডারের প্রয়োজনীয়তার ওপরও জোর দেয়। সে ক্ষেত্রে ‘ওভার-দ্য-শোল্ডার ভিউ’ (ভিডিও রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে) থেকে জানা যেত, ‘কাট-অফ সুইচে’ কার হাত ছিল।
তদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফ্লাইট ১৭১-এ ওঠার আগে পাইলট ও ক্রু-র সকলেই ‘ব্রেথালাইজার’ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তারা সকলেই বিমান চালনার জন্য উপযোগী অবস্থায় ছিলেন। মুম্বাইয়ের পাইলটরা যাত্রার আগের দিন আহমেদাবাদে পৌঁছান এবং তারা পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিয়েছিলেন বলেও জানা গেছে। সূত্র: বিবিসি বাংলা
এমএইচআর