আন্তর্জাতিক ডেস্ক
০৩ এপ্রিল ২০২৫, ১২:২৩ পিএম
দীর্ঘ ১৩ ঘণ্টা বিতর্ক পর্বের পর বুধবার গভীর রাতে ভারতের লোকসভায় পাস হল সংশোধিত ওয়াকফ বিল। বিলের পক্ষে ২৮৮ এবং বিপক্ষে ২৩২ জন এমপি ভোট দিলেন।
ভোটের ব্যবধান ৫৬। মোট ভোট পড়েছে ৫২০টি। তেমন কোনো অশান্তি হয়নি অধিবেশনে। বৃহস্পতিবার (৩ এপ্রিল) বিলটি পেশ হবে রাজ্যসভায়।
বুধবার লোকসভায় বিল পেশের আগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় সরকারের অবস্থানের কথা জানান। এরপর কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজু ‘ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল, ২০২৫’ পেশ করেন।
বিল পেশের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তৃণমূল এমপি সৌগত রায়। তার অভিযোগ, জেপিসিতে ভিন্নমত প্রকাশ করে বিরোধী এমপিদের দেওয়া নোটগুলি উপেক্ষা করা হয়েছে বিলে।
বিরোধীরা বিল নিয়ে ভুল তথ্য এবং গুজব ছড়াচ্ছেন বলে বুধবার লোকসভায় অভিযোগ করেন রিজিজু। বিলের সমালোচনা যারা করছেন, তাদের রিজিজু বলেন- যখন আমরা কোনো ইতিবাচক সংস্কার আনছি, তখন কেন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে?
আলোচনা এবং সবার মতামত নেওয়ার জন্য যৌথ সংসদীয় কমিটি বা জেপিসিকে ধন্যবাদ জানান রিজিজু। তিনি বলেন, আমি জেপিসির সব সদস্যকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। ২৮৪টি প্রতিনিধি দল, ২৫টি রাজ্য, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল এবং ওয়াকফ বোর্ড এই বিষয়ে জেপিসির কাছে নিজেদের মতামত জানিয়েছে।
বিল পেশের পর পূর্বতন ইউপিএ সরকারকে আক্রমণ করে রিজিজু বলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রে মোদি ওয়াকফের হাতে সংসদ ভবনের অধিগ্রহণ আটকেছেন। ইউপিএ সরকার সংসদ এবং বিমানবন্দরের জমি ওয়াকফের হাতে তুলে দিয়েছিল।
তার দাবি, মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিশ্বাসে হস্তক্ষেপ করছে না সংশোধিত ওয়াকফ বিল। শুধুমাত্র ওয়াকফ সম্পত্তির যথাযথ দেখভাল এবং পিছিয়ে পড়া মুসলিমদের কল্যাণের উদ্দেশ্যেই ওয়াকফ আইন সংশোধনের এই উদ্যোগ।
তার মন্তব্য, আজ আমাদের দেশে মোট ওয়াকফ সম্পত্তির সংখ্যা ৪.৯ লাখ থেকে বেড়ে ৮.৭২ লাখ হয়েছে। যদি এই পরিমাণ ওয়াকফ সম্পত্তি সঠিক ভাবে পরিচালিত হত, তা হলে সেটি কেবল মুসলমানদের জীবনকেই উন্নত করত না, সমগ্র দেশের ভাগ্যকেও বদলে দিত...।
উত্তরপ্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী তথা সমাজবাদী পার্টির প্রধান অখিলেশ যাদব অভিযোগ করেন, মেরুকরণের উদ্দেশ্যেই সংশোধিত ওয়াকফ বিল এনেছে নরেন্দ্র মোদি সরকার।
আরও পড়ুন: ভারতে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে পাইলট নিহত
এ প্রসঙ্গে তার মন্তব্য, বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী, উপমুখ্যমন্ত্রী আগে ইদের উৎসবে যোগ দিতেন। হঠাৎ কী হল জানি না। আমাদের সংবিধান কি এই শিক্ষা দেয়!
তিনি আরও বলেন, যখনই বিজেপি কোনো বিল আনে, নিজেদের ব্যর্থতা চাপা দেওয়ার জন্য আনে। সেই ‘ব্যর্থতা’র উদাহরণ প্রসঙ্গে অখিলেশ বুধবার মোদি সরকারের নোটবন্দির প্রসঙ্গও তুললেন।
তার দাবি, একের পর এক ব্যর্থতা দিয়ে এই বিল তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে তার খোঁচা, বিজেপি শুধু একটি পুরনো ঘটনার কথাই ভাবে, অযোধ্যার কথা। আসামের কংগ্রেস এমপি গৌরব গগৈও ওয়াকফ বিল নিয়ে শাসক শিবিরের বিরুদ্ধে মেরুকরণের অভিযোগ তোলেন।
তার মন্তব্য, এই বিল সংবিধানকে অবজ্ঞা করতে চায়। মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে অপদস্থ করতে চায় এবং ভারতের সমাজকে বিভক্ত করতে চায়।
আরও পড়ুন: মিয়ানমারে ফের ভূমিকম্প, নিহত ছাড়াল ৩০০০
তৃণমূল এমপি কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বুধবারের বিতর্কে অংশ নিয়ে ওয়াকফ বিলকে সরাসরি ‘অসাংবিধানিক’ বলেছেন। তার মন্তব্য, আমি এই বিলকে একেবারেই সমর্থন করছি না। এই বিল অসাংবিধানিক। তৃণমূলের তরফে আমরা এই বিলের বিরোধিতা করছি।
তার অভিযোগ, বিজেপির আনা এই বিলে মুসলমানদের অধিকার খর্ব হচ্ছে। ওয়াকফ বিলের নেপথ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে। কল্যাণ বলেন, ‘ওয়াকফ সংশোধনী বিলের আড়ালে কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন সম্প্রদায়কে ভাগ করতে চাইছে। যদি ওরা একতাই চায়, তা হলে বিলে কেন ভাগের চেষ্টার কথা? সম্প্রদায়ের উপর ভিত্তি করে ওয়াকফ বোর্ডের মধ্যে শ্রেণিবিভাগ শাসকদলের খারাপ উদ্দেশ্যই ইঙ্গিত করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ওয়াকফ বিল হল সরকারি মাধ্যম দিয়ে ওয়াকফ সম্পত্তি দখলের একটি অপচেষ্টা। প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলি অযৌক্তিক। ওয়াকফ সম্পত্তি মুসলিম সম্প্রদায়ের মেরুদণ্ড।
কংগ্রেস, তৃণমূল, সমাজবাদী পার্টি, এনসিপি (শরদ), ডিএমকে, আরজেডির পাশাপাশি বুধবার লোকসভায় সংশোধিত ওয়াকফ বিলের বিরোধিতা করেছে ‘একদা হিন্দুত্ববাদী’ উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা (ইউবিটি)।
উদ্ধবসেনার এমপি অরবিন্দ সাবন্ত ওয়াকফ বোর্ডে দুই অমুসলিম সদস্য এবং ওয়াকফ ট্রাইব্যুনালে সিইও পদে আমলা নিয়োগের প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
তিনি বলেন, ‘সরকার কি মন্দির কমিটিতে মুসলিম বা অহিন্দুদের থাকার অনুমতি দেবে? কী কারণে তারা ওয়াকফ বোর্ডের কমিটিতে অমুসলিমদের স্থান দেওয়ার চেষ্টা করছে?
পাশাপাশি অরবিন্দের দাবি, জেপিসিতে প্রতিটি বিষয় ধরে ধরে আলোচনা হয়নি। বস্তুত, মঙ্গলবার সন্ধ্যার বৈঠকের সিদ্ধান্ত মেনেই ঐক্যবদ্ধ ভাবে লোকসভায় বিলের বিরোধিতা করেছে ‘ইন্ডিয়া’।
ওয়াকফ বিল বিতর্কে বুধবার লোকসভায় বিরোধীদের সমালোচনা করলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তিনি বলেন, এভাবে অন্যের জমি দান করে দেওয়া যায় না। দান একমাত্র নিজের জমিই করা যায়।
সংসদে একটি তালিকা হাতে নিয়ে শাহ জানালেন, কোন কোন জমি ওয়াকফকে দান করা হয়েছে। শাহের বক্তব্য, তার মধ্যে মন্দিরের জমি যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে অন্যান্য ধর্মীয় স্থান এবং সরকারের জমি।
এর পরেই বিরোধীদের বিরুদ্ধে তোপ দেগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, একজন মুসলিম তো চ্যারিটি কমিশনার হতেই পারেন। তাঁকে ট্রাস্ট দেখতে হবে না, আইন অনুযায়ী ট্রাস্ট কী ভাবে চলবে, সেটা দেখতে হবে। এটা ধর্মের কাজ নয়। এটা প্রশাসনিক কাজ। সব ট্রাস্টের জন্য কি আলাদা আলাদা কমিশনার থাকবে?
আপনারা তো দেশ ভাগ করে দিচ্ছেন। আমি মুসলিম ভাই-বোনদের স্পষ্ট ভাবে বলতে চাই, আপনাদের ওয়াকফ বোর্ডে কোনো অমুসলিম থাকবে না। এই আইনে এমন কিছু নেই।
২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের আমলে সংসদে কোনও বিতর্ক ছাড়াই ওয়াকফ সংশোধনী বিল পাশ হয়েছিল। ওই সংশোধনী নিয়ে বুধবার দিনভর বিজেপি এমপিদের সমালোচনা প্রসঙ্গে পাল্টা প্রশ্ন তুললেন হায়দরাবাদের এমপি তথা ‘অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন’ (মিম)-এর প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়েইসি।
তার প্রশ্ন- সে দিন এই সংসদে লালকৃষ্ণ আদভাণী হাজির ছিলেন। ছিলেন প্রয়াত সুষমা স্বরাজ। রাজনাথ সিংহজিও (প্রতিরক্ষামন্ত্রী) ২০১৩ সালের ওয়াকফ সংশোধনী বিল সর্বসম্মত ভাবে পাশ হওয়ার সময় সংসদে ছিলেন। আমার একটাই প্রশ্ন, আদভাণীজিরা কি সেদিন ভুল করে ছিলেন? কেন তারা বিনা আপত্তিতে বিল পাশ হতে দিয়েছিলেন?
আসাদউদ্দিনের অভিযোগ, মোদি সরকারের ওয়াকফ বিলের উদ্দেশ্য মুসলিমদের জমির অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা।
-এমএমএস