আন্তর্জাতিক ডেস্ক
৩০ নভেম্বর ২০২৩, ০২:৪৭ পিএম
সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী হেনরি কিসিঞ্জার আর নেই। কিসিঞ্জার অ্যাসোসিয়েটস বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, ''শ্রদ্ধেয় মার্কিন স্কলার ও রাষ্ট্রনেতা হেনরি কিসিঞ্জার তার কানেকটিকাটের বাড়িতে মারা গেছেন।'' মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ১০০ বছর। বিশ্ব কূটনীতিতে তাকে এক কিংবদন্তি তুল্য প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে সম্মান দেওয়া হতো। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সমকালীন বিশ্ব রাজনীতির বাঁক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ইসরায়েল- আরব যুদ্ধ বন্ধে, সোভিয়েত প্রভাব রুখতে এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধে তার ভূমিকা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। তবে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় সংঘাত বন্ধ ও সামরিক দ্বন্দ্ব উস্কে দেওয়ার ক্ষেত্রে তার কর্মকাণ্ড তাকে চির স্মরণীয় করে রাখবে।
কয়েক দশকের ক্যারিয়ারে কিসিঞ্জার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কখনো কখনো আলোচিত, সমালোচিত এবং বিতর্কিতও হয়েছেন।
আরও পড়ুন: শিখ নেতাকে হত্যার ষড়যন্ত্রে ভারতীয় গ্রেফতার
কিসিঞ্জার ১৯২৩ সালে জার্মানিতে জন্ম গ্রহণ করেন। এরপর নাৎসি জার্মানি থেকে পালিয়ে পরিবারের সঙ্গে ১৯৩৮ সালে প্রথম যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন।
পরে ১৯৪৩ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব লাভ করেন। এরপর তিনি দেশটির সামরিক বাহিনী ও পরে কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সে কাজ করেন।
ছাত্র হিসেবে ব্যাচেলর, মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি লাভের পর তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন।
পরে ১৯৬৯ সালে তখনকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন তাকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেন।
মূলত এটিই তাকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতিতে ব্যাপক প্রভাব তৈরির সুযোগ করে দেয়। নিক্সন প্রশাসনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি।
এরপর প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড এর সময়েও কিসিঞ্জারের নেতৃত্বে পরিচালিত কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফল হিসেবে ইসরায়েল ও এর প্রতিবেশীদের মধ্যে ইয়ম কিপুর যুদ্ধ অবসানে মধ্যস্থতার সুযোগ এনে দেয়।
এছাড়া ভিয়েতনাম যুদ্ধ অবসানে প্যারিস শান্তি চুক্তিতেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
আরও পড়ুন: যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার মারা গেছেন
পরে ১৯৭৭ সালে সরকারি চাকরি থেকে বিদায়ের পর কিসিঞ্জার জনস্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়ের বিশ্লেষক হিসেবে ভূমিকা অব্যাহত রাখেন।
বিভিন্ন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও অনেক আইন প্রণেতারা বিভিন্ন বিষয়ে তার পরামর্শ নিয়েছেন।
১০০ বছর বয়সেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। সর্বশেষ চলতি বছর তিনি চীন সফর করেন। সম্প্রতি আমেরিকার শীর্ষ কর্মকর্তারা একের পর এক চীন সফর করেছেন। এর মধ্যে জুলাইয়ে হঠাৎ করে পূর্ব কোনো ঘোষণা ছাড়া বেইজিং সফর করেন হেনরি কিসিঞ্জার।
বিবিসি নিউজের এশিয়া ডিজিটাল সংবাদদাতা টেসা ওয়াং সে সময় লিখেছিলেন, "১৯৭০এর দশকে চীন যখন কূটনৈতিকভাবে একঘরে হয়েছিল, তখন দেশটিকে সে অবস্থা থেকে বের করে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার।"
চীন তাকে 'পুরনো বন্ধু' হিসেবে মূল্যায়ন করে এসেছে সব সময়।
একুশটি বই লিখেছেন তিনি এবং কাজ করেছেন অনেক কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে।
গত মে মাসে তার বয়স একশ বছর পূর্ণ হয়েছিল। তবে তখনও তিনি সক্রিয় ছিলেন। জুলাই মাসে বেইজিং সফরে গিয়ে চীনা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার বৈঠকটি বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।
তিনি স্ত্রী, দুই সন্তান ও পাঁচ নাতি-নাতনি রেখে গেছেন।
সমালোচনা আর বিতর্ক
বহু বছর ধরে কিসিঞ্জারকে ঘিরে নানান ধরনের সমালোচনা হয়েছে। বিশেষ করে তার সোভিয়েত ইউনিয়ন নীতি এবং চিলির অগাস্টো পিনোশে-সহ বিশ্বজুড়ে বহু কর্তৃত্বপরায়ন শাসকগোষ্ঠীকে সমর্থন দেওয়ার জন্যও সমালোচনা হয় তার।
শীতল যুদ্ধের সময়কার 'রিয়ালপলিটিকে'র মূর্ত প্রতীক বলেও তাকে মনে করেন অনেকেই।
কাম্বোডিয়ায় বেআইনিভাবে বোমা ফেলে গণহত্যা থেকে চিলিতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে উৎখাত - এমন বহু ঘটনায় বারবার নাম জড়িয়েছে কিসিঞ্জারের।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের চালানো গণহত্যাকেও প্রচ্ছন্ন সমর্থন করে স্বাধীন বাংলাদেশেও তার পরিচয় এক নিন্দিত চরিত্র হিসেবেই।
একদা তার প্রবল ভারতবিরোধী ভূমিকার কথাও বহুল চর্চিত ছিল। কুখ্যাত 'নিক্সন টেপে' হেনরি কিসিঞ্জারকে বলতে শোনা গিয়েছিল, "ভারতীয়রা 'সাচ বাস্টার্ডস' (এত বড় বেজম্মা), আর ইন্দিরা গান্ধী একজন 'বিচ' (স্ত্রী কুকুর বা দুশ্চরিত্রা স্ত্রীলোক)!"
যদিও পরে ভারতের সঙ্গে বিশেষ করে দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার সুসম্পর্কের কথা শোনা যায়।
তাকে দেওয়া নোবেল শান্তি পুরষ্কার নিয়েও বিতর্ক হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে তাকে ভিয়েতনামের লি ডাক থোর সঙ্গে নোবেল শান্তি পুরষ্কার দেওয়া হলে, থো সেই পুরষ্কার গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান।
কম্বোডিয়ায় বোমা বর্ষণ, দক্ষিণ আমেরিকায় সামরিক শাসনকে সমর্থনসহ আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির ইতিহাসে সবেচেয় বিতর্কিত অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িত থাকা কিসিঞ্জারকে এই পুরষ্কার দেওয়ায় অনেকের চোখ সে সময় কপালে ওঠে।
প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছিলেন নোবেল কমিটির দু’জন সদস্য।
নিউইয়র্ক টাইমস সে বছর পুরস্কারটিকে আখ্যায়িত করেছিল 'নোবেল ওয়ার প্রাইজ' হিসেবে।
সূত্র : বিবিসি, এপি, রয়টার্স
এমইউ