আন্তর্জাতিক ডেস্ক
১৫ আগস্ট ২০২৩, ১২:৩৩ পিএম
আফগানিস্তানে অপরাধীদের প্রকাশ্যে শাস্তি দিচ্ছে তালেবান কর্তৃপক্ষ। এক্ষেত্রে তারা ইসলামিক বিচার ব্যবস্থাকে অনুসরণ করছে। সেখানে চুরি, খুন, ব্যভিচার, পুরুষের মধ্যে যৌন সম্পর্ক, "বেআইনি যৌন সম্পর্ক", দুর্নীতি ও অনৈতিকতার জন্য শাস্তি দেওয়া হয়। এভাবে প্রকাশ্যে শাস্তি দেওয়ার মাধ্যমে তালেবান কর্তৃপক্ষ জনগণকে এটা বোঝাতে চাইছে যে অপরাধ করলে শাস্তি পেতে হবে।
এ বিষয়ে ২১-বছর বয়সী আফগান যুবক জুম্মা খান (ছদ্মনাম) বলেন, "তালেবান কর্তৃপক্ষ যখন প্রথমবারের মতো কোন ব্যক্তিকে দোররা (বেত্রাঘাতে শাস্তি) দেওয়ার জন্য ফুটবল স্টেডিয়ামে হাজির করেছিল, তখন আমার বুক এত ঢিব-ঢিব করছিল যে তার শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। আমার বিশ্বাস হয়নি যে এসব আমি বাস্তব জীবনে দেখছি, কোনো সিনেমা বা স্বপ্নে নয়।"
গত বছর ২২ ডিসেম্বর তালেবান সরকার যখন মধ্য আফগানিস্তানের তারিনকোট শহরের একটি ফুটবল স্টেডিয়ামে হাজার হাজার মানুষের সামনে ২২ ব্যক্তিকে বেত্রাঘাত করতে আনে, অনেকের সঙ্গে জুম্মা খানও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
এই ২২ জন অভিযুক্তের মধ্যে দু’জন ছিলেন নারী এবং বিভিন্ন ‘অপরাধের’ জন্য এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল।
এর আগের দিন তালেবান কর্তৃপক্ষ পুরো শহর জুড়ে মসজিদ এবং রেডিও মারফত এই শাস্তিদানের কথা ঘোষণা করেছিল এবং এসব ঘটনা থেকে “শিক্ষা নেওয়ার” জন্য লোকজনকে স্টেডিয়ামে হাজির থাকতে বলেছিল। মূলত, এভাবে প্রকাশ্যে শাস্তি দেওয়ার মাধ্যমে তালেবান কর্তৃপক্ষ জনগণকে এটা বোঝাতে চাইছে যে অপরাধ করলে শাস্তি পেতে হবে।
কোথায় দেওয়া হয় প্রকাশ্য শাস্তি?
প্রকাশ্যে শাস্তি দেওয়ার জন্য উপযুক্ত স্থান হিসেবে বড় বড় স্টেডিয়ামগুলোকে বেছে নেওয়া হয়। এটা এমন এক ঐতিহ্য যা ১৯৯০-এর দশকে শুরু হয়েছিল, যখন তালেবান গোষ্ঠী প্রথমবারের মতো আফগানিস্তানের শাসন-ক্ষমতা দখল করেছিল।
তারিনকোট স্টেডিয়ামে এমনিতে স্থান হয় ১৮,০০০ দর্শকের, কিন্তু জুম্মা খান জানাচ্ছেন, আরও অনেক বেশি সংখ্যক লোক সে দিন উপস্থিত ছিল।
তিনি বিবিসিকে বলেন, "অভিযুক্ত ব্যক্তিদের স্টেডিয়ামের মাঝখানে ঘাসের ওপর বসিয়ে রাখা হয়েছিল।
এটি ছিল এক রোদেলা বৃহস্পতিবার। অভিযুক্তরা অনুতাপ করছিল এবং তাদের বাঁচানোর জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করছিল।
দোররা মেরে সে দিন যাদের শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। তালেবানের সুপ্রিম কোর্ট টুইটারের মাধ্যমে তাদের কথা এবং শাস্তিপ্রাপ্তদের সংখ্যা ও লিঙ্গের বিষয়টি বিবিসি নিশ্চিত করেছে।
এ নিয়ে বিবিসির সঙ্গে কথা বলার সময় তালেবান সরকারের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ বলেন, “শরিয়া আইনের অধীনে আমাদের নেতা এ ধরনের শাস্তি কার্যকর করতে বাধ্য। কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, জনগণের উচিত এসব শাস্তিকে সামনে থেকে দেখা, যাতে তারা এসব থেকে শিক্ষা নিতে পারে। শরিয়া আইন অনুযায়ী এগুলোকে বাস্তবায়ন করা আমাদের দায়িত্ব।”
জুম্মা খান জানাচ্ছেন, অভিযুক্ত পুরুষদের বয়স ছিল ১৮ থেকে ৩৭ বছরের কোঠায়। এদের প্রত্যেককে ২৫ থেকে ৩৯টি দোররা মারা হয়।
তিনি বলেন, "এদের মধ্যে কেউ কেউ কাঁদছিল, আর চিৎকার করছিল। কেউ কেউ নীরবে দোররার আঘাত সহ্য করছিল। আমার এক আত্মীয়কে চুরির অপরাধে ৩৯টি বেত্রাঘাত দেওয়া হয়।
“তিনি পরে আমাকে বলেছিলেন যে বেতের ২০টি আঘাতের পর তার শরীর একেবারে অসাড় হয়ে গিয়েছিল এবং তিনি আর ব্যথা অনুভব করতে পারছিলেন না।"
তবে জুম্মা খান জানান, তালেবান সে দিন ওই দুই নারীকে প্রকাশ্যে শাস্তি দেয়নি।
কতজনকে প্রকাশ্যে শাস্তি দেওয়া হয়েছে?
তালেবান সরকার ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ্যে মানুষের শাস্তির কথা ঘোষণা করেছিল এবং সুপ্রিম কোর্ট এসব বিষয়ে বিবৃতি জারি শুরু করেছিল।
বিবিসির তদন্ত থেকে জানা যাচ্ছে, তারপর থেকে ৫০টি ঘটনায় মোট ৩৪৬ জনকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
অভিযুক্তরা পুরুষ নাকি নারী, শীর্ষ আদালত তা প্রকাশ করেনি। তবে অন্তত ৫১টি মামলায় আসামী ছিল নারী এবং ২৩৩টি মামলায় আসামী পুরুষ ছিল বলে জানা যাচ্ছে। (৬০টি মামলায় অভিযুক্তদের ব্যাপারে তথ্য অজানা)।
অভিযুক্তদের সবাইকে বেত্রাঘাত করা হয়েছিল এবং কয়েকজনকে কারাদণ্ডও দেওয়া হয়েছিল।
অভিযুক্তদের মধ্যে দু’জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। তাদের একজন দক্ষিণ-পশ্চিম আফগানিস্তানের ফারাহ প্রদেশের এবং অন্যজন হচ্ছেন পূর্বাঞ্চলীয় লাঘমান প্রদেশের।
গত বছর ১৩ নভেম্বরের পর থেকে প্রকাশ্যে শাস্তির মাত্রা অনেকগুণ বেড়ে যায়, যখন তালেবানের সর্বোচ্চ নেতা বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্তদের মামলাগুলো "সতর্কতার সঙ্গে” পর্যবেক্ষণ করতে এবং অভিযুক্তদের ওপর "আইন প্রয়োগ করার" জন্য সে দেশের বিচার বিভাগকে নির্দেশ দেন।
কোন কোন 'অপরাধে' শাস্তি দেওয়া হয়?
তালেবান সরকার বলেছে, আফগানিস্তানে ইসলামিক বিচার ব্যবস্থা অনুযায়ী তারা এ ধরনের শাস্তি প্রদান করে।
চুরি, খুন, ব্যভিচার, পুরুষের মধ্যে যৌন সম্পর্ক, "বেআইনি যৌন সম্পর্ক", দুর্নীতি, বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া এবং অনৈতিকতা ইত্যাদি মিলিয়ে ১৯টি শ্রেণীতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ রয়েছে।
তবে কীভাবে এসব অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করা হয়, তা খুব একটা পরিষ্কার না। কিছু কিছু অপরাধের ব্যাখ্যা নানানভাবে দেওয়া হতে পারে।
অভিযুক্ত অনেককে চুরির জন্য শাস্তি দেওয়া হয় - সাধারণত ৩৯টি দোররা। এটিসহ অভিযুক্তকে তিন মাস থেকে এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়ারও বিধান রয়েছে।
তালেবান আইনে যৌন অপরাধ, তালেবান সরকার যাকে বলে ‘জেনা’ (ব্যভিচার), "বেআইনি যৌন সম্পর্ক" কিংবা "অনৈতিক সম্পর্ক"-এরও শাস্তির বিধান রয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের বিবৃতিতে "লিওয়াতাত"-এর ছয়টি ঘটনাও উল্লেখ করা হয়েছে। শরিয়া আইনে দুই পুরুষের মধ্যে যৌন মিলনকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
কোন প্রদেশে সবচেয়ে বেশি শাস্তি হয়েছে?
বিবিসির তদন্তে দেখা গেছে, আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে ২১টিতে প্রকাশ্যে শাস্তির আয়োজন করা হয়েছে। তবে কিছু প্রদেশে এসব ঘটেছে অন্য প্রদেশের চেয়ে অনেক বেশি হারে।
আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় লাঘমান প্রদেশে প্রকাশ্যে শাস্তি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে সবচেয়ে বেশি – মোট সাতটি। এরপর রয়েছে পাকতিয়া, ঘোর, পারওয়ান ও কান্দাহার প্রদেশ।
প্রকাশ্যে শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তির সংখ্যার বিচারে হেলমান্দ প্রদেশ রয়েছে শীর্ষে। সেখানে ৪৮ জনকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
এর পাশাপাশি বাদাখশানে ৩২ জন, পারওয়ানে ৩১ জন, ঘোর ও জাজিয়ানে ২৪ জন, কান্দাহার ও রোজগানে ২২ এবং রাজধানী কাবুলে ২১ জনকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
এই সংখ্যাগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র সেইসব মামলা অন্তর্ভুক্ত যেগুলোর কথা তালেবানের সুপ্রিম কোর্ট সরকারিভাবে বিবৃতি দিয়ে নিশ্চিত করেছে। এর বাইরেও বহু মামলা থাকতে পারে যা সম্ভবত সরকারি রেকর্ডে নেই।
সরকারি বিবৃতিতে তারা শুধু বলে যে প্রকাশ্যে শাস্তি কার্যকর করা হলে জনগণ তা থেকে “শিক্ষা নিতে” পারে।
তারা আরও যুক্তি দেখায় যে এ ধরনের প্রকাশ্য শাস্তির ঘটনা ভবিষ্যতে অপরাধকে প্রতিরোধ করে।
সূত্র : বিবিসি
এমইউ