images

হেলথ

কালাজ্বর শনাক্তে কী সেই পদ্ধতি

নিজস্ব প্রতিবেদক

০২ জানুয়ারি ২০২৩, ০২:১৯ পিএম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মনজুরুল করিমের নেতৃত্বে একদল গবেষক কালাজ্বর শনাক্ত করতে দ্রুত ও কার্যকরী একটি নতুন মলিকিউলার ডায়াগনস্টিক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। 

সোমবার (২ জানুয়ারি) বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কার্যালয় সংলগ্ন প্রফেসর আব্দুল মতিন চৌধুরী ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানানো হয়েছে। সম্মেলনে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান সভাপতিত্ব করেন।

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মনজুরুল করিম সার্বিক বিষয়টি উত্থাপন করে বলেন, কালাজ্বর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের একটি উপেক্ষিত রোগ। যা লেশমানিয়াসিসের ৩টি রূপের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ এবং প্রাণঘাতি। বিশ্বের ৬০টিরও বেশি দেশে কালাজ্বরের প্রকোপ রয়েছে।   চিকিৎসা না করালে কালাজ্বরের সংক্রমণ এতটাই গুরুতর ও মারাত্মক হয়ে থাকে, এই রোগে মৃত্যুহার শতকরা ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত বর্ধিত হতে পারে। রোগটি নির্ণয়ে রক্তের ইমিউনোক্রোমাটোগ্রাফিক, অস্থি-মজ্জা, যকৃত, প্লিহা এবং লিম্ফ নোডের টিস্যু অণুবিক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হতো। ফলে প্রথমটিতে রোগ নির্ণয়ে নির্দিষ্টতা কম, আর অন্যটিতে টিস্যু সংগ্রহের সময় মারাত্মক রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বিদ্যমান। 

বিগত দশকে, বেশ কিছু পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (পিসিআর) ভিত্তিক কালাজ্বর নির্ণয় প্রক্রিয়া প্রচলিত হয়েছে। যদিও এই প্রক্রিয়া আগে ব্যবহৃত পদ্ধতির চাইতে বেশি কার্যকারী। এসব প্রক্রিয়ায় রক্ত, অস্থি-মজ্জা, যকৃত, প্লিহা, লিম্ফ নোডে টিস্যুর নমুনা ব্যবহার করা হয়। ইতোমধ্যে একাধিক গবেষণায় কিডনিতে লেশম্যানিয়ার দেহের উপস্থিতি প্রমাণিত হয়েছে, তাই আমরা প্রস্রাবের নমুনা ব্যবহার করে এবং রিয়েল টাইম পিসিআর প্রযুক্তির সাহায্যে কালাজ্বর শনাক্ত করার চেষ্টা করেছি। ক্লিনিক্যালি নির্ণয়কৃত কালাজ্বর রোগীদের থেকে সংগ্রহ করা প্রস্রাবের নমুনা ব্যবহার করে তাতে এল-ডোনোভানি পরজীবীর অস্তিত্ব রিয়েল টাইম পিসিআরের মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়েছিল। রোগীদের একই সেট থেকে রক্তের নমুনা তুলনা করে পরীক্ষার ফলাফলগুলো যাচাই করা হয়েছিল। একই সঙ্গে এই রিয়েল টাইম পিসিআর ভিত্তিক কালাজ্বর নির্ণয় পরীক্ষণটি, আগের এক গবেষণায় অংশগ্রহণকারী কালাজ্বর রোগীদের কাছ থেকে সংগৃহীত অস্থি-মজ্জার নমুনার ওপর প্রয়োগ করা হয়। রিয়েল টাইম পিসিআর ভিত্তিক পরীক্ষণটি প্রস্রাবে রক্ত এবং পূর্ববর্তী অস্থি মজ্জার নমুনাগুলো থেকে এল-ডোনোভানি পরজীবী শনাক্তের ক্ষেত্রে শতভাগ সংবেদনশীলতা প্রদর্শন করে। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ গ্রুপগুলোতে অর্থাৎ গবেষণায় অংশগ্রহণকারী সুস্থ ব্যক্তি এবং কালাজ্বরের মতো অন্যান্য রোগ যেমন, মালেরিয়া, ডেঙ্গু এবং যক্ষ্মা আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রস্রাব এবং রক্তের নমুনায় কোনোরূপ সংবেদনশীলতা দেখা যায়নি।

তিনি বলেন, রিয়েল টাইম পিসিআর ভিত্তিক এই মলিকুলার ডায়াগনস্টিক পদ্ধতিটি সম্পূর্ণ নির্ভুল এবং নিখুঁতভাবে কালাজ্বর শনাক্তকরণের জন্য একটি রোগী-বান্ধব পদ্ধতি। এতে দ্রুততার সাথে কালাজ্বর শনাক্ত করা সম্ভব যা রোগীর দ্রুত চিকিৎসা এবং রোগ নিরাময়ের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই পদ্ধতির ব্যবহার বাংলাদেশকে কালাজ্বর নির্মূলের দিকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক ২০৩০ সালের মধ্যে উপেক্ষিত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগ নির্মূলের জন্য নির্ধারিত কার্যপ্রণালীর অন্যতম লক্ষ্য। 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপকের মতে— প্রস্রাবের নমুনা ব্যবহার করে এই পদ্ধতিতে যে উল্লেখযোগ্য সংবেদনশীলতা এবং নির্দিষ্টতা পাওয়া গেছে, তা রক্ত বা আরও জটিল নমুনা যেমন অস্থি-মজ্জা বা প্লিহার নমুনাভিত্তিক কালাজ্বর নির্ণয় পদ্ধতিকে প্রতিস্থাপন করতে পারবে। অধিকন্তু, প্রচলিত পিসিআর এবং নেস্টেড পিসিআর-ভিত্তিক কৌশলগুলোর সাথে তুলনা করলে, রিয়েল টাইম-পিসিআরের একটি ধাপেই রোগকে অধিক নির্ভুলতা এবং নিশ্চয়তার সাথে শনাক্তকরণে সক্ষম, যা প্যাথলজিস্টদের জন্য কাজের চাপ কমিয়ে দেবে। এই পদ্ধতিটি একইসাথে চিকিৎসা প্রতি রোগী ও জীবাণুর প্রতিক্রিয়া মূল্যায়ন, আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে পরজীবীর গতিবিধি, পরিবেশে সংক্রমণনের গতিবিধি নিরূপন এবং মহামারি-সংক্রান্ত জনি পর্যবেক্ষণেও ব্যবহার করা যেতে পারে।

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মনজুরুল করিম আশা প্রকাশ করে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগে করা কালাজ্বরের MDx-এ ক্লিনিক্যাল নমুনা হিসেবে প্রস্রাব ব্যবহার করার দৃষ্টান্ত ভারতীয় উপমহাদেশে এই প্রথম; এবং এর ফলাফল বিশ্বখ্যাত জার্নাল PLOS Gld Public Health-এ প্রকাশিত হয়েছে (লিঙ্ক (https://doi.org/10.1371/journal.pgph, 0000834)। আমরা আশা করি, দেশ এবং দেশের বা কালাজ্বর নির্মূলে এই গবেষণা উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, হঠাৎ করে কোনো ভালো ফল আসে না। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী গবেষণার ফল। বারবার ব্যর্থ হওয়ার পর সফলতা আসে। এটি বিশ্বের মধ্যে এই প্রথম আবিষ্কার যা প্রস্রাব থেকে কালাজ্বর শনাক্ত করা যাবে। খরচও অনেক কম হবে। এসময় উপাচার্য এই গবেষণায় সম্পৃক্ত সকলকে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানান। বিশেষ করে অধ্যাপক মনজুরুল করিমকে আন্তরিকভাবে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান গবেষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট সকলকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান।

পিএস/এইউ