মাহফুজ উল্লাহ হিমু
০৩ আগস্ট ২০২২, ১০:৪৬ এএম
রাজধানীর মগবাজারের বাসিন্দা আসমা বেগম। জ্বরে আক্রান্ত দুই বছরের ছেলের জন্য নাপা সিরাপ কিনতে এসেছেন একই এলাকার শরীয়তপুর ফার্মেসিতে। তবে ওষুধ কিনতে এসে বড়সড় একটা ধাক্কা খেলেন তিনি। কয়েকদিন আগের ১৮ টাকার নাপা সিরাপের দাম হয়ে গেছে ৩০ টাকা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে বাসা-বাড়িতে ছুটা কাজ করা আসমার জন্য এ যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘা!
আসমা বলেন, ‘বাচ্চার জ্বর থাকায় নাপা সিরাপ কিনতে এসেছিলাম। এসে দেখি দাম প্রায় ডাবল হয়ে গেছে। একই অবস্থা নাপা-এইসের মতো ট্যাবলেটগুলোর। এমনিতে চাল, তেলের দাম আসমানে উঠেছে। এর মধ্যে ওষুধের দাম বাড়লে তো আমাদের বেঁচে থাকাটাই দায়। ভাত খাবো না ওষুধ খাবো? বড়লোকদের জন্য এটা কোনো কিছু না। কিন্তু আমাদের মতো খেটে খাওয়া মানুষের জন্য তো এইটুকুই অনেক কিছু। টিসিবির ডাল-ভাত খেয়ে কোনো রকম বেঁচে আছি। ওষুধ তো সেখানেও পাওয়া যায় না। বড়লোক-গরীব সবার জন্য একই দাম।’
অপর ক্রেতা জামাল বলেন, ‘আমার টনসিল ও গলায় ইনফেকশনের সমস্যা রয়েছে। গত কয়েকদিনে এটা অনেকটাই বেড়েছে। চিকিৎসক ফেনোক্সিমিথাইলের কোর্স সম্পন্ন করতে বলেছেন। ওষুধ কিনতে এসে দেখি আগের তুলনায় দাম অনেক বেড়ে গেছে। আগে এক পাতা (১০টি) ওষুধের দাম ছিল ৩৮ থেকে ৪০ টাকা। এখন তা বেড়ে ৫৫ টাকা হয়ে গেছে। হঠাৎ করে দাম এত বেড়েছে ভাবতে পারিনি। ৮ টাকা পাতা নাপার (৫০০ মিলিগ্রামের ট্যাবলেট) দাম রাখলো ১২ টাকা। প্রথম ভেবেছিলাম দোকানিই বেশি টাকা চাচ্ছে। পরে অন্য দোকানে জিজ্ঞেস করে দেখলাম ওষুধের দামই বেড়ে গেছে।’
দাম বৃদ্ধির বিষয়ে ঔষুধ প্রশাসন অধিদফতরের ঘোষণার পর থেকেই ফার্মেসিগুলোতে এটি একটি সাধারণ চিত্রে পরিণত হয়েছে। প্রাথমিক চিকিৎসায় বহুল ব্যবহৃত বিভিন্ন ওষুধ কিনতে এসে প্রত্যেক ক্রেতাই এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন।
বিভিন্ন ফার্মেসি সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, প্যারসিটামল, ওরস্যালাইনসহ প্রাথমিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত প্রায় সকল ওষুধে দাম শতকরা ৪০ থেকে শতাধিক হারে বাড়ানো হয়েছে। গত ৩০ জুন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত ওষুধের মূল্যনির্ধারণ কমিটির ৫৮তম সভায় এসব ওষুধের পুনর্নির্ধারিত দাম অনুমোদন করা হয়। সরকারিভাবে এ সংক্রান্ত কোনো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ না করা হলেও এর মধ্যেই প্রাথমিক চিকিৎসায় বহুল ব্যবহৃত ২০টি জেনেরিকের ৫৩ ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।
কর্তৃপক্ষ যা বলছে
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য তালিকাভুক্ত ১১৭টি ওষুধের দাম বাড়ানোর ক্ষমতা থাকে সরকারের হাতে। ওষুধ উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল, এক্সিপিয়েন্ট, প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়াল, পরিবহন ও ডিস্ট্রিবিউশন ব্যয়, ডলারের বিনিময়মূল্য, মুদ্রাস্ফীতিসহ নানা কারণে ওষুধ উৎপাদনে খরচ বেড়েছে। এসব কারণে ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে।
এ বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক মো. আইয়ুব হোসেন বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকেই নিত্যপ্রয়োজনীয় তালিকাভুক্ত ওষুধের দাম নির্ধারণ করে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। এ ওষুধের দাম পুনর্মূল্যায়ন করে সেগুলোর নতুন দাম নির্ধারণ করার বিষয় রয়েছে। ওষুধের দাম আচমকা বাড়ানো হয়েছে বিষয়টা এমন নয়। অনেকদিন ধরে দামের পুনর্মূল্যায়ন হয়নি। এ অবস্থায় কাঁচামালের দাম বাড়ানোসহ নানা কারণে বাজারে ওষুধের স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। কোম্পানিগুলো কিছু ওষুধ উৎপাদনে উৎসাহিত হচ্ছে না। সবকিছু পর্যালোচনা করেই ঔষধ প্রশাসনের দাম নিয়ন্ত্রণ কমিটির পরামর্শক্রমে সরকার এ ওষুধগুলোর দাম আপডেট করেছে।’
জনজীবনে বিরূপ প্রভাবের শঙ্কা
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে অধিক ব্যবহার্য এসব ওষুধের দাম বাড়ায় স্বাভাবিক জনজীবনে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক মো. মহিউদ্দিন আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘দেশে দ্রব্যমূল্যে ঊর্ধ্বগতি দেখা দিয়েছে। সরকার তার লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করছে, আবার সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান ওষুধের দাম বাড়িয়ে দিল। তাহলে আপনি কিভাবে লাগাম টেনে ধরবেন। ওষুধের এই মূল্যবৃদ্ধিতে জনজীবন আরও বিপর্যস্ত হয়ে উঠবে। মানুষ একবেলা ভাত না খেলেও প্রেশারের ওষুধটা খায়। কারণ তার আগে জীবন বাঁচাতে হবে। আপনি সুস্থ না থাকলে খাবার খাবেন কি করে? খেতে হলে তো আগে সুস্থ থাকতে হবে। এজন্যই ওষুধের দোকানে মানুষ লাইন ধরে ওষুধ কিনে।’
তিনি আরও বলেন, ‘লক্ষ্য করলে দেখবেন মনোহরি দোকানে চাল-ডাল কেনার জন্য লোকের লাইন নেই। কিন্তু এমন কোনো ওষুধের দোকান দেখবেন না যেটাতে লাইন বা ভিড় নেই। অর্থাৎ আমাদের ভোগ্য পণ্যের থেকেও ওষুধ অধিক গুরুত্বপূর্ণ পণ্যে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থায় হঠাৎ করে যদি ওষুধের দাম বাড়িয়ে দেয়। তাহলে দিন আনে দিন খায় ধরনের মানুষসহ সাধারণ মানুষ যাদের প্রতিদিন ওষুধ লাগে তারা কি করে চলবে? ঔষধ প্রশাসনসহ সকলকে এ বিষয়টি বিবেচনা করা প্রয়োজন ছিল। দাম বাড়া একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া কিন্তু এত বেশি বাড়ানোটা কতটা যুক্তি সঙ্গত তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ওষুধের দাম ৪০ শতাংশ থেকে শতভাগের বেশি বাড়ানো হয়েছে। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।’
দাম বাড়ানোর যুক্তিগুলো খুবই দূর্বল!
মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, এটিই গত কয়েকদিনে ওষুধের একমাত্র দাম বৃদ্ধি নয়। এর আগেও ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে। ১১৭টি জেনেরিকের দাম বাড়ানোর সক্ষমতা রাখে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। আর বাকি ওষুধগুলোর দাম নির্ধারণ করে কোম্পানিগুলোর মালিক পক্ষ। যার ফলে বেশ কয়েকদিন যাবতই বিভিন্ন ওষুধের দাম বাড়ছে, বিশেষ করে গ্যাস্ট্রিকও প্রেশারের যে ওষুধগুলো মানুষ নিয়মিত খায়। তারা এটা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সাথেও কথা বলেছেন কিন্তু কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি।
ওষুধের দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ নয় দাবি করে তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক ডলারের দাম বেড়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দামও কিছুটা বাড়তে পারে। কিন্তু দেশে ওষুধের দাম একটা জবাবদিহিতার মধ্যে বাড়াতে হবে। যা তারা করে না। লক্ষণীয় বিষয় ওষুধ প্রশাসন বা সংশ্লিষ্টরা যখন গণশুনানি ধরনের আয়োজন করে সেখানে সকল স্টেক হোল্ডারদের ডাকে না। গণমাধ্যমকেও জানানো হয় না। সাম্প্রতিক সময়ে তারা আমাদের একটি গণশুনানির জন্য ডাকলো। আমরা যাওয়ার পর দেখি কেউ নেই। শুধু আমরা তিন-চার জন এসেছি। আমরা যখন জিজ্ঞেস করালাম, মিডিয়া বা অন্যরা কোথায়? বলল যে তারা কাউকে জানায়নি। তাহলে এটা কিসের গণশুনানি হলো? গণশুনানির মানেই হলো স্টেকহোল্ডাররা থাকবে। অর্থাৎ জবাবদিহিতার কোনো বালাই নেই।’
দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে নাগরিক সমাজের এই প্রতিনিধি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বেড়েছে এটা ঠিক কিন্তু এত বেশি হারে বেড়েছে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এছাড়া অনেক ওষুধের কাঁচামাল আমাদের দেশেই উৎপাদন হয়। অল্পকিছু আমরা বাইরে থেকে আমদানি করি। এমনকি অনেক দেশে আমরা এসব কাঁচামাল রফতানিও করি। যেমন প্যারাসিটামলের দাম বাড়ানো হয়েছে। অথচ এর উপাদান কিন্তু বাইরে থেকে আমদানি করতে হয় না। ২০০০ সাল পর্যন্ত কিছু প্যারাসিটামল বাইরে থেকে আসতো কিন্তু এখন তো আমরাই তা রফতানি করি। এন্টিবায়োটিকের থার্ড জেনারেশন পর্যন্ত আমরা রফতানি করি। তাহলে আমাদের সমস্যাটা কোথায়? যেগুলোর কাঁচামাল আমাদের দেশে উৎপাদন হয় সেগুলোর ক্ষেত্রে তো আপনি আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি, ডালারের দাম বৃদ্ধির অজুহাত দিতে পারেন না। এগুলো খুবই ঠুনকো যুক্তি। দাম বৃদ্ধির ব্যাপারে তাদের যুক্তি ও কাজে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে।’
ওষুধের বিষয়গুলো বৈজ্ঞানিক ও সাধারণ মানুষের ধারণার বাইরের। এই সুযোগে উৎপাদনকারীরা যেভাবে বলে সকলকে সেটাই বিশ্বাস করতে হয়। মানুষের না বুঝার সুযোগ নিয়ে উচ্চশিক্ষিত মানুষেরা সকলকে বোকা বানাচ্ছে বলেও জানান মহিউদ্দিন আহমেদ।
এমএইচ/এএস