ফিচার ডেস্ক
২১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:২৫ এএম
শুধুমাত্র বইয়ের ভেতর ডুবে থাকা নয় একজন শিক্ষার্থীকে পড়াশোনার পাশাপাশি জীবনের অন্যান্য দিকেও বেড়ে ওঠাটা গুরুত্বপূর্ণ। এজন্যে চারদিক দিয়েই তাকে ভালো থাকতে হবে। চারদিক বলতে শারীরিক মানসিক সামাজিক কিংবা আত্মিক সবদিকে সমানতালে এগিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়েই গড়ে উঠতে পারে টোটাল ফিটনেস। চারদিকের এই ফিটনেস অর্জনে জীবনযাপনের বিজ্ঞান চর্চার গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে শিক্ষাজীবনেই এ চর্চা শুরু হলে সহজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে একজন মানুষের জীবন হতে পারে টোটালি ফিট।
প্রকৃতিতে একটি কথা আছে- সারভাইভেল অব দ্য ফিটেস্ট। মানে যে সবচেয়ে ফিট, সে-ই টিকে থাকবে। আর ‘ফিটনেস’ শব্দটি সাধারণত গাড়ির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হলেও এটি কিন্তু মানুষের সাথেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একজন মানুষ শুধু শারীরিকভাবে ফিট হলেই হবে না, মানসিক, সামাজিক এবং আত্মিক দিকেও তাকে ফিট হতে হবে। সায়েন্স অব টোটাল ফিটনেস এ কথাটিই বলে। একটি গাড়ি যেমন চারটি চাকার উপর ভর করে চলে। এক চাকা পাংচার হলে চলতে পারে না, তেমনি জীবনের এই চারটি দিকের কোনো একটি দিক দুর্বল থাকলে জীবনও সামনের দিকে চলতে পারে না। তাই শিক্ষাজীবনেই টোটাল ফিটনেস অর্জনে মনোযোগী একজন শিক্ষার্থী নিজেকে গড়ে তুলতে পারে আলোকিত সুস্থ সবল এক মানুষে।
ফিজিক্যাল ফিটনেস বা শারীরিক ফিটনেস হলো সারাদিন পরিশ্রম, কাজ, পড়াশুনা বা গবেষণা করেও একজন মানুষ ক্লান্তি অনুভব করবেন না। তিনি পরিশ্রম করবেন আবার পরিশ্রমকে উপভোগও করবেন। চিকিৎসাব্যয়ে তার বাড়তি খরচ কম। বয়স বাড়বে, সাথে সাথে বাড়তে থাকবে তারুণ্য। রোগে-শোকে ভুগতে ভুগতে নয়, শিক্ষাজীবন শেষে তিনি লাভ করবেন কর্মব্যস্ত সুখী জীবন।
চারদিকে ভালো থাকার দ্বিতীয়টি হলো মানসিক বা মেন্টাল ফিটনেস। লেখাপড়া, পেশা কিংবা জীবনে যত রকমের সমস্যা বা প্রতিকূলতা কোনো বাধা হতে পারবে না। আশাবাদ বাড়বে। ইতিবাচকতা বাড়বে। পারিপার্শ্বিক নেতিবাচকতা প্রভাবিত করতে পারবে না। মানসিক ফিটনেসের কারণে জীবনযুদ্ধে তিনি হাসিমুখে জয়ী হবেন।
তৃতীয় বিষয়টি হলো সামাজিক বা সোশ্যাল ফিটনেস। অর্থাৎ আপনার উপস্থিতিই প্রমাণ করবে আপনার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা। সহপাঠী, শিক্ষকসহ সবার কাছে আপনি হবেন আকাক্সিক্ষত। মানুষ আপনাকে ভালবাসবে, আপনার প্রতি মনোযোগী হবে, কারণ মানুষকে আপনি ভালবাসা ও মনোযোগ দিতে পারবেন। জীবনে যার সাথেই আপনার দেখা হবে, সে আপনাকে ভুলতে পারবে না। মৃত্যুর পরেও হাজারো মানুষ আপনাকে অনুভব করবে, দোয়া করবে।
সর্বশেষ চতুর্থ বিষয়টি হলো আত্মিক বা স্পিরিচুয়াল ফিটনেস। অর্থাৎ আপনার অস্তিত্বের গহীনে যে আত্মার বসবাস, তার সাথে আপনার কোনো দূরত্ব থাকবে না। আপনি স্রষ্টার নৈকট্য লাভ করবেন। জীবন আপনার কাছে হয়ে উঠবে পরিপূর্ণ। আসলে অর্থ খ্যাতি ক্ষমতা সুনাম বা ডিগ্রি কিন্তু মানুষকে সার্বিকভাবে সুখী করতে পারে না। বরং জীবনটাকে সুস্থ সুন্দর করলে অর্থ খ্যাতি সুনাম এমনিতেই চলে আসবে। মানসিক ও আত্মিক ফিটনেসের অধিকারী হলে আপনার পথ চলাটা সহজ হবে, সার্থক হবে। এজন্যেই জীবনে টোটালি ফিট থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ।
তবে টোটাল ফিটনেস একদিনেই অর্জিত হবে না। টোটাল ফিটনেসের পথে এগিয়ে যেতে বাস্তব কিছু করণীয় ঠিক করতে হবে। পড়াশুনার পাশাপাশি শিক্ষাজীবনেই এ চর্চা শুরু করতে হলে প্রথমেই ফিটনেস বাড়ানোর ধাপগুলো লিপিবদ্ধ করা প্রয়োজন। লিখে রাখলে ব্রেনের কাছে লক্ষ্যটা যেমন পরিষ্কার হবে তেমনি অর্জন করার সম্ভাবনাও বেড়ে যাবে। সবগুলো একসাথে করে ফেলার তাড়া না করে ধীরে এগুনোই উত্তম। এক্ষেত্রে ছোট ছোট ধাপে এগুতে হবে।

শারীরিক ফিটনেসের জন্যে যোগব্যায়াম করা যেতে পারে। কোয়ান্টাম ব্যায়াম চর্চা আমাদের দেশে এখন বেশ জনপ্রিয় ও ফলপ্রসূ। পাশাপাশি হাঁটা, দৌড়ানো, সাঁতার কিংবা কায়িক পরিশ্রম ইত্যাদিও জরুরি। মানসিক ফিটনেসের জন্যে প্রতিদিন দুবেলা মেডিটেশন বেশ কার্যকর। সামাজিক ফিটনেসের জন্যে সবাইকে আগে সম্ভাষণ জানানো বা কুশলাদি বিনিময়ের পাশাপাশি সামাজিক সেবমূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণও একজন মানুষকে সামাজিকভাবে ফিট করতে ভূমিকা রাখে। আত্মিক ফিটনেসের জন্যে প্রার্থনায় আরো বেশি মনোযোগী হওয়াটা জরুরি। অন্যকে সহজে ক্ষমা করা এবং সবকিছু থাকার পরেও মানুষের যে আত্মিক শূন্যতা তা পূরণে নিজ ধর্মে লীন হওয়ার চর্চাটাও জরুরি।
টোটাল ফিটনেস অর্থাৎ জীবনযাপনের এ বিজ্ঞান নিয়মিত চর্চায় একজন শিক্ষার্থী একাগ্রচিত্তে পড়াশুনা ও গবেষণায় মনোনিবেশ করার সক্ষমতা অর্জন করতে পারে। ঘুমের সমস্যা দূর ও ঘুমের তৃপ্তিদায়ক বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া আয়ত্ত করতে পারে। পড়াশুনাকে চাপ নয় বরং উপভোগের সাথে সাথে সৃজনশীলতা বৃদ্ধি, সহপাঠীদের সাথে সুসম্পর্ক, স্বস্তিকর ও আনন্দদায়ক জীবনযাপনে অভ্যস্ততা রপ্তসহ জীবনের সবদিকের জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারে। ফলে শিক্ষাজীবন শেষ করে পরবর্তী জীবনে একজন শিক্ষার্থীই হয়ে উঠতে পারে টোটালি ফিট। পরিণত হতে পারে অন্য লাখো মানুষের ভরসাস্থল। সবাইকে ২১ ডিসেম্বর বিশ্ব মেডিটেশন দিবসের শুভেচ্ছা।
লেখক: অধ্যাপক, ইকোনোমিক্স এন্ড সোশিওলজি বিভাগ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়