images

হেলথ

হাঁটায় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, রমনার ভোরে আশার গল্প

মাহফুজুর রহমান

১৪ নভেম্বর ২০২৫, ১০:৩১ এএম

ভোরের আলো ফোটার আগেই রাজধানীর রমনা পার্কের বাতাসে মিশে যায় হাঁটার ছন্দ, হাসির শব্দ আর নিঃশ্বাসের ভারী আওয়াজ। কেউ একা হাঁটছেন, কেউ আবার দলবেঁধে ধীরগতিতে ব্যায়াম করছেন। সকালের এই দৃশ্য অনেকের চোখে হয়ত শুধুই একদল মানুষ সকালের ব্যায়াম করছে। কিন্তু এই মানুষদের গল্প আলাদা। তারা সবাই একেকজন লড়াকু যোদ্ধা। ডায়াবেটিস নামের দীর্ঘস্থায়ী রোগের সঙ্গে বহু বছর ধরে লড়ছেন প্রতিদিন।

রমনা পার্কের দক্ষিণ গেটের পাশে দেখা মিলল ৬২ বছর বয়সী শহীদুল ইসলাম নামে এক অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তার। তিনি হাসতে হাসতেই বললেন, ‘আমার ডায়াবেটিস ধরা পড়ে ২০ বছর আগে। তখন ডাক্তার বলেছিলেন নিয়মিত হাঁটতে হবে, না হলে ইনসুলিনেই জীবন চলবে। এখনো ইনসুলিন নিচ্ছি, তবে হাঁটাটা বন্ধ করিনি একদিনও। এটা না করলে শরীর ঠিক রাখা যায় না।’

তাঁর কথার সঙ্গে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন ৫৫ বছর বয়সী বাবুল তালুকদার। তিনি বললেন, ‘আমার বয়স কম ছিল যখন ধরা পড়ে। এখন প্রায় ১৫ বছর ধরে ডায়াবেটিসে ভুগছি। কিন্তু আমি ভয় পাইনি, বরং জীবনধারায় পরিবর্তন এনেছি। রমনায় প্রতিদিন এক ঘণ্টা হাঁটি, সকালে হালকা ব্যায়াম করি, তারপর বাড়ি গিয়ে খাবার খাই পরিমিতভাবে।’

ডায়াবেটিস আক্রান্তদের জন্য হাঁটা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ- এ বিষয়ে কথা বললেন রমনা পার্কের নিয়মিত আরেক ব্যায়ামকারী এবং চিকিৎসক ডা. আব্দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘শরীরচর্চা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের অন্যতম বড় উপায়। হাঁটা শরীরে ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা বাড়ায়, রক্তে শর্করার মাত্রা কমায় এবং মানসিক চাপও কমাতে সাহায্য করে। অনেকে ওষুধ বা ইনসুলিনের ওপর নির্ভরশীল হলেও নিয়মিত ব্যায়াম না করলে রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন।’

14

ভোরে হাঁটতে হাঁটতে দেখা গেল একদল প্রবীণ মানুষকে, কেউ কেউ ইনসুলিন ইনজেকশন নেওয়ার ব্যাগ সঙ্গে রেখেছেন। ৭০ বছর বয়সী আবুল হোসেন বলেন, ‘আমি ১৮ বছর ধরে ডায়াবেটিক। এখন ইনসুলিন ছাড়া পারি না। কিন্তু হাঁটা ছাড়া চলেও না। হাঁটলে শরীর হালকা লাগে, মনটাও ভালো থাকে। ডাক্তারও বলেন, ব্যায়ামই হচ্ছে আসল ওষুধ।’

রমনা পার্কের সকালটা যেন এক অনানুষ্ঠানিক ‘হেলথ ক্লাব’। কেউ হাঁটার আগে হালকা গরম-আপ করছেন, কেউ হাসির ব্যায়াম করছেন, কেউবা চোখ বন্ধ করে ধ্যান করছেন। সকালের কুয়াশা, গাছের পাতার ভেজা গন্ধ আর শরীর চর্চায় ব্যস্ত মানুষের সমাহার সব মিলিয়ে এক জীবন্ত দৃশ্য।

৬০ বছর বয়সী কামরুন নাহার বলেন, ‘আমরা কয়েকজন নারী মিলে হাঁটি প্রতিদিন। কারও ইনসুলিন চলছে, কেউ ওষুধ খায়, কেউ আবার নতুন রোগী। আমরা একে অপরকে উৎসাহ দিই। হাঁটার কারণে আমাদের সম্পর্কও তৈরি হয়েছে, একে অপরের পাশে দাঁড়াই।’

এই বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশই অনেককে অনুপ্রাণিত করে নিয়মিত আসতে। প্রতিদিনের হাঁটাকে তারা শুধুই শারীরিক ব্যায়াম নয়, মানসিক প্রশান্তির মাধ্যম হিসেবে দেখেন।

রমনা পার্কের প্রবেশপথে বসা ছিলেন ৪৮ বছর বয়সী করিমুল ইসলাম। তিনি বললেন, ‘আমি আগে অফিস শেষে রাতে ঘুমাতাম দেরিতে, খাবারেও অনিয়ম ছিল। এখন প্রতিদিন সকালে রমনায় আসি। ডায়াবেটিস এখন নিয়ন্ত্রণে, ইনসুলিনের মাত্রাও কমে গেছে। হাঁটা না করলে পারি না আর।’

16

তাঁর মতে, ডায়াবেটিসের সঙ্গে যুদ্ধ মানে শুধু ওষুধ নয়, পুরো জীবনধারার পরিবর্তন। যেভাবে ধীরে ধীরে শরীরে ইনসুলিনের অভাব তৈরি হয়, সেভাবেই ধীরে ধীরে ভালো অভ্যাস গড়ে তুলতে হয়।

চিকিৎসকরা বলছেন, ডায়াবেটিস রোগীর সবচেয়ে বড় শত্রু হলো অলসতা ও মানসিক অবসাদ। সকালে নিয়মিত হাঁটা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী।

অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক রোকসানা হক বলেন, ‘আমি ইনসুলিন নিই, ওষুধও খাই। কিন্তু নিয়মিত ব্যায়াম না করলে ওষুধের প্রভাবও কমে যায়। আমি প্রতিদিন অন্তত ৪০ মিনিট হাঁটি, এতে মন ফুরফুরে থাকে।’

রমনার ভেতরে সকালের সময়টায় দেখা যায় এক অদ্ভুত সমন্বয়। বয়সের পার্থক্য থাকলেও সবার লক্ষ্য এক- শরীরটাকে সচল রাখা। কেউ ধীরে হাঁটছেন, কেউ দ্রুত, কেউ আবার জগিং করছেন। এই নিয়মানুবর্তিতাই তাদের বাঁচিয়ে রাখছে, হয়ত দীর্ঘ জীবন দিচ্ছে।

তবে অনেকেই স্বীকার করেন, শুরুটা সহজ ছিল না। ৫৮ বছর বয়সী বেসরকারি কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, ‘ডায়াবেটিস ধরা পড়ার পর মনে হয়েছিল জীবন শেষ। প্রথম দিকে মনোযোগ ছিল শুধু ইনসুলিনে। পরে বুঝলাম ব্যায়ামই আসল পথ। এখন প্রতিদিন সকালে হাঁটি আর দুপুরে নিয়ম করে খাবার খাই।’

15

রমনা পার্কে হাঁটতে আসা রোগীদের মধ্যে কেউ কেউ সরকারি ডায়াবেটিস হাসপাতালের নিয়মিত রোগী। তারা মাসে একবার চেকআপ করান, খাদ্যতালিকা ঠিক রাখেন। হাঁটার পাশাপাশি অনেকেই হালকা যোগব্যায়াম করেন, যাতে শরীরের নমনীয়তা বজায় থাকে।

চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে দিনে অন্তত ৩০ মিনিটের মাঝারি ধরনের ব্যায়াম অপরিহার্য। তবে তার আগে অবশ্যই রক্তে শর্করার মাত্রা জেনে নেওয়া উচিত। হঠাৎ অতিরিক্ত ব্যায়াম করলে বিপরীত প্রভাব পড়তে পারে।

প্রতিদিন ভোরে রমনা পার্কে দেখা যায় এক নবজাগরণের দৃশ্য। যারা একসময় ওষুধ আর ইনসুলিনের ওপর নির্ভর করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন, তারা এখন প্রকৃতির কোলে ফিরে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করেছেন।
বাবুল তালুকদার শেষবারের মতো হাঁটা থামিয়ে হাসলেন, বললেন, ‘ডায়াবেটিস মানেই জীবন শেষ নয়। এটা একটা শিক্ষা নিজেকে যত্নে রাখার শিক্ষা। হাঁটাটাই আমার সবচেয়ে বড় ওষুধ।’

রমনা পার্কের সকালের সেই দৃশ্য যেন প্রতিদিন মনে করিয়ে দেয় ডায়াবেটিসকে হারানো যায় না হয়ত, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করা যায়, যদি ইচ্ছা আর নিয়ম একসাথে চলে।

এম/জেবি