সাখাওয়াত হোসাইন
১৪ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৩৫ এএম
- ডায়াবেটিসের হার বেড়েছে উদ্বেগজনকভাবে
- দেশে ১ কোটি ৩১ লাখ ডায়াবেটিস রোগী
- ৪৩.৫ শতাংশ আক্রান্তের রোগ নির্ণয় হচ্ছে না
- চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধে জোর বিশেষজ্ঞদের
ডায়াবেটিস এখন শুধু একটি রোগ নয়, বরং বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য সংকট। শুধু ধনী বা শহুরে জীবনের নয়, শহর থেকে গ্রাম—সব জায়গায় এই ‘নীরব ঘাতক’ রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। তরুণরাও আক্রান্ত হচ্ছে ডায়াবেটিসে। দেশে বর্তমানে এক কোটিরও বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। প্রতি বছর এই সংখ্যায় যোগ হচ্ছে লাখো নতুন রোগী। এই অবস্থায় ডায়াবেটিস রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
চিকিৎসকরা বলছেন, পরিবর্তিত জীবনধারা, অস্বাস্থ্যকর খাবার এবং শারীরিক পরিশ্রমের অভাবই এই রোগের বিস্তারের মূল কারণ। আশঙ্কার বিষয়, অনেকেই জানেন না যে, তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, ফলে জটিলতা আরও বেড়ে যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আধুনিক নগরজীবনের ব্যস্ততা, ফাস্টফুড নির্ভরতা এবং অনিয়মিত ঘুম ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আগে যেখানে বয়সভিত্তিক রোগ হিসেবে ধরা হতো, এখন কিশোর–যুবকরাও এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
জাতীয় পুষ্টি ইনস্টিটিউটের সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ২৫ বছর বয়সের পর থেকেই ডায়াবেটিসের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিচ্ছে অনেকের শরীরে। বিশেষ করে যারা অফিসকেন্দ্রিক স্থির জীবনযাপন করেন, তাদের মধ্যে ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি।
তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় এক কোটি ৩১ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগছেন। রোগটিতে ২০ থেকে ৮০ বছর বয়সী ১৪ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ ভুগছেন। উদ্বেগের কারণ হলো, দেশের শতকরা ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ মানুষ জানেই না তারা রোগটিতে আক্রান্ত। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে অষ্টম। দেশে ১০ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয় ডায়াবেটিসে। এই রোগ প্রতিরোধে এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নিলে ২০৪৫ সালে দেশে রোগীর সংখ্যা দুই কোটি ২০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে।
আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৪৩ দশমিক ৫ শতাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের রোগ নির্ণয় হচ্ছে না। এই সংস্থার যে চিত্র, তাতে দেখা যায়, রোগটি বাংলাদেশে ঊর্ধ্বমুখী।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি জানিয়েছে, বাংলাদেশে গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের হার ৬ থেকে ১৪ শতাংশ। এছাড়া গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নারীদের টাইপ–২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি, প্রায় ৫০ শতাংশ। গর্ভকালে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে শিশুদেরও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
গত ৩০ বছরে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হার দ্বিগুণ
ল্যানসেট জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮০ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বর্তমানে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। গত ৩০ বছরে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হার দ্বিগুণ হয়েছে৷ ১৯৯০ সালে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এন্ডোক্রাইন রোগে আক্রান্ত ছিল, যা শরীরের ইনসুলিন উৎপাদনে অক্ষমতার ফলে রক্তে সুগারের স্তর নিয়ন্ত্রণে সমস্যা সৃষ্টি করে। একে ডায়াবেটিস বলা হয়৷ তবে এই হার ২০২২ সালে বেড়ে ১৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে৷ অর্থাৎ, ১৯৯০ সালের প্রায় ২০ কোটি মানুষের তুলনায় বর্তমানে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৮০ কোটি৷ এতে টাইপ ১ এবং টাইপ ২ উভয় ধরনের ডায়াবেটিস অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ইনসুলিন নামক এক প্রকার হরমোনের অভাব হলে কিংবা উৎপাদিত ইনসুলিনের কার্যকারিতা কমে গলে রক্তের গ্লুকোজ দেহের বিভিন্ন কোষে প্রয়োজনমতো ঢুকতে পারে না। ফলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। এ পরিস্থিতিকেই ডায়াবেটিস বলে।
তারা বলেন, ডায়াবেটিস হলো রক্তের শর্করার সঙ্গে সম্পর্কিত একটি দীর্ঘস্থায়ী বিপাকীয় রোগ। ডায়াবেটিস একবার হলে সারা জীবন থাকে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস অন্ধত্ব, হৃদরোগ, কিডনি রোগ, স্ট্রোক, মাড়ির রোগ ও পঙ্গুত্বের মতো কঠিন রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এ রোগের চিকিৎসা না নেওয়া হলে হৃৎপিণ্ড, রক্তনালি, স্নায়ু ও অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতি হতে পারে। এই রোগটিতে যেকোনো বয়সী আক্রান্ত হতে পারে। বর্তমান সময়ে ব্যাপক হারে তরুণরাও আক্রান্ত হচ্ছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) সহযোগী অধ্যাপক ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ ডা. শাহজাদা সেলিম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ডায়াবেটিস একটি মারাত্মক রোগ। জীবনের প্রতিটি পদে পদে বাধা সৃষ্টি করে। ডায়াবেটিস একবার হলে ভালো হয়ে যাবে, এখনো এমন কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি বের হয়নি। জীবন চিকিৎসা নিতে হবে। এর মানে এই নয়, আজীবন ওষুধ খাবে; এরকম নাও হতে পারে। যারা স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে চলেন তাদের ওষুধ দিয়ে কমানো যায়। তবে সবার মনে রাখতে হবে, তাদের ডায়াবেটিস আছে। এখন পরিমাণ কমে গেছে বা কিছুদিনের জন্য সমস্যা করছে না।’
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘ডায়াবেটিস চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ বেশি জরুরি। শুধু ওষুধের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে বরং জীবনযাপনে গুণগত ও স্বাস্থ্যগত পরিবর্তন আনা গেলেই সত্যিকারের সুফল মিলবে। সেই সঙ্গে ডায়াবেটিস প্রতিরোধে মানসিক চাপমুক্ত থাকা ও অতিভোজন এড়িয়ে চলতে হবে।

চিকিৎসায় নানা সংকট
ডায়াবেটিসের চিকিৎসা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বাংলাদেশে ডায়াবেটিস চিকিৎসার প্রধান সংকটগুলো হলো, প্রায় ৪৩.৫% রোগীর রোগ নির্ণয় না হওয়া, সঠিক সচেতনতার অভাব রয়েছে। সেইসঙ্গে দেশের বিশালসংখ্যক রোগীর তুলনায় চিকিৎসার সুযোগ সীমিত হওয়া। এছাড়াও, এই রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে সুস্থ জীবনযাপন, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এবং গবেষণার মতো বিষয়গুলোর ওপর জোর দেওয়া জরুরি, যা বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক ক্ষেত্রে অনুপস্থিত।’
অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, ‘ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সেন্টার তৈরি করতে হবে। যাতে চিকিৎসা সেবা মানুষের হাতের নাগালে থাকে। একইসঙ্গে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। এই খাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে বরাদ্দ দিতে হবে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিরোধ ও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণযোগ্য হলেও শুধু অজ্ঞতার কারণে ডায়াবেটিসজনিত জটিলতায় বাড়ছে অন্ধত্ব, হৃদরোগ, কিডনি রোগ, স্ট্রোক ও পঙ্গুত্বের মতো জটিল রোগের ঝুঁকি এবং ডায়াবেটিসের ফলে আক্রান্ত রোগীরা নানা রোগে আক্রান্ত হন। চিকিৎসার অভাবে কখনো মৃত্যুর ঝুঁকিও তৈরি হয়।
প্রতিরোধে করণীয়
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, জীবনে যেকোনো সময়ে, যেকোনো বয়সী মানুষই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারেন। মাঝে মাঝে রক্তের সুগার পরীক্ষার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপন করতে হবে। গত তিন দশকে ডায়াবেটিসের হার উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। স্থূলতা বৃদ্ধি, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যের বিপণন, শারীরিক কার্যক্রমের (ব্যায়াম) অভাব এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।
তারা বলছেন, ডায়াবেটিস হলো সব রোগের জননী। এটি হলে অন্ধত্ব, হৃদরোগ, কিডনি রোগ, স্ট্রোক ও পঙ্গুত্বের মতো সব রোগ দেহে বাসা বাঁধবে। তাই দেরি না করে যেকোনো বয়সে যেকোনো সময় নিজের রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ জেনে নিতে হবে এবং পরীক্ষা করতে হবে।
চিকিৎসকরা বলেন, উন্নত বিশ্বস্বাস্থ্যের জন্য ডায়াবেটিসের কারণে সৃষ্ট পঙ্গুত্বসহ অন্যান্য সম্ভাব্য পরিণতির কথা মাথায় রেখে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং ব্যায়ামের মাধ্যমে এটিকে প্রতিরোধ করতে হবে। এজন্য নিম্ন-আয়ের দেশগুলোতে স্বাস্থ্যকর খাবার সহজলভ্য করে এবং ব্যায়ামের সুযোগ বাড়াতে হবে।
ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ ডা. তাহমিনা ফেরদৌসী বলেন, ‘ডায়াবেটিস ব্যবস্থাপনা ১০০ মিটার দৌড় নয়, এটি একটি ম্যারাথন। এই দীর্ঘমেয়াদী রোগটির সঠিক ব্যবস্থাপনায় যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন রোগীর স্ব-যত্ন এবং চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যে একটি শক্তিশালী পার্টনারশিপ। এই সম্পর্ক ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের একটি অদৃশ্য কিন্তু সবচেয়ে শক্তিশালী ওষুধ।’
এসএইচ/জেবি