আব্দুল হাকিম
১৪ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:১৯ এএম
- বারডেম পরিচালিত জরিপে মিলেছে নানা তথ্য
- ইনসুলিনের সুফল পাচ্ছেন না প্রায় অর্ধেক রোগী
- নিয়মিত ব্যায়াম করেন না ১০.৭ শতাংশ
- খাদ্যতালিকা অনুসরণ করেন না ৮৪ শতাংশ
- শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপনে নিয়ন্ত্রণে থাকবে ডায়াবেটিস
রাজধানীর মিরপুর–১১ এলাকায় থাকেন মজিবুর রহমান দেওয়ান (৬৮)। তিনি প্রায় ১০ ধরে টাইপ–২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তার দাবি, প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা নিয়মিত ইনসুলিন নেন, তবু তার রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে আসে না। তিনি বলেন, অনেক সময় মনে হয়, যত চেষ্টা করি, ততটাই অকার্যকর হচ্ছে। কখনো ইনসুলিন নেওয়া বাদ দিয়ে দিই, আবার কখনো ভুলে যাই। ডাক্তারের দেওয়া খাদ্য তালিকা ঠিক মতো মেনে চলি, কিন্তু চা খাওয়া হয় বেশি, মাঝে মাঝে চিনি দিয়েও খেয়ে ফেলি।
সম্প্রতি বারডেম জেনারেল হাসপাতালের গবেষণায় দেখা গেছে, মজিবুর রহমান দেওয়ানের মতো প্রায় অর্ধেক রোগী ইনসুলিন নেওয়ার পরও কাঙ্ক্ষিত গ্লাইসেমিক লক্ষ্য পূরণ করতে পারছেন না। ৩৮৪ জন রোগীর ওপর পরিচালিত এই গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের ৬৪ শতাংশ নারী এবং প্রায় ৭৪ শতাংশই স্থূলকায়। গড়ে তারা ১২ বছর ধরে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এবং প্রায় চার বছর ধরে ইনসুলিন ব্যবহার করছেন। তাদের সবারই ইনসুলিন ব্যবহারের অভিজ্ঞতা ছিল।
গবেষকরা জানিয়েছেন, এর মূল কারণ ইনসুলিন ডোজ বাদ দেওয়া, খাদ্যতালিকা না মানা, নিয়মিত ব্যায়ামের অভাব, ভয় ও অজ্ঞতা। গবেষণাটি পরিচালনা করেন চিকিৎসক মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম, মিতা দত্ত, মালিহা তাবাসসুম, শফিকুল ইসলাম, ইসরাত রেজওয়ানা, উম্মে সুমাইয়া, পারিজাত ঘোষ, ফারিয়া আফসানা, ফেরোজ আমিন ও এসএম আশরাফুজ্জামান।
গবেষণায় দেখা যায়, অংশগ্রহণকারীদের গড় বয়স ৫৬ বছর। তাদের মধ্যে ৬৪ শতাংশ নারী এবং প্রায় ৭৪ শতাংশই স্থূলকায়। গড়ে ১২ বছর ধরে তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এবং প্রায় ৪ বছর ধরে ইনসুলিন ব্যবহার করছেন। তবে ইনসুলিন নেওয়ার পরও অধিকাংশ রোগীর রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে আসছে না—এমন চিত্রই উঠে এসেছে গবেষণায়। গবেষণায় দেখা গেছে, ৪৬ দশমিক ৪ শতাংশ রোগী নিয়মিত ইনসুলিন নেননি বা মাঝেমধ্যে বাদ দিয়েছেন। ৮৪ শতাংশ রোগী চিকিৎসকের দেওয়া খাদ্যতালিকা অনুসরণ করেননি এবং মাত্র ১০ দশমিক ৭ শতাংশ রোগী নিয়মিত ব্যায়াম করেছেন। প্রায় ৫৫ শতাংশ রোগী কখনোই রক্তে শর্করার মাত্রা পরিমাপ করেননি, সপ্তাহে একবার পরীক্ষা করেন মাত্র ৮ শতাংশ।
গবেষকদের মতে, ইনসুলিন না নেওয়ার অন্যতম কারণ হলো ভয় এবং অজ্ঞতা। অনেকেই মনে করেন, ইনসুলিন নিলে শরীরে ক্ষতি হয়, ওজন বেড়ে যায় বা কমে যায়। এই ধরনের ভুল ধারণা এখনো সমাজে প্রচলিত। আবার অনেকে হাইপোগ্লাইসেমিয়া (রক্তে শর্করার হঠাৎ কমে যাওয়া) এর ভয়েই ডোজ ঠিকমতো সমন্বয় করেন না। মাত্র ৩৯ দশমিক ৬ শতাংশ রোগী জানেন তাদের রক্তে শর্করার লক্ষ্যমাত্রা কত হওয়া উচিত। ইনসুলিনের ডোজ কবে ও কীভাবে বাড়াতে বা কমাতে হয়—তা জানেন মাত্র ৩৮ শতাংশ। অথচ নিয়ন্ত্রণহীন রক্তে শর্করা দীর্ঘমেয়াদে কিডনি, চোখ, হৃদযন্ত্র ও স্নায়ুর মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করে।
গবেষক দল বলছে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে `রোগী শিক্ষাই’ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক রোগীকে ইনসুলিনের সঠিক ব্যবহার, ডোজ সমন্বয়, খাদ্যতালিকা, ব্যায়াম ও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। পাশাপাশি হাসপাতালে নিয়মিত কাউন্সেলিং ও ফলোআপ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। ইনসুলিনের প্রতি ভয় দূর করতে হবে সচেতনতামূলক প্রচারণার মাধ্যমে। গণমাধ্যম, সামাজিক সংগঠন ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। ইনসুলিন না নেওয়া কিংবা অনিয়মিতভাবে নেওয়া মানেই জটিলতার ঝুঁকি বাড়ানো। প্রতিটি রোগীরই নিজের রোগ সম্পর্কে জ্ঞান থাকা জরুরি। যত বেশি সচেতনতা, তত কম জটিলতা।

বারডেমের গবেষক দল বলেছে, অধিকাংশ রোগীরই জ্ঞান ও সচেতনতার অভাব রয়েছে। ইনসুলিনের প্রয়োগ, ডোজ সমন্বয়, নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও খাদ্যনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে যথাযথ শিক্ষা না থাকায় কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাচ্ছে না। রোগীদের ৭০ শতাংশই উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলেন, ২৪ শতাংশের কিডনির সমস্যা, ২৬ শতাংশের রেটিনোপ্যাথি (চোখের জটিলতা) এবং ১৮ শতাংশের ছানি ছিল। অর্থাৎ, দীর্ঘমেয়াদি অনিয়ন্ত্রিত রক্ত শর্করার ফলেই এসব জটিলতা দেখা দিয়েছে। রোগীদের একাংশ ইনসুলিন বাদ দেন নিয়মিতভাবে। আবার কেউ কেউ একদিন ইনজেকশন দেন, পরের দিন ভুলে যান বা ভয় পান। ফলে শরীরে ইনসুলিনের ভারসাম্য নষ্ট হয়, রক্তে শর্করার ওঠানামা শুরু হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ইনসুলিন নেওয়ার পাশাপাশি ওষুধও খাচ্ছেন (ইনসুলিন+ট্যাবলেট), তাদের রক্তে শর্করার নিয়ন্ত্রণ তুলনামূলক ভালো। আবার যারা শুধু ইনসুলিনের ওপর নির্ভর করছেন, তাদের মধ্যে নিয়ন্ত্রণহীনতার হার বেশি। স্থূলতা, শারীরিক অনিয়ম, ইনসুলিন ডোজ বাদ দেওয়া, খাদ্যাভ্যাসে অবহেলা এবং রক্তে শর্করার পর্যবেক্ষণের অভাব—এই পাঁচটি কারণই মূল বাধা হিসেবে কাজ করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডায়াবেটিসের কার্যকর চিকিৎসা শুধু ওষুধ বা ইনসুলিনের ওপর নির্ভর করে না; এর সঙ্গে জীবনযাপন পদ্ধতি, খাদ্যাভ্যাস, মানসিক ভারসাম্য ও নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রমের বড় ভূমিকা রয়েছে। যারা নিয়মিত ব্যায়াম করেছেন এবং খাদ্যতালিকা মেনেছেন, তাদের মধ্যে গ্লাইসেমিক নিয়ন্ত্রণ তুলনামূলক ভালো ছিল। ইনসুলিন পেন ব্যবহারকারীদের মধ্যে রক্তে শর্করার নিয়ন্ত্রণ তুলনামূলক ভালো, কিন্তু যারা সিরিঞ্জ ব্যবহার করেছেন, তাদের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ খারাপ। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ইনসুলিন পেন সহজে ব্যবহারযোগ্য, ডোজ নির্ভুল এবং ইনজেকশনের প্রতি ভয় কমায়। অন্যদিকে, প্রিমিক্সড ইনসুলিন ব্যবহারকারীদের নিয়ন্ত্রণ সবচেয়ে খারাপ পাওয়া গেছে। বরং বেসাল-বোলাস পদ্ধতিতে ইনসুলিন নেওয়া রোগীদের গ্লাইসেমিক নিয়ন্ত্রণ অনেক উন্নত।
আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ) এর ডায়াবেটিস এটলাস ডায়াবেটিসের বৈশ্বিক প্রভাব সম্পর্কে সর্বশেষ যে পরিসংখ্যান এবং তথ্যে দেখা যায়, ২০২১ সালে ৫৩.৭ কোটি মানুষ (প্রতি ১০ জনে এক জন) ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন। ২০৩০ সালের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৬৪.৩ কোটিতে এবং ২০৪৫ সালে ৭৮.৩ কোটিতে পৌঁছানোর আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া- ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ২৪ কোটি মানুষ (প্রতি ২ জনে ১ জন) জানেন না, তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তাদের অধিকাংশই টাইপ-২ ডায়াবেটিস আক্রান্ত। ১২ লক্ষেরও বেশি শিশু ও কিশোর (০-১৯ বছর) টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ২০২১ সালে বিশ্বের ৬৭ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসের কারণে মৃত্যুবরণ করেন। ২০২১ সালে ৯৬৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয় ডায়াবেটিসের কারণে, যা বৈশ্বিক স্বাস্থ্য খাতে মোট ব্যয়ের ৯%।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, যার মধ্যে প্রায় ৮২ শতাংশের রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে নেই। ডায়াবেটিস চিকিৎসায় আন্তর্জাতিক মান অনুসারে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নির্ধারিত সীমার মধ্যে রাখতে হবে; তা না হলে মাইক্রোভাসকুলার ও হৃদরোগজনিত জটিলতা বাড়ে।
গবেষক মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম বলেন, ইনসুলিন ব্যবহারে ভয়, লজ্জা, সামাজিক কুসংস্কার, আর্থিক সীমাবদ্ধতা ও জ্ঞানের অভাব এখনো আমাদের বড় বাধা। অনেক রোগী মনে করেন, ইনসুলিন শুরু করলে সারাজীবন নিতে হবে, তাই ভয় পান। কিন্তু এই ভয়ই তাদের জটিলতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী ঢাকা মেইলকে বলেন, ডায়াবেটিস এখন বিশ্বব্যাপী মহামারির মতো বাড়ছে। বাংলাদেশেও গড়ে প্রতি পাঁচ-ছয়জন মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এটি একেবারে সেরে যায় না, তবে সঠিক নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। রোগ নিয়ন্ত্রণের মূল চাবিকাঠি হলো জীবনযাপন পদ্ধতি, খাদ্যাভ্যাস ও ওষুধের সঠিক ব্যবহার।
ডা. লেলিন বলেন, জীবনযাপন গতিশীল রাখতে হবে। প্রতিদিন যে পরিমাণ ক্যালোরি গ্রহণ করা হয়, তা পোড়ানোর জন্য হাঁটা বা ব্যায়াম অপরিহার্য। খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে—রক্তে সুগার বাড়ানোর খাবারগুলো বাদ দিতে হবে। ডায়াবেটিসের ধরন অনুযায়ী ওষুধের ধরনও আলাদা হয়। কখনো ইনসুলিন, কখনো মুখে খাওয়ার ওষুধ প্রয়োগ হতে পারে। টাইপ-২ বা প্রাপ্তবয়স্ক ডায়াবেটিসে ভিন্ন, শিশুদের ক্ষেত্রে ভিন্ন চিকিৎসা প্রয়োগ হয়। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা আবশ্যক।
ডায়াবেটিস শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে প্রভাবিত করে—কিডনি, হার্ট, চোখ, নার্ভ, হাত ও পা। অনিয়ন্ত্রিত সুগার শরীরকে নানা রোগের জন্য প্ররোচিত করে।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ফসলের মতো শরীরও যত্নের দাবি রাখে। সুগার নিয়ন্ত্রণে না থাকলে শরীরে অন্যান্য রোগ দ্রুত বাসা বাঁধে। শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপন, নিয়ন্ত্রিত খাদ্য ও সঠিক ওষুধ গ্রহণের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এই তিনটি নিয়ম মেনে চললে রোগী সুস্থ ও পূর্ণাঙ্গ জীবন যাপন করতে পারে।
বারডেম হাসপাতালের ডেন্টাল সার্জারি বিভাগের ভিজিটিং প্রফেসর অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী জানান, ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য মুখের স্বাস্থ্য অপরিহার্য। ডায়াবেটিসের কারণে রক্তে উচ্চমাত্রার গ্লুকোজ থাকে, যা লালায়ও বৃদ্ধি পায়। এর ফলে দাঁত, মাড়ি, জিহ্বা ও মুখের অন্যান্য অংশে প্রদাহ বা ইনফেকশন হতে পারে। মুখে এই সমস্যা থাকলে ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়। লালা কমে গেলে দাঁতের ক্ষয়, মাড়ির রোগ বা পিরিওডন্টাল ডিজিজের ঝুঁকি বাড়ে। নিয়মিত দাঁত ও মাড়ির যত্ন, স্কেলিং এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা মুখকে সুস্থ রাখে এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ভালো মুখের যত্ন হৃদরোগ, কিডনি রোগসহ অন্যান্য জটিলতা কমাতেও সহায়ক। ডায়াবেটিক রোগী যদি নিয়মিত ওষুধ, ব্যায়াম, খাদ্য এবং মুখের স্বাস্থ্য সঠিকভাবে মেনে চলে, তবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হয়।
এএইচ/জেবি