images

হেলথ

দেশে ডায়াবেটিস রোগীদের বার্ষিক ব্যয় ৭১ হাজার কোটি টাকা

মো. আব্দুস সবুর (লোটাস)

১৪ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:০২ এএম

আসমা বেগম, বয়স ৫৮। নওগাঁ জেলার বাসিন্দা। পাঁচ বছর আগে ডায়াবেটিস রোগী হিসেবে চিহ্নিত হন। এরপর থেকে ওষুধ খাওয়া শুরু। গত দেড় বছর ধরে এই রোগের সঙ্গে কিডনির সমস্যা ও উচ্চরক্তচাপও দেখা দিয়েছে। শুরুর দিকে দুই হাজার টাকা দিয়ে মোটামুটি ওষুধ খরচ চললেও এখন সেটি ১০ হাজারের বেশি হয়েছে।

আসমা বেগমের মেয়ে আশা আহমেদ বলেন, শুধু তার মায়ের ওষুধের পেছনে খরচ করতে হয় ১০ হাজার টাকারে বেশি। এছাড়া বিভিন্ন পরীক্ষা ও ডায়ালাইসিসের সময় আরও অনেক বেশি খরচ হয়।

শুধু আসমা বেগম নন, এভাবে অকাতরে অর্থ ঢালতে হয় প্রতিটি ডায়াবেটিস রোগীর। একবার কেউ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে গেলে তা থেকে আর নিস্তার নেই। ফলে খরচের মাত্রাও দিন দিন শুধু বাড়তেই থাকে।  
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই রোগের বিস্তার ঠেকাতে সবচেয়ে জরুরি হলো মানুষদের সচেতন করা। সবাই জীবনযাপনের ব্যাপারে সচেতন হলে এটি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। আর অবহেলা করলে চিকিৎসা ব্যয়ের পাশাপাশি মৃত্যুর ঝুঁকিও বাড়বে। ফলে এখনই অন্তত জেলা হাসপাতালগুলোতে অ্যান্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ খোলা ও চিকিৎসক বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের তথ্য অনুসারে, দেশে এই মুহূর্তে এক কোটির বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তবে বেসরকারি হিসাব অনুসারে এই সংখ্যা দেড় কোটির কাছাকাছি। ৩০ বছরের বেশি বয়সের সবাইকে পরীক্ষা করলে এই সংখ্যা আরও বাড়বে। অথচ তাদের চিকিৎসায় ডায়াবেটিস ও হরমোন বিশেষজ্ঞ (অ্যান্ডোক্রাইনোলজিস্ট) চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ১৫০ জন। সে হিসেবে রোগীর সেবায় চিকিৎসকের সংখ্যা অতি নগণ্য। দেশে অসংক্রামক রোগের মধ্যে অন্যতম ডায়াবেটিস রোগ। এর চিকিৎসাসেবা ব্যয়বহুল। ফলে রোগীদের বিশাল অংশ সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছেন না।

ডায়াবেটিস রোগীদের ব্যয়

বেসরকারি সংস্থার পরিসংখ্যা অনুসারে, দেশের ডায়াবেটিস রোগীর মাসিক গড় খরচ সাধারণত চার হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা। যার মধ্যে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে মাসে ৫০০ থেকে এক হাজার; মুখে খাওয়ার ওষুধে (ওরাল মেডিসিন) ব্যয় দেড় হাজার থেকে তিন হাজার টাকা। যেমন মেটফরমিন, গ্লাইমিপিরাইড প্রভৃতি ওষুধ সাধারণত ব্যবহৃত হয়। যারা ইনসুলিন ব্যবহার করেন, তাদের খরচ তুলনামূলক বেশি, মাসে দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। এছাড়া যারা গ্লুকোমিটার ব্যবহার করেন, তাদের মাসে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। কারণ সাধারণত ১৫–২০ বার পরিমাপের জন্য আলাদা স্ট্রিপ ব্যবহার করতে হয়। খাদ্য ও জীবনধারার পরিবর্তনের জন্যও অতিরিক্ত ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা খরচ যুক্ত হয়।

এই পরিসংখ্যানের অনুসারে সর্বনিম্ন চার হাজার টাকা খরচ ধরলে দেশের দেড় কোটি রোগীর মাসে মোট ব্যয় ছয় হাজার কোটি টাকা। যা বছরে ৭২ হাজার কোটি টাকার মতো।

4

যেভাবে বাড়ে ডায়াবেটিস রোগীর ব্যয়

বিশেষজ্ঞরা সব অসুখের অন্যতম নিয়ামক হিসেবে ডায়াবেটিসকে দায়ী করেন। এছাড়া গবেষণা পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, এই রোগে চিহ্নিত ব্যক্তিদের ৭০ শতাংশের উচ্চ রক্তচাপ শুরু হয়। ৭ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত রোগীর কিডনি জটিলতা দেখা যায়। এছাড়া স্ট্রোক ও চোখে কম দেখার ঝুঁকি কয়েক গুণ বেড়ে যায়। ফলে এই রোগের ব্যাপারে অবহেলা করলে অন্যান্য রোগ শরীরে বাসা বাঁধে। এতে পরীক্ষা থেকে ওষুধপত্র সব কিছু বেড়ে যায়। ফলে সার্বিক খরচের মাত্রাও বাড়ে।

ঢাকার মিরপুর এলাকার বাসিন্দা আজমল হোসেন বলেন, আমি গত ছয় বছরের বেশি সময় ধরে ডায়াবেটিকে আক্রান্ত। নিয়মিত পরীক্ষা করি। অনেক সময় এটির মাত্র কমে যায়, আবার অনেক সময় বেড়ে যায়। সব মিলিয়ে মাঝামাঝি অবস্থায় ছিলাম গত কয়েক বছর ধরে। কিন্তু চলতি বছরের শুরুতে আমার কিডনির সমস্যা শুরু হয়। এতে আগে যে পরিমাণ ওষুধ খেতাম এখন তা অনেক বেড়ে গেছে। খরচও বেড়েছে কয়েক গুণ। ফলে চিকিৎসা ব্যয় মিটিয়ে সংসার চালাতেই হিমশিম খাচ্ছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ যা শুরু থেকে প্রতিরোধ করা না গেলে নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে। এর ফলে রোগীর ব্যয় কয়েক হাজার থেকে লাখেও চলে যেতে পারে। তাই এই রোগের ব্যাপারে প্রচুর সচেতনামূলক ক্যাম্পেইন করতে হবে। এটি ছাড়া দেশের ডায়াবেটিস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।

ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, দেশে এমন পরিবার নেই, যে পরিবারে অন্তত একজন ডায়াবেটিক রোগী অথবা ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে আছেন এমন মানুষ নেই। ফলে পরিবারকে ডায়াবেটিস থেকে রক্ষা করতে হলে এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।

বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি বলছে, শারীরিক পরিশ্রম এবং খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে সচেতন না হলে দেশের স্বাস্থ্যখাতে বড় দুর্যোগের নিয়ে আসছে ডায়াবেটিস।

ডায়াবেটিস নিয়ে শঙ্কা ও প্রতিরোধের উপায়

বর্তমানে দেশে প্রায় দেড় কোটি ডায়াবেটিস রোগীর রয়েছে। সেদিক থেকে এটি জাতীয় সমস্যা বা রোগ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আগামী এক যুগের মধ্যে সবচেয়ে ব্যয়বহুল রোগ হিসেবে এটি জায়গা করে নেবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ গবেষক ও চিকিৎসকরা। এটি নিয়ন্ত্রণের জন্য সচেতনতা সবচেয়ে জরুরি বলেও মত দিয়েছেন তারা।

ডায়াবেটিসের খরচ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ডায়াবেটিস হয়ে গেলে তখন খচর কমানো কঠিন। কারণ এই রোগের কিছু নির্দিষ্ট খরচ রয়েছে। যেগুলো কমানো সম্ভব নয়। আমাদের উচিত এই রোগটি হতে না দেওয়া। যেসব কারণে ডায়াবেটিস হচ্ছে সেগুলো থেকে নিজেকে রক্ষা করা।

এই অধ্যাপক বলেন, এই রোগ হওয়ার অন্যতম কারণ হলো আমাদের কায়িক বা শারীরিক পরিশ্রম কমে যাওয়া। ফাস্ট ফুডসহ সবর্দা ভাতের ওপর নির্ভরশীল হওয়া। তাই এসব ব্যাপারে স্কুলের বাচ্চাদের থেকে শুরু করে সবার মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো দরকার। এছাড়া উপজেলা ও কমিউনিটি ক্লিনিকে এই রোগের সেবা চালু করা। কারণ দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী এই ব্যাপারে এখনো সচেতন নয়। গ্রামের অনেক মানুষ রয়েছে যাদের পরীক্ষা করলে ডায়াবেটিস ধরা পড়বে, কিন্তু সেটি করা হয় না। ফলে অনেক সময় মেজর স্টেজে এসে এই রোগ শনাক্ত হয়।

ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, দেশের সব ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সচেতনতার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। স্মার্ট সিস্টেমের সহযোগিতা নিতে হবে। একজন মানুষ নিয়মিত শরীর চর্চা, হাঁটাহাঁটিসহ বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকলে তার শরীরে রোগটি বাসা বাঁধতে পারে না।

এই রোগের বিস্তাররোধে পরামর্শ পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ দেশে খুবই কম রয়েছে। তাই এর বিস্তার রোধে পাবলিক-প্রাইভেট পাটর্নারশিপের মাধ্যমে একটি সমন্বিত ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। যার মাধ্যমে ডাক্তারসহ সহযোগীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাস্থ্যসেবা গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে দিতে হবে। এছাড়া পাঠ্যবই, বিনোদন মাধ্যম, পথে-ঘাটে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ সব জায়গায় সচেতনতার ক্যাম্পেইন করতে হবে। সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এটি রোধ করা সম্ভব নয়।

এএসএল/জেবি