আব্দুল কাইয়ুম
২৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:১৫ পিএম
রাজধানীর বস্তিগুলোতে বসবাস করেন স্বল্প আয়ের মানুষ। কেউ রিকশা চালান, কেউ সুইপারের কাজ করেন, আবার কেউবা অন্যের বাসায় কাজ করে সংসার চালান। অনেকদিন ধরেই দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিয়েছে। এছাড়া অন্যান্য রোগেও আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। বাদ যাননি বস্তিবাসীও। কিন্তু চিকিৎসা খরচ বহন করার সামর্থ্য না থাকায় বস্তির অধিকাংশ বসিন্দাই চিকিৎসাসেবা নিতে হিমশিম খাচ্ছেন। দিনের পর দিন জ্বরে আক্রান্ত অনেকে ঘরেই থাকছেন, আবার অনেকের মৃত্যু হলেও পরিবার জানে না ‘কোন রোগে প্রিয়জনকে হারালেন।’
স্বল্প আয়ের এসব বস্তিবাসী বলছেন, সরকারি হাসপাতালে গেলে ডাক্তার দেখানো থেকে শুরু করে টেস্ট পর্যন্ত চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ায় বাধ্য হয়েই তারা বস্তির পাশের ফার্মেসিগুলোর ওপর নির্ভর করেন। এসব ফার্মেসি থেকেই ‘ছোট-বড়’ সব রোগের অসুখ কিনে খেতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর, মিরপুর ও কড়াইল বস্তিতে গিয়ে কথা হয় বেশ কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে। তারা জানান, সরকারি হাসপাতালে সেবা নিতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। অনেক সময় টেস্টের কাগজ হাতে পাওয়ার আগেই বন্ধ হয়ে যায় ল্যাব। আবার বেসরকারি হাসপাতালের বেশি খরচের ভয়ে সেখানে চিকিৎসা নিতেই যান না এসব নিম্ন আয়ের মানুষ।
মিরপুরের রূপনগর বস্তির শ্রমজীবী হালিমা বেগমের স্বামী আব্দুল কাদের সম্প্রতি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে হালিমা বলেন, “আমি মানুষের বাসায় কাজ করি, আমার স্বামী রিকশা চালাতো। এক রাতে বাসায় আসার পর তীব্র জ্বর এলে ফার্মেসি থেকে ওষুধ এনে খাওয়াই। তিন দিন পর পেটে ব্যথা শুরু হয়। পরে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যাই। টিকিট কাটতে আর ডাক্তার দেখাতে দেড়-দুই ঘণ্টা চলে যায়। ডাক্তার কয়েকটি টেস্ট দেয়। হাসপাতালেই নাকি এসব টেস্ট করা হয়। কিন্তু টেস্টের রুমের সামনে গিয়ে দেখি টেস্ট করা বন্ধ হয়ে গেছে। তারপরও মানুষের লম্বা সিরিয়াল। পরে এক ব্যক্তি বাইরে একটা হাসপাতাল থেকে টেস্ট করিয়ে নিতে বলেন। তার কথায় বাইরে একটা হাসপাতালে গেলে সেখানে সর্বমোট ১২’শ টাকা আসে। কিন্তু আমার কাছে মাত্র ৫০০ টাকা থাকায় টেস্ট না করিয়েই বাসায় নিয়ে আসি। বাসায় আসার পর তিন দিন পর মারা যায় আমার স্বামী।’
মোহাম্মদপুর রায়েরবাজার বস্তির বাসিন্দা সোনিয়া বেগমের অভিজ্ঞতাও প্রায় একই রকমের। তিনি বাবাকে চিকিৎসা করাতে গিয়ে এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন।
সোনিয়া বলেন, ‘আমার বাবা কয়েকদিন ধরে জ্বরে আক্রান্ত ছিল। ঠিকমতো দাঁড়াতে পারত না। আমরা আশপাশে মানুষের কথায় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে টিকিট কাটা থেকে ডাক্তার দেখানো পর্যন্ত প্রায় ২ থেকে আড়াই ঘণ্টা চলে যায়। এরপর ডাক্তার দেখাতে গিয়ে লম্বা সিরিয়াল। সব কিছু শেষ করে ডাক্তার টেস্ট করতে বলেন। তা করানোর আগেই হাসপাতালের টেস্টের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, ‘একদিন আমার বাবাকে হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে সকাল ৯টায় গিয়ে দুপুর আড়াইটা বেজে যায়। কিন্তু ডাক্তার দেখিয়ে বের হওয়ার পর টেস্ট করাতে না পারায় ক্ষোভে ফিরে আসি। ডাক্তারের দেওয়া সেই টেস্টগুলো বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর দেখি প্রায় ১৫০০ টাকা লাগে। এতো টাকা না থাকায় বাসায় ফিরে এসে আমাদের বস্তির ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খাওয়াই। এখন আমার বাবা মোটামুটি সুস্থ আছেন।’
বেসরকারি হাসপাতালের অভিজ্ঞতা
ধানমন্ডির বাসিন্দা সাজিয়া আক্তার জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। সেখানে ডাক্তার দেখানোর পর ৮ ধরনের ওষুধ ও এক্স-রেসহ বেশ কয়েকটি পরীক্ষা দেন। সব মিলিয়ে খরচ হয় প্রায় ১৩০০ টাকা। পরে আরও দুটি টেস্টের জন্য তাকে ধানমন্ডির ইবনে সিনা হাসপাতালে রেফার করানো হয়, যেখানে টেস্ট দুটির খরচ ৪৫০০ টাকা। এতো ব্যয়বহুল খরচ দেখে তিনি টেস্ট না করিয়েই হাসপাতাল থেকে বাড়ি যান।
আক্ষেপ করে সাজিয়া আক্তার বলেন, ‘ডাক্তার দেখাতে গিয়ে মনে হয় ভুল করেছি। জ্বরের চিকিৎসা নিতে গিয়ে ডাক্তার আমাকে এক্সরে করাল। এরপর ৭-৮ রকমের ওষুধ লিখে দিল। তা দিয়েই ক্ষান্ত হননি। আবার ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়া রোগের টেস্ট করাতে অন্য হাসপাতালে পাঠালো। যে টেস্টগুলোর দাম ৪ হাজার ৫০০ টাকা। জ্বরের জন্য ডাক্তার দেখাতে গিয়েই আমার প্রায় ৮ হাজার টাকা চলে গেল। এই টাকার মধ্যে না কিনতে পারলাম ওষুধ, না কমলো জ্বর। এমন চিকিৎসা সেবার জন্য কেউ হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে যায় না।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্দেশনা
স্বাস্থ্য অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান স্বাক্ষরিত সাম্প্রতিক এক পত্রে বলা হয়েছে, চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদফতর সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষার ফি নির্ধারণ করে দেয়। এর মেয়াদ ছিল ৩০ জুন পর্যন্ত। নতুন প্রজ্ঞাপনে এ সময়সীমা আগামী বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে এনএস ফর ডেঙ্গু, আইজিজি ফর ডেঙ্গু ও আইজিএম ফর ডেঙ্গু পরীক্ষার সরকারি নির্ধারিত সর্বোচ্চ ফি ৫০ টাকা করার কথা বলা হয়।
এ ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদফতরের আরেকটি আদেশে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনাবিষয়ক নির্দেশনায় বেসরকারি হাসপাতালগুলো এনএস ফর ডেঙ্গু, আইজিজি ফর ডেঙ্গু ও আইজিএম ফর ডেঙ্গু পরীক্ষার ফি ৩০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর সিবিসি পরীক্ষা করাতে ফি নির্ধারণ করা হয় ৪০০ টাকা।
একেএস/এমআর