সাখাওয়াত হোসাইন
২৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:০১ পিএম
ছয় বছরের শিশু মাহবুব হাসান সিয়াম। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত ১৯ অক্টোবর ভর্তি হয়েছে রাজধানীর শিশু হাসপাতালে। বর্তমানে তার সময় কাটছে হাসপাতালের বিছানায়। অস্থিরতার শেষ নেই ছোট্ট এই শিশুর। সে কখনো কাঁদছে, কখনো ব্যথায় ছটফট করছে। সারাক্ষণ পাশে থাকছেন স্বজনরা।
হাসপাতালে সিয়ামের বাবা-মায়ের সঙ্গে কথায় হয় ঢাকা মেইলের। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মুরাদ হাসান বলেন, ‘ছেলের অসুস্থতা নিয়ে পুরো পরিবার উদ্বিগ্ন। একবার জ্বর আসে, আবার চলে যায়। শরীরে অনেক ব্যথা এবং বমি। ছোট মানুষ, ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করতে পারছে না।’
মুরাদ হাসান বলেন, ‘অনেক দুশ্চিন্তা লাগে। এই খারাপ সময়টা কখন কাটবে সেই অপেক্ষায় আছি। ছেলেকে দেখাশোনা করতে পুরো পরিবার নিয়োজিত। আত্মীয়-স্বজনরাও চিন্তিত। শিডিউল করে হাসপাতালে দুজন থাকতে হচ্ছে। কখন কী লাগবে, সেটা দেখাশোনা করতে হচ্ছে। যখন যা প্রয়োজন হচ্ছে, তা আনা হচ্ছে। আমাদের চাওয়া একটাই, ছেলেটা সুস্থ হোক।’
সিয়ামের মা ফাতেমা ইসলাম বলেন, ‘দুদিন জ্বর ছিল, বাসাতে প্রাথমিক ওষুধপত্র খাওয়ানো হয়েছে। জ্বর ভালো না হওয়ায় চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া হয়। পরীক্ষার পর ডেঙ্গু জ্বর ধরা পড়ে। এখন চিকিৎসকের পরামর্শে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।’
এই গৃহিনী বলেন, ‘এখন ভয় লাগে। কারণ, ডেঙ্গুতে অনেক শিশু মারা যাচ্ছে। চিকিৎসকরা আশার বাণী দিয়ে যাচ্ছেন। আশা করছি, ছেলেটা তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে।’
কেউ ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে শুধু রোগীই কষ্টে থাকেন না, ভোগান্তিতে পড়ে পুরো পরিবার। নিয়ম মেনে রোগীদের করতে হয় সেবাযত্ন। রাজধানীর কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের এমন চিত্র দেখা গেছে।
চার দিন ধরে রাজধানীর মহাখালীর ডিএনসিসি হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন নারায়ণগঞ্জ সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী সোহেল রানা। বেডের পাশেই বসে রয়েছেন রানার মা হালিমা আক্তার। হাসপাতালে চিকিৎসক-নার্সদের পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের সময় দিতে হচ্ছে।
জানতে চাইলে হালিমা আক্তার ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘জ্বরের কারণে সোহেল রানা স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করতে পারছে না। গিরায় গিরায় ব্যথা, ক্লান্তি ও অবসাদে ভুগছে। বর্তমানে তার শারীরিক অবস্থা খুবই দুর্বল, নড়তে-চড়তে পারে না এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যাও রয়েছে। তেমন কিছুই খেতে পারছে না।’ তিনি জানান, তাদের সময় কাটছে হাসপাতালে। এতে তাদের পরিবারের জীবনযাত্রা যেমন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি আর্থিক ও মানসিক চাপও বাড়ছে।
জানতে চাইলে রাজধানীর শিশু হাসপাতালের পরিচালক ডা. মাহববুল আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগী প্রতিদিনই আসে। এরমধ্যে এই মাসে ১৩২ জন রোগীকে ভর্তি করা হয়েছে। চলতি মৌসুমে ৫০০ রোগী ভর্তি হয়েছেন। এখন ভর্তি আছেন ৩৫ জন রোগী। আর আউটডোরে প্রাথমিক সেবা দেওয়া হচ্ছে, দৈনিক ২০-২৫ রোগী আসেন। তাদের সেবা দেওয়া হচ্ছে।’
পরিচালক বলেন, ‘হাসপাতালে রোগী আসে গুরুতর পর্যায়ে। যখন রোগী খেতে পারে না এবং বমি করে। জ্বরের জন্য জ্বরের ওষুধ খাওয়াবে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে লিকুইড খাওয়াতে হবে। আর চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী রোগীকে চলতে হবে।’
ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতালের পরিচালক কর্নেল ডা. তানভীর আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘দেশের ডেঙ্গু রোগীদের অন্যতম ঠিকানা এই হাসপাতাল। সারাদেশে যা ভর্তি হয়, তার বড় একটা অংশ এই হাসপাতালে আসে এবং তারা সিরিয়াস রোগী। সেই তুলনায় এই হাসপাতালের বেড সংখ্যা কম। তবু সীমাবন্ধতার মধ্যে ভালো সেবা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
এই চিকিৎসক বলেন, ‘বর্তমানে ২৮৭ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছে। এরমধ্যে শিশু ওয়ার্ড রয়েছে। এছাড়া প্রতিদিন আউটডোরে ৭০০-১০০০ জন রোগী সেবা নিচ্ছেন। সেইসঙ্গে রোগীরা নামমাত্র ফি দিয়ে বিনামূল্যে কয়েকটি সেবা নিতে পারছেন।’
এদিকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকরী উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ধারণা করা হয়, আগামী ৩০-৪০ বছর ডেঙ্গু হতে থাকবে। কারণ, ঢাকার ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সীমিত আকারে কিছু উদ্যোগ রয়েছে। ঢাকার বাইরে মশার নিয়ন্ত্রণ বা অন্য কোনো ধরনের উদ্যোগ নেই বললেই চলে। এর মধ্যে আবার স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিনিধি না থাকায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয় ২০০০ সাল থেকে। এরপর গত ২৫ বছরে আমরা ঢাকায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। আরও যে কত বছর লাগবে সেটাও জানা নেই। ঢাকার বাইরে পাঁচ গুণ মানুষ বসবাস করেন। সুতরাং মশা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে রোগটি আগামী ৩০ বছর থাকবে, এটা খুব সহজে অনুমান করা যায়।’
এ বিষয়ে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মোমেন মজুমদার বলেন, আগে ডেঙ্গু হলে জ্বর হতো, মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা হতো। তবে এবারে ডেঙ্গুর লক্ষণগুলো অন্যরকম। যেমন কেউ তীব্র পেটব্যথা নিয়ে আসছেন, কারও হার্টের সমস্যা বেড়েছে। কারও ব্রেনে ইফেক্ট ফেলেছে। অন্যান্য বছরের চাইতে এবারে এই জটিলতাগুলো অনেক বেশি।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর বলেন, ‘এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি বরিশাল ও ঢাকা বিভাগে। এরপরে রয়েছে চট্টগ্রাম ও রাজশাহী। ঢাকায় বেশি মানুষের বসবাস, সে কারণেই হয়তো ঢাকায় আক্রান্তের সংখ্যাও বেশি।’
স্বাস্থ্যের মহাপরিচালক বলেন, ‘মশা নিধনের কাজ স্বাস্থ্য অধিদফতরের নয়, এটা সিটি করপোরেশনের কাজ। এ কাজের সমন্বয় অতি জরুরি, কিন্তু তা করা হচ্ছে না। জনসচেতনতা বাড়াতে হবে, মশারি লাগিয়ে ঘুমাতে হবে, এছাড়া জ্বর হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।’
এই চিকিৎসক বলেন, ‘আমরা যত ব্যবস্থাই নিই না কেন, জনগণ সচেতন না হলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনা দুষ্কর। ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে এই মৌসুমে। গত বছরের এই সময়টাতে ডেঙ্গু বেড়েছিল। তবে গত বছরের তুলনায় এ বছর এই সময়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি।’
এসএইচ/জেবি