মো. আব্দুস সবুর (লোটাস)
২৭ অক্টোবর ২০২৫, ০১:১৮ পিএম
রাজধানীজুড়ে মশা ও ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। প্রতিদিনই ডেঙ্গুতে মৃত্যুর মিছিল দেখতে হচ্ছে। আক্রান্ত হচ্ছে শত শত। অথচ এবার মশা নিধনে দুই সিটি করপোরেশনের বাজেট রাখা হয়েছে ২৩২ কোটি টাকা। যার মধ্যে শুধু কেমিক্যাল কিনতে ব্যয় করা হবে ১২৪ কোটি টাকা। এসবের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ডেঙ্গু ও মশক নিধন কার্যক্রম নিয়ে চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেছে নগরবাসী।
বিশেষজ্ঞরা জানান, শুধু কেমিক্যাল প্রয়োগ করে মশক নিধন সম্ভব নয়। এর জন্য সমন্বিত পদ্ধতির বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগ করতে হবে। এটি না করার কারণে শুধু অর্থই অপচয় হয়, কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছুই হয় না।
ক্ষোভ প্রকাশ করে নগরবাসীরা জানান, বিভিন্ন পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে শুধু মশা মারার খবর শুনি। কিন্তু বাস্তবে কাজ খুব কমই দেখি। পদে পদে ভোগান্তির শিকার হতে হয় সাধারণ মানুষের। অথচ ট্যাক্সের টাকা অযথা নানাভাবে অপচয় করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব প্রতি বছরই বাড়ছে। ২০১৬ সালে প্রথম ডেঙ্গুতে মানুষ মারা যাওয়া শুরু হয়। তারপর থেকে নিয়মিত এই সংখ্যা বাড়ছে। তবে ২০২৩ সালে সবচেয়ে মারাত্মক রূপ নেয় মশাবাহিত এই রোগ। তখন ১৭০০ জনের বেশি মানুষ মারা যায় এবং আক্রান্ত হয় তিন লাখের বেশি। চলতি বছরও মৃতের সংখ্যা ইতোমধ্যে শয়ের কোটা ছাড়িয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যাও ২৪ হাজারের বেশি।
গত কয়েক বছরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মশক নিধনের বাজেট বেড়েছে কয়েক গুণ। কিন্তু মশার উপদ্রব কমেনি সেভাবে। গত অর্থবছরে দুই সিটিতে মশা নিধনে ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ১৫৪ কোটি টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ঢাকা দক্ষিণ সিটির বরাদ্দ ছিল ৪৪ কোটি টাকা। নতুন অর্থবছরে এক কোটি টাকা বাড়িয়ে মশা নিধনে ৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে সংস্থাটি। অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটিতে মশা নিয়ন্ত্রণ কাজের জন্য ১৮৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। যা মোট বাজেটের ৩ শতাংশ। অথচ আগের বছরে ছিল ১১০ কোটি টাকা। এছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১২৭ কোটি এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮৩ কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ ছিল এই খাতে। ৫ বছরে এই খাতের ব্যয় বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২০২৫-২৬ অর্থবছরে মশা নিয়ন্ত্রণে ১৮৭ কোটি ৫০ লাখ টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছে, যার মধ্যে ৮০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে কীটনাশক কেনার জন্য। গত অর্থবছরে তারা কীটনাশকেই খরচ করেছে ৬৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে, ডিএসসিসি মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে ৪৫ কোটি ৫০ লাখ টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছে, যার মধ্যে ৪৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে কীটনাশক কেনার জন্য। বাকি অর্থ সাধারণত ব্যয় হয় সরঞ্জামে—যেমন: ফগার মেশিন, চাকা, স্প্রে মেশিন, সেগুলো পরিবহন এবং বিশেষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে।
কীটতত্ত্ববিদরা জানান, টেমোফোস, ম্যালাথিওন ও ডেল্টামেথ্রিন দিয়ে সাধারণত ৭০–৮০ শতাংশ পর্যন্ত মশা নিধন করা সম্ভব। তবে কেমিক্যালের প্রতি মশার প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় কার্যকারিতা এলাকা ও সময়ভেদে কমে যেতে পারে। এছাড়া একই ধরনের কেমিক্যাল সব জায়গায় ব্যবহার করে মশক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। মাঠ পর্যায়ে গবেষণা করে কেমিক্যালের প্রয়োগ করতে হবে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সূত্র থেকে জানা যায়, মশা নিয়ন্ত্রণে স্বাভাবিক সময়ের স্প্রে থেকে শুরু করে সব কার্যক্রম চালু রয়েছে। এছাড়া অনেক ধরনের কমিটি করা হয়েছে। কারিগরি কমিটি, স্পেশাল টাস্কফোর্স কমিটি, ওয়ার্কিং কমিটি, ওয়ার্ড লেভেল কমিটি, এখন আবার নতুন কীটনাশকের গুণাগুণ যাচাইয়ের জন্য কমিটি। সব কিছুর পরও মশা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।
অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্র থেকে জানা যায়, প্রতিদিন সকাল-বিকাল প্রতিটি ওয়ার্ডে লার্ভিসাইডিং ও এডাল্টিসাইডিং করা হয়। এ বছর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা আর জনসচেতনতার কাজে জোর দেওয়া হয়েছে। করপোরেশনের প্রতিটি অঞ্চলে ছোট ছোট টিম করে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ করা হচ্ছে। ওয়ার্ড সচিবদের সমন্বয়ে স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা কাজ করছেন।

রাজধানীর মিরপুর এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা নুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রতি বছর দেখি বিভিন্ন সময় মেশিন দিয়ে ধোঁয়া ও ওষুধ দেওয়া হয়। অনেক সময় কিছু দিন পরপর, আবার অনেক দিন পরও এসব প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু মশা সেভাবে কমে না। আগের মতো কিছু না করে, কার্যকর পদ্ধতি ব্যবহার করে মশার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার ঢাকা মেইলকে বলেন, যে পদ্ধতিতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা বা কাজ করা সেটি সঠিক নয়। এভাবে কাজ করলে কখনোই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এটির জন্য সমন্বিত ব্যবস্থার বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগ করতে হবে।
এই অধ্যাপক বলেন, সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার চারটি কম্পোনেন্ট রয়েছে। একটি হলো পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা, দ্বিতীয় অন্য জীব বা প্রাণী দিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ, তৃতীয় হলো কেমিক্যাল ও চতুর্থ হলো জনগণকে সম্পৃক্ত করা। এটি হলো সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা। এটি করতে না পারলে মশা ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। আসলে যেখানে যেটা প্রয়োজন সেখানে সেটার প্রয়োগ করতে হবে। যেমন বাসাবাড়িতে ছোট ছোট পাত্রে এডিস মশার জন্ম হয়, এটিকে উল্টিয়ে রাখলে মশা জন্মাতে পারবে না। এখানে কেমিক্যালের প্রয়োজন নেই। আর এটা জনগণের কাজ, ফলে তাদেরও সম্পৃক্ত করতে হবে।
এ ব্যাপারে কথা বলতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মুহাম্মদ এজাজকে একাধিক বার কল করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
এএসএল/জেবি