মহিউদ্দিন রাব্বানি
২৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:৫১ এএম
যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা, উন্মুক্ত স্থানে পানি জমে থাকা ও স্থানীয় সরকারের উদাসীনতায় রাজধানীতে বেড়েছে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ। ফলে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, মাতুয়াইল, শ্যামপুর ও ডেমরা একালায় ডেঙ্গুর প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে যাত্রাবাবাড়ী ও মাতুয়াইল এলাকায় এখন প্রায় প্রতিটি ঘরেই কেউ না কেউ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত। টানা কয়েক দিনের ভারী বর্ষণের পর এলাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
স্থানীয় হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অনেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন বাসায় থেকে, আবার কেউ কেউ ভর্তি হচ্ছেন ক্লিনিক বা সরকারি হাসপাতালে।
এসব এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, অলিতে-গলিতে এখন মশার উপদ্রব মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। দিনের বেলায় মশা কম থাকলেও সন্ধ্যার পর ঘরে-বাইরে সবখানে মশার যন্ত্রণা। বাসা-বাড়ি থেকে শুরু করে দোকান-পাট, মার্কেট সর্বত্র মশার উপদ্রবে অতিষ্ট জনজীবন।
সপ্তাহখানেক আগে টানা বৃষ্টিতে যাত্রাবাড়ী, দনিয়া, রায়েরবাগ, কাজলার মোড়, ধোলাইপাড়, মাতুয়াইলসহ আশপাশের এলাকায় বিভিন্ন স্থানে পানি জমে। এছাড়া খোলা ড্রেন, রাস্তার পাশে গর্ত, নির্মাণাধীন ভবনের বেসমেন্ট এবং ফেলে রাখা টায়ার বা বোতলে জমে থাকা পানি এখন মশার প্রজনন ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।
রায়েরবাগের বাসিন্দা জাবের হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের গলির ড্রেনটা তিন সপ্তাহ ধরে পরিষ্কার হয়নি। বৃষ্টির পানি জমে আছে এখনো। এতে মশার জন্ম হচ্ছে। আমার পরিবারে এখন তিনজন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। হাসপাতগুলোতেও সিট পাওয়া এখন মুশকিল হয়ে পড়েছে। রোগীর চাপ অনেক বেশি। স্থানীয় প্রশাসনের মশা নিধনে তেমন পদক্ষেপ নেই। শুধু মাঝে মাঝে মশক নিধন স্প্রে করতে দেখা যায় সিটি করপোরেশনের কর্মীদের।’
রাজধানীর শনির আখড়ার বাসিন্দা রেশমা বেগম জানান, তার ছোট ছেলেটা দুই দিন ধরে স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। সরকারি হাসপাতালে সিট না পেয়ে বেসরকারিতে ঠাঁই হয়। তাদের এলাকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই কেউ না কেউ জ্বরে আক্রান্ত। তিনি ভয় পাচ্ছেন, কখন কার কী হয়। তার পরিচিত ও আত্মীয়দের মধ্যেও অনেকে আক্রান্ত হয়েছেন। বাচ্চারাই এখন বেশি আক্রান্ত হচ্ছে বলে জানান তিনি।
ডেমরা এলাকার চা দোকানি রুবেল মিয়া বলেন, ‘বৃষ্টির পর থেকে চারপাশে শুধু মশা আর মশা। সন্ধ্যার পর দোকানে বসে থাকা মুশকিল হয়ে গেছে। প্রতিদিনই কেউ না কেউ জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে।’
আরেক বাসিন্দা শামীমা আক্তার বলেন, ‘বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর থেকেই ছোট মেয়ে অসুস্থ। ডেঙ্গুর ভয় নিয়ে প্রতিদিন আতঙ্কে আছি। সিটি করপোরেশনের গাড়ি সপ্তাহে একবার এলেও কাজের কাজ হয় না। এই মৌসুমে খুব মশা বেড়েছে। বাচ্চার স্কুলের কয়েকজন অভিভাবকও জানালেন, তাদের বাচ্চারাও অসুস্থ।’
এদিকে চলতি বছরের জুনে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এডিস মশার বিস্তার রোধে দ্বিগুণ ওষুধ ছিটানোর সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। কিন্তু স্থানীয়রা বলছেন অন্য কথা। তারা বলছেন, এডিস মশার বিস্তার রোধে সিটি করপোরেশনের কর্মতৎপরতা অপ্রতুল। যাত্রাবাড়ী ও এর আশেপাশের এলাকায় খোলা নর্দমা-ড্রেনের কারণে মশা বাড়ছে। গত সপ্তাহে বৃষ্টির করণে উপদ্রব আরও বেড়েছে। কিন্তু সিটি করপোরেশন বির্বিকার। মশা কম থাকলে যেমন বড়লেও ঠিক একই কাজ। তার মানে তারা নিয়মিত রুটিন দায়িত্ব পালন করছে। উপদ্রব বাড়ার পরও সংস্থাটির নতুন কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান হচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এডিস মশার বিস্তার রোধে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে পরিপক্ব মশা নিধনের কাজে (এডাল্টিসাইডিং) ধোঁয়া দেওয়ার ফগার যন্ত্রে ৩০ লিটার কীটনাশকের পরিবর্তে দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থাৎ ৬০ লিটার কীটনাশক ব্যবহারের সিদ্ধান্ত থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মেডিসিন সংকট রয়েছে, এছাড়া জনবলও কম। তাই একই এলাকায় প্রতিদিন না দিয়ে কয়েক দিন পরপর দিতে হচ্ছে।
যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া ও রায়েরবাগ এলাকায় ছোট-বড় মিলে প্রায় অর্ধশত হাসপাতাল রয়েছে। প্রতিটি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চাপ রয়েছে। সরেজমিনে কয়েকটি হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, রোগীর চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
রাজধানীর মাতুয়াইল শিশু মাতৃসদন হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদা ইউনিট গঠন করা হয়েছে। এতে প্রায় একশ রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে সরকারি হাসপাতালটিতে অতিরিক্ত রোগী হওয়ায় মেজেতেও অনেকে ছাঁটাই বিছিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
এছাড়া শনির আখড়ায় দেশবাংলা হাসপাতাল, অনাবিল হাসপাতাল, সাইনবোর্ডে প্রো-অ্যাকটিভ হাসপাতাল, রায়েরবাগ ইসলামিয়া জেনারেল হাসপাতালেও রোগীর চাপ দেখা গেছে। সব মিলিয়ে এসব এলাকায় ২৫০-৩০০ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে আক্রান্তদের অনেকেই বাসা-বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বেশি অসুস্থ হলেই কেবল তারা হাসপাতালে যান।
মাতুয়াইল শিশু মাতৃসদন হাসপাতালে বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা যায়, জরুরি বিভাগের সামনে সকাল থেকেই ভিড় করছেন রোগীরা। অনেকেই হাতে রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কারও রিপোর্টে ডেঙ্গু পজিটিভ, কেউ আবার পরীক্ষা করাতে এসেছেন। হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. তানিয়া ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘গত সপ্তাহেই আমাদের হাসপাতালে ৮০ জনের বেশি নতুন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ১৫ জনের অবস্থা গুরুতর ছিল। শিশু ও বয়স্ক রোগীদের মধ্যে জটিলতা বেশি দেখা দিচ্ছে।’
তিনি আরও জানান, অনেক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হতে না পেরে বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। কিন্তু সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ না থাকায় তাদের মধ্যে জটিলতা তৈরি হচ্ছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, সিটি করপোরেশনের মশা নিধন কার্যক্রম যথাযথভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। ফগিং মেশিনের গাড়ি খুব কম আসে, আর এলে সেটিও অনেক সময় এক পাশের রাস্তায় দিয়েই চলে যায়। যাত্রাবাড়ীর ধোলাইপাড় এলাকার বাসিন্দা সাজেদুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের এলাকায় ফগিংয়ের গাড়ি শেষ কবে এসেছে মনে নেই। বৃষ্টি হলে তো আর আসে না। এই অবস্থায় কীভাবে মশা কমবে? আর এখন মশা বেশি। এই সময় ঠিক মতো না এলে কবে আর আসবে?’
দনিয়া এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ হাবিব বলেন, ‘প্রতি বছরই বর্ষার সময় ডেঙ্গু বাড়ে। অথচ সিটি করপোরেশনের কাজ দেখা যায় না। বৃষ্টি থামার পরও ফগিং হয় না। খোলা ড্রেন, ময়লার স্তূপ—সব আগের মতোই পড়ে থাকে।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অবশ্য দাবি করেছেন, ফগিং ও লার্ভা নিধন কার্যক্রম নিয়মিত চলছে। তারা বলেন, টানা বৃষ্টির কারণে কিছু জায়গায় কাজ ব্যাহত হয়েছে। তবে আমরা এখন বিশেষ অভিযান শুরু করছি। যদিও স্থানীয়রা বলছেন, প্রশাসনের উদ্যোগ যতক্ষণ না মাঠে কার্যকরভাবে দেখা যায়, ততক্ষণ পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে নাগরিক সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। প্রতি তিন দিনে অন্তত একবার আশপাশে জমে থাকা পানি ফেলে দেওয়া, মশার কয়েল বা স্প্রে ব্যবহার করা, আর শরীর ঢেকে রাখার মতো পোশাক পরা—এসবই এখন জরুরি অভ্যাস হয়ে উঠতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গু মোকাবিলায় সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো প্রতিরোধ। একবার আক্রান্ত হলে চিকিৎসা জটিল ও ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে।
তাই এখনই নাগরিকদের উদ্যোগী হতে হবে। প্রতিটি বাড়ির ছাদ, উঠান, ড্রেন ও আশপাশে যেন কোনোভাবে পানি জমে না থাকে—সেই বিষয়টি নিশ্চিত করাই এখন সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। সিটি করপোরেশনের উচিত নিয়মিত ফগিংয়ের পাশাপাশি ঘরে ঘরে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো। স্কুল, মসজিদ ও বাজার এলাকায় লার্ভা নিধন কার্যক্রম বাড়ানোও জরুরি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, সম্প্রতি দেশে কখনো বৃষ্টি আবার কখনো রোদ থাকছে। রোদ-বৃষ্টির এই খেলা এডিস মশার বিস্তারে খুবই সহায়ক। এ কারণে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। রোগী বাড়লে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ে। এবারের ভয়াবহতা ২০১৯ সালের মতো হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
চলতি বছরে ডেঙ্গু রোগী বাড়তে শুরু করে মে থেকে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি বছর জুন মাসে ৫ হাজার ৯৫১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। মৃত্যু হয় ১৯ জনের। জুলাই মাসে ১০ হাজার ৬৮৪ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। মৃত্যু হয় ৪১ জনের। আগস্ট মাসে ভর্তি হয়েছেন ১০ হাজার ৪৯৬ জন। মৃত্যু হয়েছে ৩৯ জনের। সেপ্টেম্বর মাসে ১৫ হাজার ৮৬৬ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। এ মাসে মৃত্যু হয় ৭৬ জনের। সেই ধারাবাহিকতা অক্টোবর মাসেও অব্যাহত আছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, জ্বর, মাথাব্যথা, চোখে ব্যথা, শরীর ব্যথা অথবা বমি বমি ভাব দেখা দিলে অবহেলা করা যাবে না। দ্রুত হাসপাতালে গিয়ে রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে। নিজে থেকে ওষুধ না খেয়ে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য জ্বরের ওষুধ নেওয়া বিপজ্জনক হতে পারে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মেহেদী হাসান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের মূল বিষয় হলো পানি জমে থাকা বন্ধ করা। কিন্তু ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এটি সবচেয়ে কঠিন কাজ। মানুষকে নিজেদের ঘর ও আশপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে, না হলে সরকারি উদ্যোগ একা যথেষ্ট নয়।’
এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘অনেকেই এখন মনে করছেন ডেঙ্গু শুধু গ্রীষ্মকালের রোগ। কিন্তু বাস্তবে বর্ষার সময়ই এর প্রকোপ সবচেয়ে বেশি হয়। কারণ মশার প্রজননের জন্য তখন আদর্শ পরিবেশ তৈরি হয়।’
জাহাঙ্গীর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘মশক নিধনে আমাদের বৈজ্ঞানিক কার্যক্রম নেই। কার্যকরী পদক্ষেপ না দিলে ডেঙ্গুর প্রভাব আরও বড় আকার ধারণ করবে। মাঝে ডেঙ্গুর প্রকোপ কিছু কম ছিল। বৃষ্টির কারণে এখন বাড়ছে। ২০২৩ সালের মতো পরিস্থিতি না হলেও ২০১৯ সালের মতো হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. মঈনুল আহসান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘জ্বর হলে দ্রুত স্থানীয় হাসপাতালে যাওয়ার জন্য আমরা বলি। পাশাপাশি সবাইকে ডেঙ্গু পরীক্ষার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। ডেঙ্গু রোগ শনাক্ত হলে অনতিবিলম্বে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। কারণ অনেক সময় দেরিতে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার ফলে রোগের টাইপ পরিবর্তন হয়ে জটিল হয়ে যেতে পারে।’
এমআর/জেবি