images

হেলথ

ডেঙ্গুতে বেশি ঝুঁকি শিশু, নারী ও বয়স্কদের

সাখাওয়াত হোসাইন

২৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:১৫ এএম

সাধারণত প্রতি বছর জুলাই থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত সারাদেশে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ থাকে। চলতি বছরও এই সময়টিতে ডেঙ্গুর প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। ডেঙ্গুতে সব বয়সী নারী-পুরুষই আক্রান্ত হচ্ছে। তবে বেশি ঝুঁকিতে শিশু, নারী ও বয়স্করা। বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের ঝুঁকি বেশি বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু হারে নারীরা এগিয়ে রয়েছেন। এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারীরা সাধারণত দেরিতে চিকিৎসা নিতে যান। এছাড়া দেশের নারীদের দীর্ঘদিনের পুষ্টিহীনতার সমস্যাও রয়েছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃতদের মধ্যে বেশির ভাগই শক সিনড্রোমে মারা যাচ্ছেন। সঠিক সময়ে হাসপাতালে না যাওয়ার কারণেই শক সিনড্রোম হচ্ছে। ‘শক সিনড্রোম’ রোগীকে হাসপাতালে যখন নেওয়া হচ্ছে তখন বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ছে।

গর্ভাবস্থায় ডেঙ্গু আক্রান্ত নারী ও গর্ভের শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি গুরুতর জানিয়ে চিকিৎসকরা বলেন, গর্ভকালীন দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল থাকার কারণে ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর এবং ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে মায়ের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কাও বেশি। অন্তঃসত্ত্বা ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হলে গর্ভস্থ সন্তানের জীবনে মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। গর্ভকালীন বমি ও অত্যধিক জ্বরের কারণে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয় এবং রক্তচাপ কমে যায়। ফলে গর্ভপাত হতে পারে।

D-C3

গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় বা তৃতীয় মাসে শরীর থেকে গর্ভস্থ বাচ্চার শরীরে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়, ফলে বাচ্চার শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও অক্সিজেনের স্বল্পতা দেখা দেয়। এতে গর্ভে বাচ্চার মৃত্যু হতে পারে, অসময়ে অপরিপক্ব সন্তান প্রসব হতে পারে। ডেঙ্গু ভাইরাস গর্ভস্থ সন্তানের শরীরে সংক্রমিত হতে পারে, যা অনাগত সন্তানের জন্মগত ত্রুটি, বিশেষত মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রে গঠনগত ত্রুটি হতে পারে। যাতে পরবর্তীকালে সন্তানের স্নায়ু বিকাশজনিত জটিলতা তৈরি হতে পারে। তাই ডেঙ্গু রোগের উপসর্গ দেখা দিলেই গর্ভবতী মাকে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার ক্ষেত্রে যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম তারা ঝুঁকিপূর্ণ। এক্ষেত্রে শিশু, বয়স্ক, রোগাক্রান্ত ব্যক্তি ডায়াবেটিস, লিভার, কিডনি, হার্টের সমস্যা, ক্যানসার আক্রান্ত ও গর্ভবতীরা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। ফলে ডেঙ্গু ছাড়াও কোনো ধরনের জ্বর বা রোগ যেন না হয় সেদিকে জোর দিতে হবে।’

এ বিষয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মোশতাক হোসেন বলেন, ‘বয়স কম এবং বেশি উভয়ের জন্যই ডেঙ্গুর সংক্রমণ শারীরিক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। কারণ তাদের অপুষ্টি ও রোগব্যাধি বেশি হয়। তাদের সুরক্ষিত রাখতে ব্যক্তিগত, পরিবারিক, সামাজিক ও সরকারি সব পর্যায়ে ব্যাবস্থা নেওয়া উচিত। ডেঙ্গুর প্রতিকার ও প্রতিরোধে জনগণ ও প্রশাসন সমন্বিতভাবে ঘরে ও বাইরে মশা নির্মূলে কাজ করতে হবে।’

এত নারী–শিশু মৃত্যুর কারণ কী

ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এখন ভয়াবহ ডেঙ্গু পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেশের স্বাস্থ্য প্রক্রিয়ায় এটা বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। ১৯৬৪ সাল থেকে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বিক্ষিপ্তভাবে দেখা দেয়।

D-C2

২০০০ সালে বড় ধরনের প্রাদুর্ভাব হয় দেশে। তখন থেকে বিভিন্ন সময়ে কম–বেশি প্রতি বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে। তবে এবার আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার সর্বোচ্চ। এ বছর আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ৪০ শতাংশ নারী এবং ১৭ শতাংশ ১৫ বছরের কম বয়সী শিশু। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ নারী এবং ৪৩ শতাংশ পুরুষ। মোট মারা যাওয়া ব্যক্তির মধ্যে ১৫ বছরের কম বয়সী শিশু ১০ শতাংশ। ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে ৫ বছরের কম বয়সীদের গুরুতর অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. লেলিন চৌধুরী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘শিশুদের ক্ষেত্রে মৃত্যু হওয়ার কারণ হচ্ছে, অনেক সময় মা-বাবারা বুঝতে না পেরে দেরিতে সন্তানকে হাসপাতালে নিয়ে আসছেন। শিশুর দেহ নাজুক, তাদের দেহে পানির ঘাটতি দেখা দিলেই শকে চলে যাচ্ছে। শিশুদের ক্ষেত্রে প্লাজমা লিকেজ দ্রুত হয়। রক্তচাপ চট করে কমে যায়। স্যালাইন দিয়ে রক্তচাপ বাড়াতে চাইলে আবার ফুসফুসে পানি জমে যায়। এটা একটা উভয় সংকট অবস্থা। ওজন দেখে শিশুদের কম বা বেশি ফ্লুইড দিতে হয়।’

বেনজির আহমেদ ঢাকা মেইলকে আরও বলেন, ‘নারী ও শিশু মৃত্যু কেন বেশি, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। মৃত ব্যক্তিদের পরিবারের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা প্রয়োজন। এছাড়া ময়নাতদন্ত করাও প্রয়োজন। যাতে কী কারণে মৃত্যু হচ্ছে, তা বের করা সম্ভব হয়।’

শিশু মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘প্রাপ্তবয়স্কদের অনেকে আগেও ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন। শিশুদের ক্ষেত্রে এটা নতুন। যেকোনো পরিবর্তনের সঙ্গে শিশুদের দ্রুত খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা কম। ফলে ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে দেহের রক্তের পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে শিশুরা সহজে মানিয়ে নিতে পারে না।’

প্রতিরোধে পারিবারিক যত্ন

বিশেষজ্ঞদের মতে, এ বছর ফ্লুইড ও আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র) ব্যবস্থাপনা যথাযথভাবে না হওয়ায় মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। ঢাকার বাইরে এই ব্যবস্থাপনা আরও খারাপ। আর শীতেও দিনের তাপমাত্রা সেভাবে না কমায় এডিস মশার বিস্তার ঘটেই চলেছে। ফলে শিগগিরই ডেঙ্গু থেকে নিস্তারের আশা নেই। আগামী ২০–৩০ বছরে ডেঙ্গু বড় ধরনের জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।’

D-C1

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. তারিকুল ইসলাম লিমন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ছোট শিশুদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম। তার ওপর বেশির ভাগ রোগী ডাক্তারের কাছে আসছে জ্বর বা ডায়রিয়া হওয়ার চার-পাঁচ দিন পর। এতে রোগী অবস্থা গুরুতর পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। দেখা যায়, কারও ফুসফুসে বা পেটে পানি চলে এসেছে বা রক্তক্ষরণ হচ্ছে। অনেকের ক্ষেত্রে হাসপাতালে আসার পরপরই আইসিইউ সাপোর্ট লাগছে। এসব রোগীর চিকিৎসায় সুস্থ হতে ১০ থেকে ১৫ দিন লেগে যায়।’

সামগ্রিক দিক বিবেচনায় ডেঙ্গু থেকে সুরক্ষার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘পরিবারের সদস্যদের আন্তরিক যত্ন, সঠিক সময়ে চিকিৎসা গ্রহণ এবং সচেতনতার মাধ্যমেই নারী, নির্দিষ্ট বয়সী এবং অন্তঃসত্ত্বার ডেঙ্গু রোগ মোকাবিলা করা সম্ভব।’

এসএইচ/জেবি