মাহফুজ উল্লাহ হিমু
০১ জুলাই ২০২২, ০৮:১১ এএম
মগবাজারের বাসিন্দা তুহিন ইবনে ইব্রাহীম। রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান শ্রেণির এই শিক্ষার্থী দুই থেকে তিনদিন যাবৎ সর্দি জ্বরে ভুগছেন। এর মধ্যেই তার রুমমেট রাজ কবিরাজও টানা বেশ কয়েকদিন শরীর ব্যথাসহ সর্দি জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন। তবে তিনি করোনা বা ডেঙ্গু কোনো পরীক্ষায় করাননি। কয়েকদিন প্যারসিটামল ও বিশ্রামে থাকার পর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছেন।
এ বিষয়ে তুহিন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘গত পরশু ক্লাস শেষে বাসায় ফেরার পথে বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম। সারাদিন প্রচণ্ড গরমের মধ্যে ক্লাস করেছি। গরম ও যানযটে নাকাল অবস্থায় বাস থেকে নেমেই বৃষ্টিতে ভিজতে হয়েছে। এতে সেদিন রাত থেকে থেকেই সর্দি লেগে যায় এবং পরদিন সকাল থেকে জ্বর। জ্বর-সর্দির সাথে মাথা ব্যথা ও অল্প শরীর ব্যথা রয়েছে। প্যারাসিটামল খাচ্ছি আশাকরি শিগগিরই সুস্থ হয়ে যাবো। এর আগে আমার রুমমেটের জ্বর হয়েছিল তবে তার সাথে আমার জ্বরের সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। এটা সম্ভবত বৃষ্টিতে ভেজার জন্য হয়েছে অথবা শুধুই মৌসুমি জ্বর।’
রাজ কবিরাজ বলেন, ‘আমার জ্বর ও শরীর ব্যথা ছিল। তবে প্যারাসিটামল খাওয়ার পর দুই থেকে তিন দিনের মধ্যেই তা ছেড়ে দিয়েছে। অন্য কোনো বিশেষ সমস্যা না হওয়ায় করোনা পরীক্ষা করাইনি। আমাদের মেসের অন্য কোনো সদস্যদের মধ্যেও জ্বর বা অন্য কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। আমি সুস্থ হওয়ার কয়েক দিন পরেই বৃষ্টিতে ভিজে আমার রুমমেটের জ্বর এসেছে।’
রাজ ও তুহিনের মতো রাজধানীসহ সারাদেশেই এ ধরণের রোগী লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে প্রতিবছর এই সময়ে ঋতু পরিবর্তনের ফলে জ্বর, সর্দি, কাশির প্রদুর্ভাব দেখা দেয়। তবে একই সময়ে মহামারি করোনা ও এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বরের সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় জ্বরে আক্রান্তদের অধিক সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
বেড়েছে করোনা ও ডেঙ্গুর সংক্রমণ
দেশে মহামারি করোনার প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ে ২০২০ সালের ৮ মার্চ। এরপর করোনার একাধিক ঢেউয়ে লাখ লাখ মানুষ ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়েছেন। মৃত্যুবরণ করেছেন ২৯ হাজারের অধিক মানুষ। তবে এ বছরের শুরুতে গণটিকাদান কর্মসূচিসহ একাধিক উদ্যোগের প্রভাবে সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। সকল ধরনের বিধি-নিষেধ প্রায় উঠে যায়। তবে জুন মাসের মাঝামাঝিতে সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা দেয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, গত জানুয়ারিতে এক দিনে করোনা আক্রান্তের সর্বোচ্চ হার ছিল ৩৩ শতাংশ। সেদিন শনাক্ত হয়েছিল ১৫ হাজার ৪৪০ জন। এরপর ফেব্রুয়ারিতে শনাক্তের হার ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বজায় থাকে এর ধারাবাহিকতা। এরপর আবারও বাড়তে থাকে শনাক্তের হার। গত ৬ জুন পর্যন্ত শনাক্তের হার ১ শতাংশের নিচে থাকলেও ৭ জুন থেকে তা এক শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। আড়াই মাস পর ১২ জুন এক দিনে শতাধিক শনাক্ত হয়। এরপর মধ্যে এক দিন বাদে প্রতিদিনই শনাক্তের সংখ্যা বেড়েছে হু হু করে। সর্বশেষ ৩০ জুন একদিনে আক্রান্ত হয় দুই হাজার ১৮৩ জন। একইসঙ্গে চার জনের প্রাণহানী ঘটে। এদিন শনাক্তের হার ছিল ১৫ দশমিক ৭০ শতাংশ।
অপরদিকে ২০১৯ ও ২০২১ সালে ব্যাপকভাবে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ওই দুই বছরে যথাক্রমে এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ ও ২৮ হাজার ৪২৯ জন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। সংক্রমণের পাশাপাশি ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যাও ছিল শতাধিক। তবে এ বছরের পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বর্ষার শুরুতেই ঢাকাসহ সারাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ৩৫২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। আর শুধুমাত্র সর্বশেষ জুন মাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৭৩৭ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন একজন।
মৌসুমি জ্বরের প্রভাব রয়েছে তবে সর্তক হতে হবে
জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘প্রতিবছরই ঋতু পরিবর্তনের সময় সর্দি-কাশির প্রদুর্ভাব লক্ষ্য করা যায়। জ্বর, সর্দি-কাশি মূলত ভাইরাসজনিত কারণে হয়ে থাকে। এর মধ্যে ইনফ্লুয়েঞ্জা, কমন ফ্লু ইত্যাদি রয়েছে। এখন সারাদেশেই গরম আবহাওয়া বিরাজ করছে, এর মধ্যে আবার বৃষ্টিপাত হচ্ছে। ফলে মানুষ সহজেই এসব ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে এদের সবই যে শুধুই মৌসুমি জ্বর তা নয়। এখন আমাদের দেশে করোনা ও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবও বেড়েছে। দুইটির লক্ষণই জ্বর, সর্দি-কাশি, গা ব্যথা ইত্যাদি। তাই যাদেরই সাধারণ জ্বর, সর্দি, কাশি থাকবে তাদের অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। নিজের ইচ্ছা মতো কিংবা ফার্মেসি দোকানির পরামর্শে ওষুধ সেবন থেকে বিরত থাকা উচিত।’
আক্রান্তদের সতর্ক হওয়ার পরমর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘সকলকে আগে থেকে সতর্ক থাকা উচিত। যেনো পরিস্থিতি জটিল না হয়। জটিল হলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। সতর্ক হলে হয়তো তা এড়ানো যেত। হাসপাতালে যতো কম রোগী ভর্তি হয় ততোই ভালো। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগী ও তার স্বজনসহ সকলের জন্যই কষ্টকর। তাই রোগীদের আগাম সতর্ক হতে হবে। হাসপাতাল মানেই সকলের জন্য বিড়ম্বনা। তাই সাবধানতার বিকল্প নেই।’
অধিক পরীক্ষার গুরুত্ব উল্লেখ করে অধ্যাপক এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘এ সময়ে জ্বরে আক্রান্তদের অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না আমরা এখনও একটি মহামারি পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খাওয়ার পাশাপাশি করোনা পরীক্ষা করতে হবে। যেনো সে সুস্থ মানুষের সাথে মিশে না যায়। কারণ যে করোনায় আক্রান্ত, তার আইসোলেশনটা জরুরি। তার থেকে অন্যদের মধ্যে ভাইরাস ছড়ানোর সম্ভবনা রয়েছে। পরীক্ষার আগে নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না কোনটা করোনা, আর কোনটা সাধারণ জ্বর। একইসঙ্গে ডেঙ্গুর ঝুঁকি তো আছেই। কারো কারো ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর পরীক্ষা করা উচিত। কারণ কিছু রোগীর মধ্যে একই সময় ডেঙ্গু ও করোনা থাকতে পারে। তাই জ্বর হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া ও পরীক্ষা করানো উচিত। এতে বিপদের ঝুঁকি কমবে।’
এমএইচ/এএস