মহিউদ্দিন রাব্বানি
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৬:১৫ পিএম
দেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে হার্ট বা হৃদরোগীর সংখ্যা। হৃদরোগ বিশ্বের এক নম্বর ঘাতক। ক্যানসারের চেয়েও মারাত্মক রোগ এটি। দেশে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর প্রায় পৌনে তিন লাখ মানুষ মারা যাচ্ছেন। এটি দেশের মোট মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, ধূমপান, অস্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাস, অনিয়মিত ঘুম, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব এবং মানসিক চাপ হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, হৃদরোগ বিশ্বের এক নম্বর ঘাতক। বাংলাদেশেও এর প্রভাব ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। দেশে মোট মৃত্যুর প্রায় এক-তৃতীয়াংশই ঘটে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। অথচ বিশেষজ্ঞদের মতে, সামান্য সচেতনতা এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে এই মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর প্রায় ৩৪ শতাংশ ঘটে হৃদরোগে। অথচ ৮০ শতাংশ পর্যন্ত হৃদরোগজনিত অকাল মৃত্যু প্রতিরোধযোগ্য। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা মনে করেন, একটু সচেতন হলে এ মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব।
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়মিত হাঁটা-চলা, স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ, ধূমপান ত্যাগ এবং মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করলে হৃদরোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। পাশাপাশি বয়স ৪০-এর ওপরে হলে বছরে অন্তত একবার হৃদযন্ত্র পরীক্ষার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে হৃদরোগ প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা এখনো পর্যাপ্ত নয়। জনগণকে সচেতন করে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করা গেলে মৃত্যুহার কমানো সম্ভব হবে।
হৃদরোগ সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে প্রতি বছরই সারা বিশ্বে ২৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ব হৃদরোগ দিবস পালিত হয়। আজ সোমবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব হার্ট দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘ডোন্ট মিস এ বিট’ বা একটি স্পন্দনও যেন না হারায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, সারা বিশ্বে প্রতি বছর দুই কোটি মানুষ হৃদরোগে মারা যায়। এর মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ৭৭ হাজার। আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ সারা বিশ্বে ২৩ মিলিয়ন লোক হৃদরোগে মারা যাবে। এর মধ্যে বেশি মারা যাবে নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে। এ কারণে আমাদের দেশে হৃদরোগে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাবে। বর্তমানে বাংলাদেশে সাতটি অসংক্রামক রোগে যে পরিমাণ মানুষ মারা যায়, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ৩৪ শতাংশ মারা যায় হৃদরোগে।
চিকিৎসকরা বলছেন, একসময় মনে করা হতো শুধু প্রবীণরাই হৃদরোগে আক্রান্ত হন। কিন্তু সময় পাল্টেছে। এখন ২৫-৩০ বছর বয়সীদেরও হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষিণ এশীয়দের শরীরের করোনারি আর্টারি তুলনামূলক সরু হওয়ায় অল্পতেই ব্লক হয়ে যায়। ধূমপান, তেল-চর্বিযুক্ত খাবার, জাংকফুড, অনিয়মিত জীবনযাপন ও মানসিক চাপ এই ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভৌগোলিক কারণে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ, ভারতসহ এ অঞ্চলে হৃদরোগে ঝুঁকি বেশি। কারণ, আমাদের দেশের মানুষ অল্প বয়সে ধূমপান করে, চর্বিযুক্ত খাবার বেশি খায়। আবার ভৌগোলিক কারণে এ দেশের মানুষের উচ্চতা কম; এর ফলে তাদের হার্টের করোনারি আর্টারি (ধমনি) সরু থাকে, যা সাধারণত অল্পতেই কোলেস্টেরল বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। কারও করোনারির ৭০ শতাংশ ব্লক হলে বুকে ব্যথা, চাপ অনুভব করা ও ধম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। কিন্তু কারও যদি ১০০ শতাংশ ব্লক হয়ে যায়, তখনই হার্ট অ্যাটাক। একটা সময় ছিল যখন ৬০ থেকে ৭০ বছর বয়সীদের হার্ট অ্যাটাক হতো। বর্তমানে ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে। অল্প বয়সীদের কেন হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে, তা নিয়ে গবেষণা করা দরকার বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও কিডস হার্ট ফাউন্ডেশনের সভাপতি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) অধ্যাপক ডা. নূরুন্নাহার ফাতেমা বলেন, দেশে হৃদরোগের আক্রান্তের হার দিন দিন বাড়ছে। সচেতনতার মাধ্যমে এটিকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। প্রতিদিন দুই শতাধিক শিশু হৃদরোগ নিয়ে জন্মাচ্ছে। এটি ডেঙ্গু বা কোভিডের মতো একটি মহামারি রোগ। তবু জাতীয় স্বাস্থ্য কর্মসূচিতে জন্মগত হৃদরোগ এখনো অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ আল সাফি মজুমদার বলেন, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ধূমপান, উচ্চ কোলেস্টেরল, ফাস্ট ফুডসহ চর্বিযুক্ত খাবার ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের কারণে হৃদরোগে আক্রান্তের হার বাড়ছে। এসব সম্পর্কে সচেতন হলে হৃদরোগ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। শুধু অসচেতনতার কারণে হৃদরোগ একটি নীরব ঘাতক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এমআর/জেবি