নিজস্ব প্রতিবেদক
১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৫:৪০ পিএম
টাইফয়েড জ্বরে মৃত্যু কমাতে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আগামী ১২ অক্টোবর থেকে দেশজুড়ে শুরু হচ্ছে টাইফয়েড টিকাদান কর্মসূচি। কর্মসূচির আওতায় ৯ মাস থেকে ১৫ বছরের কম বয়সি শিশুদের দেওয়া হবে টাইফয়েড টিকা।
রোববার (১৪ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর মহাখালীর স্বাস্থ্য অধিদফতরের সভাকক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর এসব তথ্য জানান।
তিনি বলেন, ‘এই প্রথম সরকারিভাবে প্রায় ৫ কোটি শিশুকে বিনামূল্যে টাইফয়েড টিকা দেওয়া হবে। এরই মধ্যে ১ আগস্ট থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেড় মাসে নিবন্ধন করেছে ৮৯ লাখ ২৭ হাজার শিশু। অনলাইনে নিবন্ধন, টিকা কেন্দ্রে সুযোগ টিকা গ্রহণে আগ্রহীদেরকে অনলাইনে নিবন্ধনের আহ্বান জানানো হয়েছে।
নিবন্ধনের জন্য ভিজিট করতে হবে https://vaxepi.gov.bd/registration/tcv এই ঠিকানায়। প্রয়োজন হবে ১৭ সংখ্যার জন্ম নিবন্ধন নম্বর।
অধ্যাপক ডা. আবু জাফর বলেন, নিবন্ধনের পর পাওয়া যাবে একটি ডিজিটাল টিকা কার্ড, যা নিয়ে নির্ধারিত কেন্দ্রে গিয়ে টিকা গ্রহণ করা যাবে। তবে যেসব শিশুর জন্ম নিবন্ধন সনদ নেই, তাদের জন্য রাখা হয়েছে আলাদা ব্যবস্থা। নির্ধারিত টিকা কেন্দ্রেই করা যাবে নিবন্ধন। যাদের বয়স ৯ মাস পূর্ণ হয়েছে, তবে ১৫ বছর পূর্ণ হয়নি- এই বয়সসীমার মধ্যেই যারা রয়েছে, কেবল তারাই এই টিকার জন্য উপযুক্ত।
মহাপরিচালক জানান, টাইফয়েড একটি জলবাহিত রোগ এবং শিশুদের মধ্যে এটি অনেক বেশি দেখা যায়। বছরে বছর ৮ হাজার মারা যার এর মধ্যে ৬ হাজার শিশু। সময়মতো টিকা গ্রহণের মাধ্যমে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
তিনি বলেন, টাইফয়েড জ্বর একটি প্রতিরোধযোগ্য সংক্রামক রোগ। শিশুদের সুরক্ষায় সরকার বিনামূল্যে টাইফয়েড টিকা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত এই টিকা নিরাপদ ও কার্যকর। সরকারের এই ক্যাম্পেইন শুধু শিশুদের জীবন রক্ষা নয়, দীর্ঘমেয়াদে টাইফয়েডজনিত অসুস্থতা ও মৃত্যুহার কমাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৯০ লাখ মানুষ টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে মৃত্যু ঘটে প্রায় এক লাখ দশ হাজার মানুষের। আক্রান্ত ও মারা যাওয়াদের বেশিরভাগই দক্ষিণ এশিয়া এবং সাব-সাহারান আফ্রিকার মানুষ।
উন্নত দেশগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় টাইফয়েডের প্রাদুর্ভাব অনেকাংশেই কমেছে। তবে বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশে এই সংক্রামক রোগ এখনো অন্যতম জনস্বাস্থ্য সমস্যা।
দ্য গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজের বরাত দিয়ে বাংলাদেশে টাইফয়েডের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানানো হয়, ২০২১ সালে বাংলাদেশে প্রায় ৪ লাখ ৭৮ হাজার মানুষ টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে প্রায় আট হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। ভয়াবহ বিষয় হলো, মৃতদের ৬৮ শতাংশই শিশু। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ বাস্তবতা বাংলাদেশে শিশু স্বাস্থ্য সুরক্ষায় টাইফয়েড টিকার গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দেয়।
বক্তারা জানান, টাইফয়েড জীবাণু স্যালমোনেলা টাইফি দ্বারা সৃষ্ট। এটি মূলত দূষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে ছড়ায়। ঝুঁকি বেশি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, বস্তি, নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠী এবং যেখানে নিরাপদ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনের অভাব রয়েছে। আক্রান্ত হলে শুধু শারীরিক জটিলতাই নয়, অর্থনৈতিক ক্ষতিও হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
এর পাশাপাশি আশঙ্কাজনক বিষয় হলো, টাইফয়েড চিকিৎসায় ব্যবহৃত বহু অ্যান্টিবায়োটিক আর কার্যকর থাকছে না। জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে, ফলে ওষুধ প্রতিরোধী টাইফয়েড ক্রমশ বাড়ছে। এই অবস্থায় টিকা গ্রহণই সবচেয়ে নিরাপদ সমাধান বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তাদের মতে, টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে আগামী কয়েক বছরে টাইফয়েড রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসবে। একদিকে ওষুধ প্রতিরোধী টাইফয়েডের ঝুঁকি হ্রাস পাবে, অন্যদিকে পরিবার ও সমাজের ওপর অর্থনৈতিক চাপও কমবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একবার টাইফয়েডে আক্রান্ত হলে শুধু চিকিৎসা খরচই নয়, দীর্ঘ সময় কর্মক্ষমতা হারাতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হয়ে জীবন ঝুঁকির মুখে পড়ে। তাই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে টিকা গ্রহণের বিকল্প নেই।
সরকার আশা করছে, দেশব্যাপী এই টিকাদান কর্মসূচি সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশে টাইফয়েডজনিত মৃত্যু অনেকাংশে কমে আসবে। একইসঙ্গে শিশুদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়াতে এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জীবনধারা গড়ে তুলতে জনসচেতনতা কার্যক্রমও চালানো হবে।
এসএইচ/এএইচ