নিজস্ব প্রতিবেদক
১৩ আগস্ট ২০২৫, ১০:৫৮ পিএম
ফর্মুলা দুধের আগ্রাসী প্রচার এবং সচেতনতার অভাবে দেশে ৪৫ শতাংশ শিশু মায়ের দুধ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। একইসঙ্গে দিনে দিনে নবজাতকদের জন্য ঝুঁকির মাত্রা বাড়ছে বলেও জানান তারা।
বুধবার (১৩ আগস্ট) জাতীয় প্রেসক্লাবের আব্দুস সালাম হলে বাংলাদেশ নিওনেটাল ফোরাম (বিএনএফ) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তারা এসব কথা বলেন।
বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ উপলক্ষে শিশু স্বাস্থ্যের জন্য মায়ের দুধের গুরুত্ব, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং মায়ের দুধের বিকল্প দুগ্ধ ব্যবহারের আইন সম্পর্কে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
এসময় ফর্মুলা দুধের আগ্রাসী প্রচার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং মা-হারা শিশুদের জন্য মানবিক দুধ ব্যাংক গঠনসহ পাঁচটি দাবি তুলে ধরেন সংগঠনটির নেতারা।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন বিএনএফের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. মো. মজিবুর রহমান।
তিনি বলেন, নবজাতক জন্মের পর সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন মায়ের শালদুধ, যা প্রথম ঘণ্টার মধ্যেই শিশুকে খাওয়ানো আবশ্যক। এই দুধে থাকে গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিবডি, এনজাইম ও জীবন্ত উপাদান—যা শিশুকে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, কানের ইনফেকশনসহ নানা সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেয়। এছাড়া দুধে থাকা ডিএইচএ ও এআরএ শিশুর মস্তিষ্ক ও চোখের সঠিক বিকাশ নিশ্চিত করে।
একইসঙ্গে এটি শিশুর আবেগীয় নিরাপত্তা ও মায়ের সঙ্গে গভীর সংযোগ তৈরি করে। অর্থনৈতিক দিক দিয়েও বুকের দুধই সবচেয়ে নিরাপদ, কারণ এর জন্য বাড়তি কোনো খরচ হয় না বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের (বিডিএইচএস) সাম্প্রতিক তথ্য তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০১৭-১৮ সালে বুকের দুধ খাওয়ানোর হার ছিল ৬৫ শতাংশ, যেখানে ২০২৫ সালে এসে তা কমে হয়েছে মাত্র ৫৫ শতাংশ। অর্থাৎ এক দশকের অগ্রগতি আবারও হারিয়ে যাচ্ছে। আয়োজকরা বলছেন, এর জন্য দায়ী মূলত সচেতনতার ঘাটতি এবং বাজারে ফর্মুলা দুধের আগ্রাসী প্রচারণা।
অধ্যাপক মজিবুর রহমান জানান, শিশুর জন্য ফর্মুলা দুধ কতটা বিপজ্জনক, তা একাধিক আন্তর্জাতিক গবেষণায় উঠে আসে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, ফর্মুলা ফিডে শিশুদের ডায়রিয়ার ঝুঁকি ১৪ গুণ এবং নিউমোনিয়ার ঝুঁকি ১৫ গুণ বেশি। এছাড়া ক্যানসার, স্থূলতা, ডায়াবেটিস এমনকি আইকিউয়ের মাত্রায়ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে কৃত্রিম দুধ।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের বাস্তবতায় নিরাপদ পানি, জীবাণুমুক্ত বোতল কিংবা নির্ভরযোগ্য সংরক্ষণ পদ্ধতির অভাবে ফর্মুলা দুধ আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। আর্থিক দিকেও একটি শিশুর জন্য বছরে প্রায় ৫০-৬০ হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ হয়, যা নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর জন্য বিশাল বোঝা।
সংবাদ সম্মেলনে আয়োজকরা বলেন, ২০১৩ সালে প্রণীত ‘ব্রেস্ট মিল্ক সাবস্টিটিউট অ্যাক্ট’ অনুযায়ী, বুকের দুধের বিকল্প কোনো পণ্য প্রচার, পরামর্শ বা ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। প্রথমবার অপরাধে সর্বোচ্চ তিন বছর জেল বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান থাকলেও বাস্তবায়নে রয়েছে শৈথিল্য। পুনরাবৃত্তিতে শাস্তি দ্বিগুণ হবে এবং শিশুর মৃত্যু ঘটলে ১০ বছরের জেল ও ৫০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।
মা-হারা ও নবজাতকদের জীবন বাঁচাতে ‘হিউম্যান মিল্ক স্টোরেজ সেন্টার’ প্রতিষ্ঠার দাবিও উঠে আসে সংবাদ সম্মেলনে। বিশ্বের অনেক দেশে এই ব্যবস্থার মাধ্যমে বহু নবজাতকের জীবন রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশেও এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে সরকার ও বেসরকারি অংশীদারিত্ব জরুরি বলে জানায় সংগঠনটি।
এ সময় বেশ কিছু নীতিগত সুপারিশ ও করণীয় তুলে ধরা হয় নিওনেটাল ফোরামের পক্ষ থেকে। এগুলো হলো—সরকারি-বেসরকারি কর্মস্থলে ব্রেস্টফিডিং কর্নার স্থাপন; ফর্মুলা দুধের অপ্রয়োজনীয় প্রচারণা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা; স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ; গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং মা-হারা শিশুদের জন্য মানবিক দুধ ব্যাংক গঠন।
অনুষ্ঠানে বিএনএফের সভাপতি অধ্যাপক মো. মাহবুবুল হকের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক খুরশিদ আলম।
এছাড়া অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনটির উপদেষ্টা অধ্যাপক সুফিয়া খাতুন, বাংলাদেশ পেরিনেটাল সোসাইটির (বিপিএস) সভাপতি অধ্যাপক লায়লা আর্জুমান্দ বানু, বিএনএফের প্রাক্তন সভাপতি অধ্যাপক মো. মনির হোসেন, দৈনিক কালবেলার উপ-সম্পাদক দীপঙ্কর লাহিড়ী ও দৈনিক যায় যায় দিনের বিশেষ প্রতিনিধি এ কে এম সাখাওয়াত হোসেন প্রমুখ।
এসএইচ/এএইচ