images

হেলথ

শিশুদের অসংক্রামক রোগ মোকাবিলায় ‘এনসিডি সেবা মডেল’ চালু

নিজস্ব প্রতিবেদক

০২ জুলাই ২০২৫, ০৬:৩৯ পিএম

শিশুদের অসংক্রামক রোগ (এনসিডি) প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনায় ‘শিশু এনসিডি সেবা মডেল’ চালু করেছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)। পরীক্ষামূলকভাবে চালুর প্রথম সাত সপ্তাহেই এই কর্মসূচির আওতায় ৩৮৫ জন শিশু সেবা গ্রহণ করেছে। কিছু চ্যালেঞ্জ থাকলেও এটি বাস্তবায়নযোগ্য ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।

মঙ্গলবার (১ জুলাই) রাজধানীর আইসিডিডিআর,বি সাসাকাওয়া মিলনায়তনে ‘বাংলাদেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে শিশু ও কিশোরদের জন্য এনসিডি সেবা মডেল ডিজাইন ও পাইলট বাস্তবায়ন’ শীর্ষক এই প্রকল্পের ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানানো হয়। 

গবেষণার লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে শিশুদের অগ্রাধিকারভুক্ত এনসিডি শনাক্ত করা এবং এসব রোগ ব্যবস্থাপনার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ সেবাদান মডেল তৈরি করা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিশু স্বাস্থ্য ও জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি উন্নয়নে এটি একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ ও মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। শিশুর এনসিডি সেবাকে জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সাথে একীভূত করার ক্ষেত্রে এটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।

আয়োজকরা জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা (এনসিডিসি) ও ইউনিসেফ বাংলাদেশের সহায়তায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে আইসিডিডিআর,বি।

গ্লোবাল বার্ডেন রিপোর্ট ২০১৯ অনুযায়ী, ২০১৭ সালে বিশ্বজুড়ে ২.১ বিলিয়নের বেশি শিশু অ-সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয় এবং প্রায় ১০ লাখ শিশু মৃত্যু বরণ করে। তবে বাংলাদেশে শিশুদের এনসিডি সংক্রান্ত নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই, যা গবেষণা, চিকিৎসা এবং নীতিমালায় ঘাটতির প্রতিফলন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পেন-প্লাসের অগ্রাধিকারে থাকা শিশুদের এনসিডি, যেমন—রিউম্যাটিক হার্ট ডিজিজ এবং সিকেল সেল ডিজিজ প্রধানত সাব-সাহারান আফ্রিকায় বেশি প্রচলিত, দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোতে তুলনামূলকভাবে কম।

বাংলাদেশের প্রকৃত পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে গবেষণার মাধ্যমে শিশুদের গুরুত্বপূর্ণ ছয়টি এনসিডি নির্ধারণ করা হয়—ব্রংকিয়াল অ্যাজমা, জন্মগত হৃদরোগ, মৃগী (এপিলেপসি), থ্যালাসেমিয়া, কিডনি রোগ এবং টাইপ-১ ডায়াবেটিস। এই তথ্যের ভিত্তিতে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ প্রথম জাতীয় শিশু এনসিডি চিকিৎসা প্রটোকল প্রণয়ন করে, যা শিশুদের জন্য মানসম্মত চিকিৎসা নির্দেশিকা প্রদান করে। এরপর চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো কিশোরগঞ্জের ১২টি ও বাগেরহাটের ৮টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং দুটি জেলা হাসপাতালে পরীক্ষামূলকভাবে শিশুদের এনসিডি সেবা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসা হয়, যা ০ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের অন্তর্ভুক্ত করে।

এই প্রকল্পের অধীনে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পর্যায়ে শিশুদের এনসিডি ব্যবস্থাপনায় বিদ্যমান ঘাটতি চিহ্নিত করা হয়। চিকিৎসক, নার্স, সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (স্যাকমো) এবং কমিউনিটি হেলথ কেয়ার কর্মীদের জন্য প্রশিক্ষণ মডিউল তৈরি করা হয়। সামাজিক ও আচরণগত পরিবর্তন (এসবিসিসি) উপকরণ তৈরি করা হয়। রোগীদের নিবন্ধনের জন্য একটি রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম এবং প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে মাসিক প্রতিবেদন তৈরির জন্য একটি ডিজিটাল হেলথ প্ল্যাটফর্ম চালু করা হয়।

গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, মডেলটি বাস্তবায়নের প্রথম সাত সপ্তাহে মোট ৩৮৫ জন শিশু রোগ নির্ণয় ও সেবার জন্য তালিকাভুক্ত হয়। এদের মধ্যে ব্রংকিয়াল অ্যাজমা ছিল সর্বাধিক (৩৬.৬%), এরপর থ্যালাসেমিয়া ও আয়রন ঘাটতিজনিত অ্যানিমিয়া (২৭.৫%), জন্মগত হৃদরোগ (১৯.১%), মৃগী (১৩.৬%), নেফ্রোটিক সিনড্রোম (২.২%) এবং টাইপ-১ ডায়াবেটিস (১%)। প্রায় ৮% রোগীকে বিশেষায়িত কেন্দ্রে রেফার করা হয় উন্নত চিকিৎসার জন্য।

NCD2

এছাড়া গুণগতমানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিত করতে দুই শতাধিক চিকিৎসক, নার্স ও স্যাকমো এবং পাঁচ শতাধিক কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারকে (সিএইচসিপি) প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই উদ্যোগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ার (সিবিএইচসি) এবং ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) প্রোগ্রামগুলোরও সহায়তা ছিল।

কিছু বাস্তবায়নজনিত চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের মতে, এই মডেলটি বাস্তবায়নযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। এই পাইলট প্রকল্প থেকে পাওয়া শিক্ষা ভবিষ্যতে জাতীয় পর্যায়ে শিশুদের এনসিডি সেবা জোরদার ও সম্প্রসারণের একটি রোডম্যাপ তৈরিতে সহায়তা করবে। এই কাজ বাংলাদেশের সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা (ইউএইচসি) অর্জন এবং শিশু স্বাস্থ্য ও অ-সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ সংক্রান্ত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখবে।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার (এনসিডিসি) লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. সৈয়দ জাকির হোসেন অ-সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের গুরুত্ব তুলে ধরে গবেষণায় চিহ্নিত চ্যালেঞ্জগুলো সমাধান করে প্রকল্পটি দেশব্যাপী সম্প্রসারণের আহ্বান জানান।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের সাবেক পরিচারক ও হেলথ ইনফরমেশন সিস্টেম অ্যান্ড ই-হেলথের সাবেক লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. শাহ আলী আকবর আশরাফী বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর মাধ্যমে তৈরি করা লিফলেট ব্যবহার করে মা ও অভিভাবকদের সচেতন করতে হবে এবং অ-সংক্রামক রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসা গ্রহণে উৎসাহিত করতে হবে।

ইউনিসেফ বাংলাদেশের মাতৃ, নবজাতক, শিশু ও কিশোর স্বাস্থ্য বিষয়ক হেলথ ম্যানেজার দেওয়ান মো. এমদাদুল হক বলেন, শিশুদের অ-সংক্রামক রোগ ব্যবস্থাপনায় এই উদ্যোগকে আরও শক্তিশালী করতে সম্মিলিতভাবে কাজ করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

গবেষণার প্রধান গবেষক ও আইসিডিডিআর,বির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ডা. আলিয়া নাহিদ বলেন, এই গবেষণা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিশুদের এনসিডি ব্যবস্থাপনায় একটি টেকসই এবং সম্প্রসারণযোগ্য মডেলের ভিত্তি তৈরি করেছে, যা কেবল শিশুদের বর্তমান স্বাস্থ্য নয়, ভবিষ্যতের সুস্থ ও কার্যকর জীবনযাপনের সম্ভাবনাকেও রক্ষা করবে।

আইসিডিডিআর,বির নিউট্রিশন রিসার্চ ডিভিশনের সিনিয়র ডিরেক্টর ডা. থাডেয়াস ডেভিড মে সমাপনী বক্তব্যে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং উদ্যোগের সফলতায় অবদান রাখার জন্য সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।

এসএইচ/এএইচ