ঢাকা মেইল ডেস্ক
১৮ মে ২০২৫, ১০:৪১ এএম
দেশে প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে ছোঁয়াচে রোগ ‘স্ক্যাবিসের’। বিশেষ করে কুমিল্লা এবং রাজশাহীর সরকারি হাসপাতালগুলোতে এই রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে বলে জানা গেছে।
কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলায় সাত বছর বয়সী এক শিশু স্ক্যাবিসে আক্রান্ত হওয়ার পর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে।
শিশুটির মা আয়শা খানম বিবিসি বাংলার কাছে তার সন্তানের অসুস্থতার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “ছোট মেয়ের গত সপ্তাহে প্রথমে জ্বর আসে, আমরা ডাক্তারের কাছে না নিয়ে সাধারণ ওষুধ দেই। পরের দিন দেখি ওর ডান হাতের আঙুল খুব চুলকাচ্ছে এবং আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে লালচে ফোস্কার মতো দেখা যাচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “তখনও আমরা তেমন গুরুত্ব দেইনি। কিন্তু পরের দিন দেখি এগুলো ওর সারা শরীরে ছড়িয়ে গেছে। তিন দিনের দিন আমরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাই। ডাক্তাররা বলেন এটা ছোঁয়াচে রোগ, তাই মেয়েকে সবার থেকে আলাদা রাখতে হবে। তারা ওষুধ, ক্রিম ও লোশন দিয়েছেন। সাত দিন হয়ে গেল, এখনও ভালো হয়নি।”
চিকিৎসকদের মতে, সাধারণ মানুষ ‘স্ক্যাবিস’কে খোস-পাঁচড়া নামে চেনে। সাধারণত গরমকালে এই রোগের প্রকোপ বাড়ে, তবে বর্তমানে এটি সারা বছরই দেখা যাচ্ছে।
মুরাদনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকরা জানান, স্ক্যাবিসে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন গড়ে দুইশ থেকে আড়াইশ রোগী তাদের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসছেন।
এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আব্দুল্লাহ আল মামুন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমাদের হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন পাঁচশো থেকে সাড়ে পাঁচশো রোগী আসে। এর মধ্যে শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুই থাকে প্রায় দেড়শ থেকে পৌনে দুইশো। তাদের মধ্যে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ রোগীই স্ক্যাবিসে আক্রান্ত।”
শুধু কুমিল্লা নয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারেও এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে। গত এক সপ্তাহে সেখানে প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৩৫ জন স্ক্যাবিসে আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা নিতে এসেছেন।
চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারের চিকিৎসক মাশিউল আলম হোসেন জানান, শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, রাজশাহী শহরেও এই রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এটা শুধু বিশ্ববিদ্যালয় বা রাজশাহীর সমস্যা নয়, এটি গোটা বাংলাদেশেরই চিত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টারে যেখানে আগে দিনে দু’জন রোগী পাওয়া যেত, এখন সেখানে পাঁচ-ছয়জন পাওয়া যাচ্ছে।”
সঠিক চিকিৎসা না করালে স্ক্যাবিসের কারণে কিডনি জটিলতা পর্যন্ত হতে পারে। তাই এই রোগের সংক্রমণ ঠেকাতে আক্রান্ত ব্যক্তির পাশাপাশি তার পরিবারের সদস্য বা একইসাথে বসবাসকারী সকলেরই একযোগে চিকিৎসা নেওয়া জরুরি।
এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে, স্ক্যাবিস আসলে কী এবং এটি কীভাবে ছড়ায়? এই রোগের লক্ষণ ও উপসর্গগুলোই বা কী? আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা এবং রোগ প্রতিরোধের উপায়গুলোই বা কী কী?
চিকিৎসকরা বলছেন, অসংখ্য চর্মরোগের মধ্যে স্ক্যাবিসই সবচেয়ে বেশি ছোঁয়াচে। খুব দ্রুত একজন থেকে অন্যজনে এটি সংক্রমিত হতে পারে। তবে সঠিক ব্যবস্থা নিলে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
তবে চিকিৎসকরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, সঠিক চিকিৎসা না করালে স্ক্যাবিসের কারণে কিডনি জটিলতা পর্যন্ত হতে পারে। তাই এই রোগের সংক্রমণ ঠেকাতে আক্রান্ত ব্যক্তির পাশাপাশি তার পরিবারের সদস্য বা একইসাথে বসবাসকারী সকলেরই একযোগে চিকিৎসা নেওয়া জরুরি।
‘স্ক্যাবিস’ কী ও কীভাবে ছড়ায়?
‘স্ক্যাবিস’ একটি পরজীবীঘটিত চর্মরোগ, যা ‘সারকোপটিস স্ক্যাবিয়া’ নামক ক্ষুদ্র জীবাণুর মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই রোগ মূলত আক্রান্ত ব্যক্তির সরাসরি সংস্পর্শে আসা এবং তাদের ব্যবহৃত জামাকাপড়, বিছানা, তোয়ালেসহ অন্যান্য ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ব্যবহারের মাধ্যমে দ্রুত ছড়ায়।
মুরাদনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক আব্দুল্লাহ আল মামুন এ প্রসঙ্গে বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সাধারণত গরমের সময়ে অন্যান্য চর্মরোগের মতো স্ক্যাবিসের প্রকোপও বাড়ে। যদিও এই রোগ সারা বছরই দেখা যায়, তবে গ্রীষ্মকালে এর সংক্রমণ তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে।”
রোগটি সংক্রমণের কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি আরও বলেন, “যেসব স্থানে ঘনবসতিপূর্ণ পরিবেশ বিদ্যমান, যেমন বস্তি এলাকা অথবা ছাত্রাবাস যেখানে অনেক মানুষ একসঙ্গে বসবাস করে, সেখানে স্ক্যাবিসের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। এছাড়া, যারা ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার অভাব রাখেন, নিয়মিত কাপড় ধোয়া ও গোসল করা থেকে বিরত থাকেন, তাদের শরীরে এই পরজীবী সহজে আক্রমণ করে।”
স্ক্যাবিসের লক্ষণ বা উপসর্গ কী?
স্ক্যাবিসে আক্রান্ত হওয়ার প্রধান ও প্রাথমিক লক্ষণ হলো সারা শরীরে অসহ্য চুলকানি অনুভব করা। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শরীরের বিভিন্ন ভাঁজ যেমন আঙুলের মধ্যবর্তী স্থান, কোমর, ঘাড়, নিতম্ব, যৌনাঙ্গ, হাতের তালু, কবজি, বগলের নিচের অংশ, নাভি এবং কনুইয়ে এই রোগের সংক্রমণ বেশি দেখা যায়।
আক্রান্ত স্থানগুলোতে ছোট ছোট লালচে দানার মতো র্যাশ অথবা ফুসকুড়ি ওঠে, যা অত্যন্ত চুলকায়। এই ফুসকুড়িগুলো থেকে পানির মতো তরল নির্গত হতে পারে। সাধারণত রাতের বেলায় চুলকানির তীব্রতা আরও বাড়ে।
চিকিৎসকরা সতর্ক করে জানিয়েছেন, চুলকানোর ফলে আক্রান্ত স্থানে ক্ষত সৃষ্টি হতে পারে এবং এর ফলে অন্যান্য সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকিও বাড়ে।
তবে এই রোগের উপসর্গ বয়স্ক এবং শিশুদের ক্ষেত্রে ভিন্ন হতে পারে বলে চিকিৎসকরা উল্লেখ করেছেন। অনেক ক্ষেত্রেই শিশুরা অন্যান্য উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসে এবং পরীক্ষায় স্ক্যাবিসের সংক্রমণ ধরা পড়ে।
শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, “আমরা প্রায়ই দেখি শিশুরা ঠাণ্ডা, কাশি বা জ্বর নিয়ে আসছে, অথচ তাদের শরীরে স্ক্যাবিসের সংক্রমণও রয়েছে। এমনকি নিউমোনিয়া বা ডায়রিয়ার মতো সমস্যা নিয়ে আসা শিশুদের মধ্যেও স্ক্যাবিসের উপস্থিতি পাওয়া যায়।”
অন্যদিকে, পূর্ণবয়স্ক রোগীদের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে লালচে দানাদার ফুসকুড়ি দেখা গেলেও, পরবর্তীতে সেকেন্ডারি ইনফেকশন হলে জ্বর বা অন্যান্য উপসর্গও পাওয়া যেতে পারে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
চিকিৎসা কী?
চিকিৎসকরা স্ক্যাবিসের চিকিৎসার ক্ষেত্রে দুটি প্রধান পদ্ধতির কথা বলছেন— প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা এবং প্রতিকারমূলক চিকিৎসা। তবে, এই রোগের বিস্তার রোধে সাধারণত প্রতিরোধমূলক পরামর্শের ওপরই তারা বেশি জোর দিচ্ছেন।
ডা. আব্দুল্লাহ আল মামুন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “স্ক্যাবিসের সংক্রমণ যাতে না হয় অথবা একজনের থেকে অন্যজনে না ছড়ায়, সেই জন্য আমরা মূলত প্রতিরোধমূলক পরামর্শগুলোই দিয়ে থাকি। কারণ একটি পরিবারের কোনো সদস্য এই রোগে আক্রান্ত হলে খুব সহজেই অন্যদের মধ্যেও তা ছড়িয়ে যেতে পারে। তাই এ বিষয়ে সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরি। শুধুমাত্র একজন আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা নিলে চলবে না, যেহেতু এটি ছোঁয়াচে রোগ, তাই পরিবারের সকল সদস্যকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী একযোগে চিকিৎসা নিতে হবে।”
শরীরে পানিশূন্যতা না হলে চর্ম রোগ কম হয় বলে চিকিৎসকরা আক্রান্তদের সুষম ও তরল খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
আক্রান্ত রোগী সুস্থ হতে সাধারণত সাতদিন লাগে। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে সুস্থ হতে পনেরো দিন থেকে মাস-খানেক বা ইনফেকশন হলে তারও বেশি সময় লেগে যেতে পারে বলে জানান চিকিৎসকরা।
চর্ম রোগ বিশেষজ্ঞ মাসিউল আলম হোসেন বলেন, ‘প্যারাসাইটটা চামড়ার উপরিভাগে থাকে। এরা ভেতরে যায় না। চামড়ার উপরিভাগেই চলাচল করে, ডিম পাড়ে, বাচ্চা দেয়। নিয়মানুযায়ী প্রথম যে ট্রিটমেন্ট দেয়া হয়, তাতে এগুলো মারা যাবে।’
তিনি বলেন, তারপরে আবার পাঁচ বা সাতদিন পরে রিপিট করাই। সেক্ষেত্রে প্যারাসাইটের ডেড যে উপাদানগুলো থাকে সেটা আবার চুলকানি বাড়ায়। তখন এটাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আবার মেডিসিন দিতে হয়।
তবে চুলকানি হলেই তা ‘স্ক্যাবিস’ রোগ নয় বলে জানান চিকিৎসকরা। তাই রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য চর্ম রোগ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়?
ছোঁয়াচে রোগ স্ক্যাবিসের সংক্রমণ এড়াতে অথবা প্রতিরোধ করতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন করার ওপর জোর দিয়েছেন চিকিৎসকরা। একইসঙ্গে, সুস্থ ব্যক্তিদের আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা আরও জানিয়েছেন, আক্রান্ত ব্যক্তির পোশাক, বিছানা এবং সাবানসহ ব্যক্তিগত ব্যবহারের যেকোনো জিনিস ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা উচিত। পরিবার অথবা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় একজন ব্যক্তি স্ক্যাবিসে আক্রান্ত হলে অন্যদেরও এই রোগে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। এই কারণে, কোনো একজন আক্রান্ত হলে তার সংস্পর্শে থাকা সকলেরই একযোগে চিকিৎসা শুরু করার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মাশিউল আলম হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, “এই পরজীবী (সারকোপটিস স্ক্যাবিয়া) যখন শরীরে প্রবেশ করে, তখন এর লক্ষণ প্রকাশ পেতে দুই থেকে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। এই সময়ে আক্রান্ত ব্যক্তি সংক্রমিত থাকা সত্ত্বেও তা টের পান না। এখানেই মূল সমস্যাটি। আর এই কারণেই যখন কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত হন, তখন তার আশেপাশে থাকা সকলেরই দ্রুত চিকিৎসা শুরু করার পরামর্শ দেওয়া হয়।”
ডা. হোসেন আরও জানান, এই রোগের শুরুতে সচেতন না হলে সেকেন্ডারি ইনফেকশনের কারণে অনেক সময় কিডনির জটিলতাও দেখা দিতে পারে।
তিনি বলেন, “যদি এই রোগটিকে গুরুত্ব না দেওয়া হয় এবং সেকেন্ডারি ইনফেকশন হয়, সেক্ষেত্রে যথাযথ চিকিৎসা না নিলে এটি ধীরে ধীরে কিডনিকেও আক্রান্ত করতে পারে এবং কিডনি ড্যামেজ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বিপদটা এখানেই। যদিও এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া, তবে এর খারাপ দিক এটাই। এজন্য যখন কোনো রোগী আমার কাছে আসে, তখন আমি প্রাথমিকভাবে তার কিডনি পরীক্ষা করে দেখি।”
এই প্রেক্ষাপটে, স্ক্যাবিসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সচেতনতা এবং দ্রুত চিকিৎসার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। সূত্র: বিবিসি বাংলা
/এএস