images

হেলথ

নানা সংকটে নার্সিংখাত, আধুনিকায়নে প্রয়োজন বিশেষ পরিকল্পনা

সাখাওয়াত হোসাইন

১২ মে ২০২৫, ১০:২২ এএম

বিভিন্ন সংকট ও অনিয়ম নিয়ে চলছে দেশের স্বাস্থ্যসেবা। আর এই খাতে বড় সংকট লোকবল আর ব্যবস্থাপনার। হাসপাতালে চিকিৎসা কার্যক্রম সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন নার্স। অনেকেই তাদেরকে হাসপাতালের ‘প্রাণ’ বলে থাকেন। ইতোমধ্যে সারাদেশেই নার্স সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। সেই সঙ্গে রয়েছে দক্ষ নার্সের অভাব। আর এ সমস্যা সমাধানে শিগগিরই নেই কার্যকরী উদ্যোগের সম্ভাবনা। এ খাতে বড় ধরনের বিপর্যয় রোধ করতে চাইলে বিপুল সংখ্যক দক্ষ নার্স নিয়োগ দিতে হবে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

শুধু দেশেই নয়, বিদেশে দক্ষ নার্সের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। উপযুক্ত পরিবেশ আর শিক্ষার অভাবে তৈরি হচ্ছে না দক্ষ নার্স। আর যারা দক্ষ রয়েছেন, তাদেরও নেই পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা। ফলে অনেকেই নিজের প্রতিভা বিকশিত করার সুযোগ পান না। দেশের নার্স খাতকে ঢেলে সাজাতে এবং আধুনিকায়ন করতে প্রয়োজন সরকারের বিশেষ পরিকল্পনা। এক্ষেত্রে নার্সদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে তারা নিজেদের মেধা-মননে বিকশিত করতে পারবেন।

নার্স সংকট

বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ৬৭টি সরকারি ও ৩৭২টি বেসরকারি নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শাহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসপাতালসহ সরকারি কোনো হাসপাতালের পর্যাপ্ত নার্স নেই। অন্যদিকে, বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে রাজধানীর স্কয়ার, এভারকেয়ারসহ বেশ কয়েকটি হাসপাতালে প্রয়োজন অনুযায়ী নার্স থাকলে অন্যান্য হাসপাতালগুলোতে ব্যাপক সংকট রয়েছে, যার প্রভাব পড়ছে দেশের স্বাস্থ্যখাতে।

নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি অধিদফতর ও বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন নার্সের প্রয়োজন তিন লাখের বেশি। যদিও নিবন্ধিত নার্স আছেন ৮৪ হাজার। সে হিসেবে দেশে নার্স আছে প্রয়োজনের তুলনায় মাত্র ২৮ শতাংশ। প্রতি চিকিৎসকের বিপরীতে তিনজন নার্স থাকার কথা থাকলেও রয়েছেন দশমিক ৩০ জন। আবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানদণ্ড অনুযায়ী, প্রতি ১০ হাজার জনসংখ্যার বিপরীতে ২৩ জন নার্স থাকার কথা থাকলে বাংলাদেশে এ সংখ্যা তিনজনে।

নার্সরা জানায়, দেশের নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নেই। প্রতিষ্ঠানগুলোতে আন্তর্জাতিক মানের ব্যবস্থাপনা আর দক্ষতাসম্পন্ন লোকবলের অভাব রয়েছে।

nurse1

বেতন কাঠামো নেই

সরকারি হাসপাতালে নির্ধারিত বেতন থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। আর বেসরকারি হাসপাতাল বা প্রতিষ্ঠানে নেই কোনো বেতন কাঠামো, পদ-পদবিরও ঠিক নেই। বেসরকারিতে কোনো কোনো নার্সের কর্মজীবন শুরু হয় ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা বেতনে। আর্থিক কারণে অনেকেই যথাযথভাবে রোগীদের সেবায় মনোনিবেশ করতে পারেন না।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি গোলাম মোর্শেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, সরকার কেন যেন এই দিকে নজর দিচ্ছে না। অবহেলায় পড়ে আছে দেশের নার্সিংখাত। বারবার আমাদের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হলেও সরকারের কাছ থেকে সাড়া পাওয়া যায় না। স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন ঘটাতে হলে নার্সিংখাত উন্নত করতে হবে। যাবতীয় সমস্যা সমাধান এবং নার্সদেরকে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। সেই সঙ্গে নার্সিং শিক্ষায় ব্যাপক সংস্কার করতে হবে।

গোলাম মোর্শেদ বলেন, নার্সিং কলেজগুলো শিক্ষকের প্রকট সংকট। মানসম্পন্ন শিক্ষকের অভাব, নেই বেতন কাঠামো। এতে প্রভাব পড়ে স্বাস্থ্যখাতে। অনেক নার্সই পর্যাপ্ত বেতন-ভাতা পান না। পরিবার চালাতে খেতে হয় হিমশিম। ফলে অনেক নার্সকে হতাশায় ভুগতে হয়। ঠিক মতো স্বাস্থ্যসেবায় মনোযোগ দিতে পারেন না।

নার্সদের মতে, বর্তমানে নার্সদের জন্য পর্যাপ্ত প্রশাসনিক ও ক্যারিয়ার অগ্রগতির সুযোগ নেই। নার্সিং শিক্ষার মান ও তদারকি দুর্বল। সেই সঙ্গে বিদেশে নার্সদের কর্মসংস্থানের সুযোগ কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বিদ্যমান নিয়োগ, অর্গানোগ্রাম ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা যুগোপযোগী নয়, এসব ব্যবস্থাপনা যুগোপযোগী করতে হবে। সেই সঙ্গে রোগীদেরকে ভালো সেবা দিতে হলে নার্স নিয়োগ করতে হবে এবং যা নার্স আছে সেটাকে নিয়োগের মাধ্যমে দ্বিগুণ করা প্রয়োজন।

জানতে চাইলে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের সিনিয়র স্টাফ নার্স লাভলী আক্তার ঢাকা মেইলকে বলেন, হাসপাতালে রোগীর সবচেয়ে কাছে থাকেন নার্সরা। হাসপাতালে রোগীকে রিসিভ করার পর থেকে সেবার সবকিছুই করতে হয় নার্সদেরকে। রোগীকে সার্বক্ষণিক সরাসরি খোঁজ-খবর রাখেন নার্সরা। নার্সদের ছোঁয়ায় হাসপাতালের রোগীরা সুস্থ হয়ে উঠেন। রোগীকে সুস্থ করে তুলতে নার্স থাকেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়। সংকট কিংবা ভয়াবহ মহামারী সবসময়ই রোগীর কাছে থাকতে হয় নার্সকে। তাই নার্সিংখাতকে স্বাস্থ্যসেবায় অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন।

জানতে চাইলে সোসাইটি ফর নার্সেস সেফটি অ্যান্ড রাইটসের মহাসচিব সাব্বির মাহমুদ তিহান ঢাকা মেইলকে বলেন, বিদেশে প্রচুর চাহিদা রয়েছে নার্সদের। সেই সুযোগটা আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। কোনো নার্সকে বিদেশে যেতে হলে ভাষাগত দক্ষতাসহ নানা দক্ষতা অর্জন করতে হয়। প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা না থাকায় দেশের নার্স দক্ষতা অর্জন করতে পারেন না। এজন্য অনেক নার্সরা চাইলেও বিদেশে ক্যারিয়ার গড়তে পারেন না। এছাড়া কেউ কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগে দক্ষ হয়ে বিদেশে যাচ্ছেন, কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। দেশের নার্সদেরকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সরকারের পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ।

সাব্বির মাহমুদ তিহান বলেন, দেশের স্বাস্থ্যখাতকে আধুনিক করতে বর্তমানে প্রয়োজন উন্নতমানের নার্সিং শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নার্সিং শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো দরকার। নার্সিং শিক্ষা কার্যক্রম উন্নত করা গেলে দেশের নার্সরা বিদেশেও কর্মসংস্থান করেন নিতে পারবেন। তাতে বাংলাদেশেরই নার্সরা অনেক পিছিয়ে যাচ্ছে।

এমএইচটি