মো. রিপন হোসাইন, মাহফুজ উল্লাহ হিমু
১১ অক্টোবর ২০২৪, ০১:৫৫ পিএম
#স্বল্প সময়ে লাইসেন্স করে দেওয়ার আশ্বাস
#ফার্মাসিস্ট ছাড়াই লাইসেন্স করে দেওয়ার দাবি
#কর্মকর্তাদের সেশন ফি-এর নামে অতিরিক্ত টাকা আদায়ের প্রচেষ্টা
#কম্পিউটারের দোকান কেন্দ্রিক ফাঁদ
#সব প্রক্রিয়া অনলাইন নির্ভার ও স্বচ্ছ, দাবি কর্তৃপক্ষের
সেবা প্রত্যাশীদের সুবিধার্থে ড্রাগ লাইসেন্স গ্রহণ ও নবায়ন প্রক্রিয়া অনলাইন নির্ভর করেছে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। এর লক্ষ্য লাইসেন্স প্রক্রিয়া সহজীকরণ, সেবা প্রত্যাশীদের দীর্ঘ অপেক্ষা ও প্রতারণা প্রতিরোধ। তবে এত কিছুর পরেও ড্রাগ লাইসেন্স গ্রহণ ও নবায়ন প্রক্রিয়াকে ঘিরে চলছে দালালদের দৌরাত্ম্য। সাধারণ আবেদনকারীদের বিভ্রান্ত করে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছে একটি অসাধু চক্র।
অভিযোগ রয়েছে, কিছু অসাধু ব্যক্তি লাইসেন্স দ্রুত পাওয়ার লোভ দেখিয়ে সরকারি ফি ছাড়াও অতিরিক্ত অর্থ দাবি করছে। পরিদর্শন প্রক্রিয়ায় সহায়তা, ফার্মাসিস্ট না থাকলেও লাইসেন্স নিশ্চিতের আশ্বাসসহ নানা কৌশলে আবেদনকারীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের নানা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তারা। এক্ষেত্রে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের কর্মকর্তাদের সাথে নিজেদের সখ্যতার কথা উল্লেখ করছেন তারা। যদিও কর্তৃপক্ষের দাবি সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ড্রাগ লাইসেন্স পাওয়ার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ অনলাইন নির্ভর ও স্বচ্ছ।
তেমনই একজন ভুক্তভোগীর সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। আব্দুর রহমান (ছদ্মনাম) নামে ওই ব্যক্তিকে ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে লাইসেন্স করে দেওয়ার আশ্বাস দেন জাহিদ নামে এক ব্যক্তি। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর লাগোয়া একটি কম্পিউটার দোকানে লাইসেন্সের আবেদন করতে গিয়ে তার সাথে পরিচয় হয় ভুক্তভোগীর। অধিদফতরের কর্মকর্তাদের সাথে নিজের সখ্যতার কথা উল্লেখ করে স্বল্প সময়ে লাইসেন্স করিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।
এ বিষয়ে আব্দুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমার ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের জন্য ড্রাগ লাইসেন্সের আবেদন করতে একটি ব্যানার দেখে তার দোকানে যাই। ব্যানারে লিখা ছিল, এখানে ড্রাগ লাইসেন্সের জন্য আবেদন করা হয়। সেখানেই ওই লোকের সাথে আমার পরিচয় হয়। যে আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি চুক্তিতে করতে চাই, নাকি শুধু আবেদন করতে চাই। আমি শুধু আবেদন করব বলি। সে তখন আমাকে বলে, আপনি যদি ডিরেক্ট কন্টাক্ট করতে চান তাহলে ২০ হাজার টাকার মতো লাগবে, যা যা লাগে আমিই আপনাকে করে দেব। কিন্তু আমি নিজেই করব বলে তাকে কাগজপত্র দেই যেন সে আবেদনটা করে দেয়।’
স্বল্প সময়ে করে দেওয়ার প্রস্তাব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অধিদফতর থেকে জানতে পেরেছি, আবেদন করার ৬০ দিনের মধ্যে তারা একটি মেসেজের মধ্যে পরবর্তী আপডেট জানাবে। আমার আবেদনের এখনও দুইমাস হয়নি। তো আমি অপেক্ষা করে আছি। সে মাঝে নিজ থেকে আমাকে ফোন দিয়ে বলেন, আপনার কাজটি তো আটকে আছে। আপনি যদি এ কাজটি তাড়াতাড়ি করতে চান, তাহলে একটা সেশন ফি দিতে হবে। এতে আপনার ৯ হাজার টাকা লাগবে। আর আমাকে কিছু টিপস দিলেন। আমি রেসপন্স করিনি। ব্যস্ততার মাঝে থাকায় তার সাথে যোগাযোগও করিনি। এর মধ্যে সে একাধিকবার আমার সাথে যোগাযোগ করে কনভিন্স করার চেষ্টা করেছে।’
এদিকে এ ধরনের খরচের বিষয়েও খোঁজ নিয়েছেন ওই ব্যক্তি। অধিদফতরে খোঁজ নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি এ ধরনের খরচের খোঁজ নেওয়ার জন্য অধিদফতরে আসি। তাদের সেশন ফি বলে কোনো কিছু আছে কিনা তা জানতে চাই। তারা আমাকে এ ধরনের কোনো খরচ নাই বলে জানিয়ে অপেক্ষা করতে বলেছে। তারা বলছে, অফিসের প্রসেডিউর অনুযায়ী ৬০ কর্মদিবসের মধ্যে মেসেজের মাধ্যমে জানানো হবে। এদিকে ওই ব্যক্তি বলছে, আমি ওকে টাকা দিলে নভেম্বরের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে হাতে লাইসেন্স বুঝিয়ে দেবে। সে খুবই কনফিডেন্ট যে, সে এই অফিসের লোকদের সাথে কাজ করে, সে এই কাজ করে দিতে পারবে। সে সিকিউরিটির নিশ্চয়তা দিয়ে আমি কাজ শেষে অনলাইন থেকেই লাইসেন্স সংগ্রহ করতে পারব বলে জানিয়েছে। আমি নিজে আবেদন করায় এখন সে ১০ হাজার টাকায় কাজটা করে দেবে বলেছে। স্বাভাবিকভাবে আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকা লাগে।’
দালালের মুখোমুখি ঢাকা মেইল
এদিকে অনুসন্ধানে আব্দুর রহমানের অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে ঢাকা মেইল। সেবাপ্রত্যাশী পরিচয়ে জাহিদ নামে ওই ব্যক্তির সাথে সরাসরি কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। এসময় তিনি বলেন, ‘আমি সবই রেডি করতে পারব। কতদিন লাগবে তা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। এটা নির্ভর করে মিটিংয়ের উপর। ২২ তারিখ একটা মিটিং হওয়ার সম্ভাবনা আছে। হলে এই সপ্তাহে যে আবেদনগুলো পরবে সেগুলো মিটিংয়ে আসবে। দুই মাস পরপর এ মিটিং হয়। কখনও কখনও তিন থেকে চার মাসও চলে যায়। একদম সঠিক তারিখ ডিজি স্যারও বলতে পারবে না। আপনার কপাল ভালো হলে এই মাসের শেষেও পেয়ে যাবেন। এতে আপনার মিনিমাম ২২ হাজার টাকা খরচ হবে।’
তবে আলোচনার মাধ্যমে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকায় রাজি হন তিনি। এসময় ডাক্তার বসেন কিনা, এসি আছে কিনা এই বিষয়ে জানতে চান। এসি ও ডাক্তারের চেম্বার থাকলে খরচ আর বেশি পড়তো বলেও জানান। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘আমি তাদের সাথে কথা বললাম। পরে কাগজপত্র নিয়ে দেখা করতে বলে, যদি দেখে উনার মনে হয় এমাউন্ট কম হয়েছে তাহলে অতিরিক্ত টাকা চাইবে। মনে হচ্ছে, আমরা স্বাধীন হইছি, আসলে হইনি।’
কথা শেষে একটি দোকান দেখিয়ে সেখান থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের তালিকাসহ একটি কপি নিয়ে যেতে বলেন জাহিদ। ফার্মাসিস্ট যদি না থকে তাহলে কি হবে জানতে চাইলে তারা এটা ব্যবস্থা করে দেবে বলেও জানায়।
অধিদফতরের ওয়ান স্টপ সার্ভিস থেকে যা জানা গেল
ওয়ান স্টপ সার্ভিসের থেকে জানানো হয়, আবেদনের জন্য কিছু কাগজপত্র প্রয়োজন হয়, যা অধিদফতরের ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে। আবার ওয়ান স্টপ অফিসের বাইরেও টানিয়ে রাখা আছে। ওই কাগজপত্র নিয়ে ওয়েবসাইটে একটি ফরম ফিলাপ করে আবেদন করতে হয়। ওটা করলে সেবাপ্রত্যাশীর কাজ শেষ। যদি আবেদনকারীর কাগজে কোনো সমস্যা থাকে তাহলে তা এসএম জানানো হয়। আর যদি কোনো সমস্যা না থাকে তাহলে মিটিংয়ে তার কাগজপত্র যাচাই-বাছাই শেষে অনুমোদন দেওয়া হবে। আবেদনকারীকে তা মেসেজের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হবে। তখন তিনি উনার প্রোফাইলে ঢুকে তা নিয়ে নেবে।
সময় ও খরচের বিষয়ে দায়িত্বরত কর্মকর্তা বলেন, এক্ষেত্রে ৬০ কর্মদিবসের কমবেশি সময় লাগে। কমিটির বৈঠকের জন্য সিভিল সার্জন মহোদয়ের অ্যাপয়েন্টমেন্টের প্রয়োজন হয়। অনেক সময় এক মাসেও হয়ে যায়। লাস্ট মিটিং এক মাস আগে হয়েছিল। এরপর সবাই পেয়ে গেছে। আমাদের এখানে অতিরিক্ত খরচের কিছু নাই। দালালের কোনো কিছু নেই। আবেদনের জন্য লোকেশন অনুযায়ী সরকারি চালান ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। পৌরসভা বা সিটি করপোরেশন এলাকায় সরকারি চালান ফি আড়াই হাজার টাকা ও এর ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ সর্বমোট সরকারি খরচ ২ হাজার ৮৭৫ টাকা।
লাইসেন্স প্রক্রিয়ার দালালের কোনো সুযোগ নেই
ড্রাগ লাইসেন্স প্রক্রিয়ায় দালালের দৌরাত্ম্য কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল কাজী মো. রশীদ-উন-নবী। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ড্রাগ লাইসেন্সের সব কাজ এখন অনলাইন নির্ভর। সেবাপ্রত্যাশী ব্যক্তি বাসায় বসে আবেদন করতে পারেন। এটি নিয়ে অনেকেই দোকান খুলে বসতে পারে। আমাদের পক্ষে তা বন্ধ করা সম্ভব না। আমরা বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষকে ওয়েবসাইটে ঢুকে আবেদন করতে বলেছি। এর বাইরে লাইসেন্স পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কেউ যদি বলে তিনি করিয়ে দেবেন, তাহলে তাকে ধরিয়ে দেন। আমাদের পক্ষ থেকে সেবাপ্রত্যাশীদের সতর্ক করা হয়। দোকান মালিকদেরও এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
মিটিংয়ের তারিখ ও ফার্মাসিস্ট ছাড়াই ভেরিফিকেশন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ সংক্রান্ত মিটিংটি জেলা অফিসে হয়। মোট ছয়জন সদস্যের সমন্বয়ে কমিটি আবেদন ভেরিফাই করে। সেখানে একজন ম্যাজিস্ট্রেট, সিভিল সার্জনের প্রতিনিধি, আমাদের একজন প্রতিনিধি থাকে ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রতিনিধি থাকেন। প্রতি জেলায় আলাদা আলাদা মিটিং হয়। আমাদের এখানে কোনো মিটিং হয়না। আর পরিদর্শনের বিষয়টি জেলা পর্যায়ে হয়ে থাকে। একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে এটি হয়। আবেদনে দোকানের সাথে যুক্ত থাকা ফার্মাসিস্টের রেজিস্ট্রেশন নম্বর ও ফোন নম্বর যুক্ত করা থাকে। সেটা ভেরিফাই করা হয়।
এমএইচ/এমএইচটি