images

হেলথ

কেমন আছেন বাংলাদেশের নার্সরা?

মাহফুজ উল্লাহ হিমু

১২ মে ২০২২, ০৯:৩৩ এএম

স্বাস্থ্য সেবায় নার্সিং পেশার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। মানবতার এই ফেরিওয়ালারা জীবনের অন্তিম ও অসহায় মুহূর্তে নিজেদের ভূমিকার মাধ্যমে মানব ইতিহাসে অনন্য স্থান করে নিয়েছেন। মহামারী করোনাসহ অসংখ্যবার নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে। শুধুমাত্র গত দুই বছরে দেশে অন্তত ৩৩ জন নার্স করোনা রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। মহান এই পেশায় নিয়োজিতদের সম্মানে ১২ মে বিশ্বব্যাপী আন্তার্জাতিক নার্স দিবস উদযাপিত হয়। আধুনিক নার্সিং পেশার রূপকার ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের জন্মদিন উপলক্ষে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী এ তারিখে আন্তর্জাতিক নার্স দিবস উদযাপন করা হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশেও উদযাপিত হয় দিবসটি। 

নার্সিং পেশা অত্যন্ত সম্মান ও গৌরবের হলেও বাংলাদেশে তা অবেহেলিত। সম্প্রতিক বছরগুলোতে নাসিং পেশাকে সরকার দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা দিয়েছে। তৈরি করা হয়েছে প্রথম শ্রেণির পদও। করোনাকালসহ গত কয়েক বছরে ২০ হাজার নার্স সরকারিভাবে নিয়োাগ পেয়েছেন। এরপরেও সামাজে মহান এই পেশাটি নিয়ে নানা নেতিবাচক ধারণা প্রচলিত রয়েছে। ফলে গুরুত্বপূর্ণ এই পেশায় লোকবল ঘাটতি, কাজের পর্যাপ্ত সম্মানী না পাওয়াসহ অসংখ্য সমস্যা দেখা যায়। একইসঙ্গে এই পেশা নিয়োজিতদের বিরুদ্ধে অপেশাদার আচরণ, অদক্ষতা ও দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগও রয়েছে। বিশেষত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাধারণ রোগীর স্বজনদের নার্সদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করতে দেখা যায়।

নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদফতরে তথ্য মতে, সারাদেশে নিবন্ধিত নার্সের সংখ্যা ৭৬ হাজার ৫১৭ জন। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালগুলোতে কর্মরত নার্সের সংখ্যা ৪২ হাজার ৩৩০ জন। বাকিরা দেশের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত রয়েছেন। দেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে মোট ৪২৯টি নার্সিং ইনস্টিটিউট রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি পর্যায়ে ১৩টি বিএসসি নার্সিং কলেজ, ৪৪টি ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট ও একটি সরকারি পোস্টগ্যাজুয়েট কলেজ রয়েছে। 

কেমন আছেন সেবক-সেবিকারা

জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সিনিয়র স্টাফ নার্স মীনাক্ষী রানী দাস ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বর্তমানে সরকারি হাসপাতালে আমাদের কাজের পরিবেশ অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক ভালো। আমার প্রতিষ্ঠানের বর্তমান পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হকের সার্বিক সহযোগিতায় ও দিক নির্দেশনায় আমরা সংগঠিতভাবে রোগীদের নিয়মিত চিকিৎসা প্রদান করে যাচ্ছি। একটা সময় আমাদের জনবলের ঘাটতি ছিল। কিন্তু বর্তমানে তা অনেকটাই সমাধান হয়েছে। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে নতুন ২০ হাজার নার্স নিয়োগের ফলে আমারা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় ভালো সেবা দিতে পারছি। বিশেষত করোনা মহামারীকালে ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতাল হিসেবে আমরা সফলতার সাথে কাজ করেছি।’

nurses

দ্বিতীয় শ্রেণি মর্যাদার কথা উল্লেখ করে এই নার্সিং কর্মকর্তা বলেন, ‘বর্তমান সরকারের সময়ে আমরা অনেক কিছু পেয়েছি। তবে এর মধ্যে সব থেকে বড় পাওয়া দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা। একইসঙ্গে নার্সদের জন্য প্রথম শ্রেণিরও বেশ কিছু পদ তৈরি করা হয়েছে। এতে আর্থ-সামাজিকভাবে নার্সরা সম্মানিত ও লাভবান হয়েছে। আমাদের সমাজে চাকরির গ্রেড অনুযায়ী সামাজিক অবস্থান নির্ধারণ করা হয়। গ্রেড বৃদ্ধিতে আর্থিক ও সামাজিকভাবে লাভবান হওয়ায় সেবার মানও বৃদ্ধি পেয়েছে। নাসিং পেশার ব্যাপারে আগে যে নেতিবাচক ধারণা ছিল তা পরিবর্তন হচ্ছে। অনেক তরুণ নার্সিংকে নিজেদের পেশা হিসেবে বেছে নিতে আগ্রহী হয়েছে। এ জন্য নার্স সমাজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের প্রতি কৃতজ্ঞ।’

তবে সরকারি নার্সদের অবস্থার উন্নতি হলেও ভিন্ন চিত্র বেসরকারি নার্সদের ক্ষেত্রে। কর্মক্ষেত্রে তারা এখনও বঞ্চিত জানিয়ে সোসাইটি ফর নার্সেস সেফটি অ্যান্ড রাইটসের (এসএসএসআর) সাধারণ সম্পাদক সাব্বির মাহমুদ তিহান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সরকারির মতো বেসরকারি নার্সদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো বেতন কাঠামো নেই। ফলে ঢাকার কোনো একটি করপোরেট হাসপাতালে একজন নার্সকে হয়তো ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হচ্ছে, আবার ঢাকার বাইরের কোনো হাসপাতালে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হচ্ছে। এতে নার্সরা তাদের প্রাপ্ত সম্মানী থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ সমস্যা নিরসনে আমরা সার্বজনীন একটি বেতন কাঠামোর দাবি জানিয়ে আসছি। যেহেতু এটি একটি দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরি, সেহেতু সকলের বেতন স্কেলটিও সেই মানের হওয়া উচিত। অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতালগুলো নিয়মিত সরকারি তদারকিতে থাকে না। এসব প্রতিষ্ঠানে নিবন্ধিত চিকিৎসক ছাড়া কাউকে চিকিৎসক হিসেব নিয়োগ না দেওয়া হলেও নার্সদের ক্ষেত্রে তা মানা হয় না। হাসপাতালগুলোর লক্ষ্য থাকে কম খরচে জনবল নিয়োগের। সেক্ষেত্রে তারা অনিবন্ধিত, শিক্ষানবিশ নার্সদেরও নিয়োগ প্রদান করে। এতে সেবার মান রক্ষিত হচ্ছে না।’

নার্সিং পেশার সীমাবদ্ধতা ও রোগীদের অসন্তুষ্টি

বাংলাদেশে সেবামূলক প্রায় সব কয়টি পেশায় কর্মরতদের বিরুদ্ধে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করার অভিযোগ সাধারণ জনগণের। নার্সিংয়ের মতো সেবামূলক পেশার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। কর্তব্যরত নার্সদের বিরুদ্ধে সেবা প্রত্যাশীদের দায়িত্বে অবহেলা ও বাজে ব্যবহারসহ বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। তাদের অভিযোগ সেবিকাদের ডাকলে সব সময় পাওয়া যায় না। একাধিকবার ডাকতে গেলে অনেক ক্ষেত্রে অনাকাঙ্খিত আচরণের মুখোমুখি হতে হয়। বিশেষত রক্ত পরীক্ষার মতো বিষয়ে রোগীর স্বজনদের অনেক সময় দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়।

nurses 

এসব অভিযোগের বিষয়ে নার্স নেতা সাব্বির মাহমুদ বলেন, ‘দেশের হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত নার্স নেই। চিকিৎসকরা রোগীকে প্রেসক্রাইব করে ওয়ার্ড ছাড়েন। রাউন্ড শেষে চলে যাওয়ার পর রোগী আর চিকিৎসকের কাছে যান না এবং চাহিদাও থাকে না। এর পরের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নার্সদের। সমস্যাটা এখানেই, একজন নার্সের পক্ষে একইসঙ্গে ১০ থেকে ২০ জন রোগীকে তার সেবার মাধ্যমে সমানভাবে সন্তুষ্ট করা সম্ভব হয় না। অর্থাৎ আদর্শ  নার্সিং সেবা পান না তারা। রোগীরা সবাই চান যেনো তার সর্বাধিক কেয়ার করা হয়। কারণ সবার কছেই নিজের সমস্যাটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। একজন নার্সকে অনেক রোগী সামলাতে হয়। অনেক সময় জরুরি বিবেচনায় তারা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেবা প্রদান করেন। এক্ষেত্রে কম জটিল রোগীর স্বজনরা অসন্তুষ্ট হয়। তাই নার্সের সংখ্যা না বাড়াতে পারলে এসব সমস্য দূর হবে না। পর্যাপ্ত নার্স নিয়োগ দেওয়া হলে রোগীরা মানসম্মত সেবা পাবেন এবং এই অভিযোগগুলো থাকবে না।’

নাসিং সেবার মানোন্নয়নে নার্সিং শিক্ষা কাঠামো সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে নার্সরা ডিপ্লোমা ও বিএসসি নার্সিং কোর্সের মাধ্যমে এ পেশায় প্রবেশ করেন। দুটিতেই তারা উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা পর ভর্তি হচ্ছেন। এখানেও সমস্যা রয়েছে। দেশের শিক্ষা কাঠামোতে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা একজন ব্যাক্তির জন্য কোনো ডিপ্লোমা কোর্স চালু নেই। অন্যান্য সকল কোর্স এসএসসি বা সমমান পাসের পর শুরু হয়। কিন্তু নার্সিং ডিপ্লোমায় তারা উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর ভর্তি হচ্ছেন। এতে নার্সিং শিক্ষার্থীরা ডিপ্লোমা শেষে পুনরায় সমমর্যাদার ডিগ্রি পাচ্ছেন। এই অবস্থায় আমরা অভিন্ন কোর্স চালুর দাবি জানিয়ে আসছি। এতে পেশার ক্ষেত্রে ডিপ্লোমা ও বিএসসি নার্স বিভেদ দূর হবে। কারণ তারা আলাদা পড়াশোনা করলেও একই পদে নিয়োগ পায়। যদিও দুইটার মান ভিন্ন।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী মান সম্মত স্বাস্থ্যসেবার জন্য একজন চিকিৎসকের বিপরীতে তিন জন নিবন্ধিত নার্স প্রয়োজন। বাংলাদেশে মোট ১ লাখ ২ হাজার ৯৯৭ জন নিবন্ধিত চিকিৎসকের বিপরীতে নিবন্ধিত নার্স রয়েছেন মাত্র ৭৬ হাজার ৫১৭ জন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চিকিৎসকের অনুপাতে বর্তমানে নার্স থাকা উচিত ৩ লাখ ৮ হাজার ৯৯১ জন। 

এদিকে নার্সদের সংগঠন সোসাইটি ফর নার্সেস সেফটি অ্যান্ড রাইটসের তথ্যমতে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী মান সম্মত স্বাস্থ্যসেবার জন্য একজন চিকিৎসকের বিপরীতে তিন জন নিবন্ধিত নার্স প্রয়োজন। বাংলাদেশে মোট ১ লাখ ২ হাজার ৯৯৭ জন নিবন্ধিত চিকিৎসকের বিপরীতে নিবন্ধিত নার্স রয়েছেন মাত্র ৭৬ হাজার ৫১৭ জন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চিকিৎসকের অনুপাতে বর্তমানে নার্স থাকা উচিত ৩ লাখ ৮ হাজার ৯৯১ জন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বর্তমানে দেশে চিকিৎসকের অনুপাতে নার্সের ঘাটতি ২ লাখ ৩২ হাজার ৪৭৪ জন। সরকারি হাসপাতালে কর্মরত নার্সের সংখ্যা মাত্র ৪২ হাজার ৩৩০ জন। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল।

nurses

এ অবস্থায় সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক সাব্বির মাহমুদ তিহান বলেন, ‘ঘাটতি পূরণে সরকার গত পাঁচ বছরে নার্সিং কলেজের সংখ্যা বাড়িয়েছে। তবে সে সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। ঢাকায় সরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে চারটি, বিপরীতে সরকারি নার্সিং কলেজ রয়েছে মাত্র দুইটি। আদর্শ রেসিও মেনটেইন করতে অন্তত ১০ থেকে ১২টি কলেজ থাকা প্রয়োজন ছিল। সরকারি হাসপাতালগুলোতে কাজের চাপ ও সেবার মান বাড়াতে সরকারিভাবে আরও অধিক নার্স নিয়োগ দিতে হবে। যেনো চিকিৎসকদের তিনগুণ নার্স থাকে।’

এসব দাবি ও সমস্যার বিষয়ে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদফতরের মহাপরিচালক সিদ্দিকা আক্তারের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও বক্তব্য নেওয়া যায়নি। 

এমএইচ/এএস