মোস্তফা ইমরুল কায়েস
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৫:৫৪ পিএম
গাজীপুরের টঙ্গী এলাকা থেকে ৩ বছরের শিশু রোহানকে নিয়ে এসেছেন জসিম ও সাবিনা দম্পতি। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত হাসপাতালের জরুরি বিভাগে অপেক্ষা করছিলেন তারা। জসিম দম্পতির একমাত্র ছেলের গত তিনদিন থেকে জ্বর। স্থানীয় চিকিৎসক দেখিয়েছেন, ওষুধ খাওয়াচ্ছেন কিন্তু কাজ হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে সাত সকালে হাসপাতালে ছুটে এসেছেন সেবা পেতে। কিন্তু বিকেল গড়ালেও চিকিৎসকের কাছে যেতে পারেননি তারা। বিকেল তিনটা তখনও সিরিয়াল আসেনি তাদের। তাদের সাথে যখন কথা হচ্ছিল অন্তত শতাধিক রোগীর স্বজন সিরিয়ালের জন্য অপেক্ষমাণ। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে। আবার কেউ কেউ দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। বাধ্য হয়ে কেউ কেউ সিরিয়ালে ডাক না পাওয়ায় অন্য হাসপাতালে ছুটছেন। কারণ তাদের শিশুর অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে।
গত মঙ্গলবার জাতীয় শিশু হাসপাতালের জরুরি বিভাগে এমন চিত্র দেখা গেছে।
ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, হাসপাতালটিতে চিকিৎসা পদ্ধতি ভালো, কিন্তু সেবা পেতেই ঘাম ছুটে যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে সেবা পেতে হয়। প্রাথমিক সেবা পেয়ে ভর্তি হতে হলে লাগে লবিং। পরিচিত ব্যক্তির রেফারেন্স আরও কত কী! আর সিট পেতে হলে তো রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়।
হাসপাতালটিতে এখন প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নিউমোনিয়া, ডেঙ্গু ও জ্বরে আক্রান্ত শিশু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু নির্ধারিত আসনের চেয়ে কয়েকগুণ রোগী আসছে প্রতিদিন। সকাল হলেই ভিড় বাড়তে থাকে। বিকেলে বাড়ে ঢাকার বাহির থেকে আসা রোগী ভিড়। সকাল ৭ টার পর যদিও টিকেট দেওয়া হয় না, কিন্তু এরপরও রোগীর স্বজনরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকেন। দুপুর ২ টার পর থেকে সকাল ৭ টা পর্যন্ত চলে রোগী দেখানোর টিকেট বিক্রি।
হাসপাতালটির জনসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তা আব্দুল হালিম হাকিম জানালেন, হাসপাতালটিতে মোট সিট রয়েছে ৬৭৩টি। এর মধ্যে ৪০টির বেশি রয়েছে ফ্রি সিট। সেগুলোতে যারা সিট পান তাদেরকে পুরোদমে সব ফ্রি দেওয়া হয়। কিন্তু তার এই দাবির সত্যতা মেলেনি হাসপাতালটি সরেজমিনে ঘুরে।
শুধু সিটই ফ্রি, বাকী সব কিনতে হয়
চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ থেকে দুই বছরের মেয়েকে নিয়ে এসেছেন জামাল শেখ (ছদ্মনাম)। ফ্রিতে বেড পেয়েছেন। কিন্তু গত চারদিনে তাকে ৫ হাজার টাকার বিভিন্ন ওষুধ কিনতে হয়েছে। তবে হাসপাতাল থেকে স্যালাইনটাই শুধু ফ্রিতে পেয়েছেন। বাকী সব তাকে কিনে চলতে হচ্ছে।
জামালের কথার সত্যতা পাওয়া গেলো আরও কয়েকজন রোগীর স্বজনের সাথে কথা বলেন। তারাও জানালেন, ফ্রিতে তারা বেড পেয়েছেন, এতটুকুই। সব কিছু কিনতে হচ্ছে। নাপা, প্যারাসিটামল ছাড়া দামী তেমন কোনো ওষুধ তাদেরকে সরবরাহ করা হয়নি। তারা বেশির ভাগ ওষুধই কিনেছেন বাহিরের ফার্মেসী থেকে।
ডেঙ্গু আক্রান্ত সাত বছরের সন্তানকে নিয়ে গত সাতদিন থেকে হাসপাতালটিতে কাটাচ্ছেন শাহীন আলম। তিনি লালবাগ থেকে এসেছেন। ঢাকা মেইলকে শাহীন বলেন, আমরা প্রতিদিন সাতশ টাকা সিট ভাড়া দিচ্ছি। ফ্রি কি জানলাম না।
মিরপুর শেওড়াপাড়া থেকে তিন বছরের ছোট মেয়েকে নিয়ে এসেছেন মজদুল হক। তিনি বলছিলেন, সাতদিনে আমার পকেট থেকে ২০ হাজার টাকা চলে গেছে। কই খাবারটাও তো এখানে কেউ ফ্রি দিলো না।
এখনো সেকেলে পদ্ধতি ভর্তি প্রক্রিয়া!
মঙ্গলবার বিকেলে জরুরি বিভাগের সামনে শতাধিক শিশু রোগীকে নিয়ে বাবা-মাসহ আত্মীয়স্বজনদের ভিড়। তখনো চলছে জরুরি বিভাগের কাউন্টারে কাজকর্ম। ভর্তি প্রক্রিয়ার কাজে জড়িতরা হাতে লিখছেন আর সেটি পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ব্যক্তিকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। সেই সময় টানা ছয় ব্যক্তি কাজ করলেও তাদের কাজ শেষ হচ্ছিল না।
হাতিরঝিল এলাকা থেকে বোনের তিন মাসের ছেলেকে নিয়ে এসেছেন তুহিন হাওলাদার। তাদের ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতেই ঘণ্টা লেগেছে। তিনি বলছিলেন, ডিজিটাল যুগ অথচ এত সময় লাগে! তার বোনের ছেলের কিডনী সমস্যা। দুপুর ১২ টায় এসেছেন কিন্তু সাড়ে তিনটার সময়ও সেই শিশুকে ডাক্তার দেখাতে পারেননি। তার সাথে যখন কথা হচ্ছিল বাচ্চাটিকে তার নানী কোলে নিয়ে জরুরি বিভাগের সামনে হাঁটাচলা করছিলেন।
তুহিন ঢাকা মেইলকে বলেন, কাউন্টারে যারা কাজ করেন তারা হাতে করেন। ফলে দ্রুত কোনো কাজ করতে পারেন না। এ কারণে দ্রুত রোগীরাও সেবা পান না। সব মিলিয়ে এই হাসপাতালটিতে ঢেলে সাজিয়ে যুগোপযোগী করা দরকার। এখনো নাম ধরে রোগীদের ডাকা হয়, সত্যি যা অবাক করার মতো।
তিনি মনে করেন, হাসপাতালটিতে চিকিৎসা পদ্ধতি ভালো, কিন্তু পরিসর কম। এজন্য আরও বড় পরিসরে করা উচিত। এখনো আউটডোরে সেবা নিতে হলে পুরাতন ও সেকেলে পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়। যা পুরাতন পদ্ধতি। ফলে ডিজিটাল যুগের সাথে যায় না। সব কিছু ডিজিটাল হওয়া উচিত।
সুযোগ সন্ধানী আনসার সদস্যরা!
হাসপাতালটিতে এখন প্রতিদিন নিউমোনিয়া ও ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে অভিভাবকরা আসছেন। তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় থেকেও কেউ পাচ্ছেন না এনআইসিইউ আবার কেউ আইসিইউ। ফলে তাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে হাসপাতালটিতে দায়িত্বপালনকারী আনসার সদস্যরা নানা বাণিজ্যও করছেন। তাদের অধিকাংশই বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতালে রোগী পাঠিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পরও কতটুকু ভুক্তভোগীরা সেবা পাচ্ছেন তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
সেন্টুর ছেলের অপারেশন কবে হবে?
আশুলিয়া থেকে গার্মেন্টস কর্মী সেন্টু এসেছেন তার ছেলের প্রসাবের রাস্তায় অপারেশন করাবেন বলে। গত শনিবার সেন্টুর সাড়ে ১০ বছরের একমাত্র ছেলে আব্দুল্লাহকে বহুকষ্টে তিনি ভর্তি করিয়েছেন। কিন্তু মঙ্গলবার বিকেলেও তার অপারেশন করার নাম নেই।
তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ডাক্তাররা আসছে আর দেখছে। কিন্তু কবে অপারেশন হবে তা বলছে না। এখানে তো লবিং ছাড়া দেখি কিছুই হয় না। অনেক কষ্টে একটা সিট পাইছি। আর কতদিন থাকব। চাকরি তো করি, এভাবে থাকলে তো চাকরিটাও চলে যাবে।
তিনি জানালেন, গত চারদিন থেকে হাসপাতালে থাকতে তাকে লোন করতে হয়েছে। এখনো অপারেশনের টাকা জোগাড় করা বাকী। এই টাকা কোথা থেকে আসবে তা তিনি জানেন না। তিনি কম খরচ হবে শুনে এসেছিলেন কিন্তু এখানে এসে পুরাই বিপরীত চিত্র দেখছেন।
হাসপাতালটির পরিবেশ বদলেছে তবে-
তেজগাঁও এলাকা থেকে আসা নাজমুল হাসান ঢাকা মেইলকে বলছিলেন, তিন বছর আগে এই হাসপাতালে তিনি তার সন্তানকে নিয়ে এসেছিলেন। তখন পরিবেশ ও সেবার মান খুব নাজুক ছিল। কিন্তু সেটা এখন অনেকটাই বদলেছে। চিকিৎসক ও নার্সদের মানসিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। তবে জনবল সংকট ও জায়গার অভাব আছে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের একমাত্র শিশু হাসপাতাল, কিন্তু আবাসনসহ যাবতীয় জিনিসগুলো বড় পরিসরে হওয়ার দরকার ছিল। সেটা যদিও বর্তমানে নেই, হয়নি।
শুধু নাজমুলই নন, এই হাসপাতালে আসা রোগীরা বলছেন, সেবার মান ভালো কিন্তু এই সেবা পেতেই ঘাম ছুটছে তাদের। পরিবেশও বদলেছে, কিন্তু বদলায়নি সেকেলের সেবা পদ্ধতি।
এসব বিষয়ে শিশু হাসপাতালের পরিচালক প্রফেসর জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, বর্হিবিভাগ আরও বড় করার পরিকল্পনা চলছে। যেহুতু আমাদের জায়গা কম। তাই বিভিন্ন বিভাগগুলো বড় করা যাচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে আমাদের কথাও হয়েছে। রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এজন্য আমরা একটি রুম নয়, প্রায় সময় দুটি রুমে রোগী দেখানোর ব্যবস্থা করে থাকি।
তিনি আরও বলেন, আমরা যাতে কোনো রোগী দাঁড়িয়ে না থাকে তার জন্য হেল্প ডেস্ক চালু করতে যাচ্ছি। যে রোগীটা বেশি অসুস্থ তা রাউন্ড দিয়ে দেখবে একজন নার্স। এজন্য আমরা চারজন নার্স সেখানে নিয়োজিত করব।এছাড়াও দূরদুরান্ত থেকে আসা রোগীরা কোথায় যাবেন, কি করবেন এসব বিষয় হেল্প ডেস্ক থেকে পরামর্শ দেবে তার ব্যবস্থা করছি। এছাড়াও কোনো আনসার সদস্য যাতে রোগীদের প্রলুদ্ধ করে অন্য হাসপাতালে নিতে না পারে তার জন্য নতুন আনসারদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এরপরও অভিযোগ আসলে তাদেরও বদলে অন্যদের আনা হবে।
টিকেট কাউন্টারে মান্ধাতার আমলের পদ্ধতি ব্যবহার করে কর্মীরা কাজ করেন বিষয়টি জানালে তিনি বলেন, আমরা এ বিভাগটিকে ডিজিটালাইজড করার জন্য কাজ করছি। যাতে আর কাউকে হাতে কোনো কাজ করতে না হয়। তাতে রোগীদের ভোগান্তিও কমবে, দ্রুত চিকিৎসক দেখাতে পারবেন তারা।
এমআইকে/এমএইচএম