images

হেলথ

দেরিতে হাসপাতালে আসাই কি ডেঙ্গুতে এত মৃত্যুর কারণ?

মাহফুজ উল্লাহ হিমু

২৬ জুলাই ২০২৩, ০৯:২৫ এএম

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের স্বাস্থ্যখাতের সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু। দেশে এর সূচনা ষাটের দশকে হলেও ডেঙ্গু প্রথম আলোচনায় আসে ২০০০ সালে। এরপর থেকে প্রায় প্রতিবছরই বর্ষার আগে ও পরে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যায়। তবে এটি ভয়ানক আকার ধারণ করে ২০১৯ সালে। এরপর থেকে প্রায় প্রতি বছরই ডেঙ্গু হানা দিচ্ছে। শুরুতে এটি মহানগরকেন্দ্রিক থাকলেও বর্তমানে তা সারা দেশব্যাপী ছড়িয়েছে। একইসঙ্গে মৃত্যুর হারও বেড়েছে বহুগুণ।

চলতি বছরের ২৫ জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে ৩৭ হাজার ৬৮৮ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আর মারা গেছেন ২০১ জন। যা গত বছরের তুলনায় বহুগুণে বেশি। ২০২২ সালে ২৪ জুলাই পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা ছিল মাত্র দুই হাজার ১৪৬ জন। আর মৃত্যু হয়েছিল ছয়জনের। অর্থাৎ এই বছর ডেঙ্গু অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় অধিক সংক্রামক ও প্রাণঘাতী। 

চলতি বছরে ডেঙ্গুতে এত বেশি মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে এসব রোগীর সেবা দেওয়া একাধিক হাসপাতাল পরিচালকের সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। মৃত্যু ও ঝুঁকি নিয়ে কথা বলেন সর্বোচ্চসংখ্যক রোগী থাকা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক এবং মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান। তারা উভয়ই ঢাকা মেইলকে জানান, ডেঙ্গুতে মৃত্যুবরণ করা রোগীরা হাসপাতালে অত্যন্ত জটিল অবস্থায় আসেন। তাদের অনেকে শক সিনড্রোমে ভোগে মাল্টিপল অর্গান বিকল অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হন। ফলে তাদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রেখে চিকিৎসা দিতে হয় এবং যাদের অনেকে মৃত্যুবরণ করেন। 

কী ধরনের রোগী হাসপাতালে ভর্তি নেওয়া হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে উভয় পরিচালক জানান, ডেঙ্গু রোগীদের চাপ ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে তুলনামূলক জটিল রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি নেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের চিকিৎসা গাইডলাইন অনুযায়ী বিপদচিহ্ন রয়েছে এমন রোগীদেরই ভর্তি নেওয়া হচ্ছে। ডেঙ্গু হলেই হাসপাতালে আসতে হবে না। 

একজন রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পর কখন হাসপাতালে আসবে- এটি কে নির্ধারণ করবে, এটা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। যদি রোগী নিজেই ঠিক করেন তাহলে জটিল অবস্থায় হাসপাতালে এলে এবং তার মৃত্যু হলে দায় কার? সাধারণ মানুষ কি সরকারি গাইডলাইন পড়েন? এ বাস্তবতায় জটিল রোগী ছাড়া হাসপাতালে ভর্তি না নেওয়া এবং মৃত্যুর জন্য জটিল অবস্থায় হাসপাতালে আসাকে দায়ী করা পরস্পরবিরোধী বলে মনে করেন অনেক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। তবে অনেকেই একে পরস্পরবিরোধী নয় জানিয়ে কখন হাসপাতালে ভর্তি হবে সে বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো তাগিদ দেন।

হাসপাতালে আসা ও মৃত্যুসংক্রান্ত বক্তব্য কি পরস্পরবিরোধী?
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংক্রামণ রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার (সিডিসি) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এটা স্ববিরোধী অবস্থান। আমার মতে, ডেঙ্গু হলেই রোগীর হাসপাতালে যাওয়া উচিত। হাসপাতালে রোগীর পিসিভি, প্লাটিলেটসহ সব শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করবে। প্রয়োজনে ডে কেয়ার সার্ভিস দেবে। এরপর শারীরিক অবস্থা দেখে হাসপাতালে ভর্তি নেবে নাকি বাসায় থাকবে সে সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু এটি যদি আমরা রোগীর ওপর ছেড়ে দিই, তাহলে অবস্থার অবনতি হবে। রোগী তার প্রকৃত অবস্থা বুঝতে পারবে না। যেমন, ডায়রিয়া ডেঙ্গুর একটি লক্ষণ। যা রোগীদের একটা বড় অংশই জানে না। কিন্তু সে ডায়রিয়া হয়ে শকে চলে যেতে পারে। তাই এই দ্বৈত অবস্থা তৈরি না করে ডেঙ্গু হলেই রোগীকে হাসপাতালে সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। ডিএনসিসি হাসপাতালের মতো ফিল্ড হাসপাতাল চালু করা হোক। প্রয়োজনে চিকিৎসক-নার্স বাড়িয়ে দেওয়া হোক, যেন তারা সমানভাবে প্রত্যেককে গুরুত্ব দিতে পারেন।’

তবে এ বিষয়ে ভিন্নমত জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এমিরেটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লহ। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে ভর্তিসংক্রান্ত এই নীতিকে পরস্পরবিরোধী বলা যাবে না। কারণ হাসপাতালেরও একটা ক্যাপাসিটি রয়েছে। যা ইতোমধ্যে প্রায় পুরো হয়ে গেছে। জ্বর হলেই হাসপতালে ভর্তির প্রয়োজন নেই। যাদের জ্বর রয়েছে তাদের প্রথম দায়িত্ব ডেঙ্গু পরীক্ষা করা। ডেঙ্গু শনাক্ত হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বাসায় অবস্থান করে বেশি প্রচুর পানি ও তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খাবেন। ফার্মেসি থেকে নিজের ইচ্ছামতো অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া থেকে বিরত থাকবেন। তাহলেই অনেক জটিলতা কমে যাবে। গাইডলাইনে কিছু বিপদচিহ্ন উল্লেখ করা হয়েছে। যেগুলো দেখা দিলে হাসপাতালে যেতে হবে। মানুষকে এ বিষয়ে বেশি বেশি জানানোর উদ্যোগ নিতে হবে।’

এত মৃত্যু যে কারণে
অধ্যাপক এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, যারা এবার আক্রান্ত বা মারা যাচ্ছেন তারা আগে যেকোনো সময় ডেঙ্গুতে ভোগেছে। প্রথমবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে অবস্থা সিভিয়ার হয় না। জ্বর বা সাধারণ কিছু সমস্যায় ভোগে তারা সুস্থ হয়ে যান। কিন্তু দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থবার হলে রোগীর অবস্থা সিভিয়ার হয়। এবার তাইই ঘটছে। ফলে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিরা, যাদের কোমরবিডিটি রয়েছে।    
    
মৃত্যুর সাথে হাসপাতালে যাওয়ার সম্পর্কের বিষয়ে তিনি বলেন, এখানে হাসপাতাল বিষয় না। আক্রান্ত বেশি হলে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়বে। এটাই স্বাভাবিক। তাই মানুষ যেন আক্রান্ত না হয়, সে দিকে মনোযোগ দিতে হবে। ডেঙ্গুতে শত্রু আমাদের পরিচিত। তাই এডিস মশা যেন না কামড়ায়, মশার বংশবিস্তার যেন না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। যেহেতু এটির জন্ম ঘরেই বেশি হয়, তাই সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে। তিন দিনের বেশি পানি যেন না জমে তা খেয়াল রাখতে হবে। আর মশা যেন কামড়াতে না পারে, সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রশাসনকেও মশানিধনে তৎপর হতে হবে। নয়ত যত আক্রান্ত বাড়বে, মৃত্যুও বাড়তে থাকবে।

মৃত্যু রোধ ওয়ান স্টপ সার্ভিসের দাবি জানিয়ে অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগ ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনায় নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। তবু আমরা মৃত্যু দেখতে পাচ্ছি। ডেঙ্গুতে নতুন নতুন কিছু কন্ডিশন দেখা যাচ্ছে। আক্রান্ত হওয়ার দুই থেকে তিন দিনের মধ্যেই রোগীরা মারাত্মক হয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে বর্তমান বাস্তবতা অনুযায়ী গাইডলাইন আপডেট করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যারা ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্ট করবে তাদের এই গাইডলাইন অনুযায়ী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত। একটি কমিটি করে দেওয়া যায়, যারা হাসপাতালের ম্যানেজমেন্ট রিভিভ করবে। বিশেষ করে ওয়ান স্টপ সার্ভিস করা প্রয়োজন। যেখানে সাধারণ থেকে জটিল সকল ডেঙ্গু রোগীকে সেবা দেওয়া হবে।

এমএইচ/জেবি