মোস্তফা ইমরুল কায়েস
১০ জুলাই ২০২৩, ০৯:০৯ পিএম
ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিতে রাজবাড়ী থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে এসেছেন এসএসসি পরীক্ষার্থী জিসান। এ নিয়ে দ্বিতীয় দফায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলেন তিনি। প্রাথমিক চিকিৎসা জেলা শহরে নিলেও ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার পর আর দেরি করেননি। দ্রুত ছুটে এসেছেন ঢামেক হাসপাতালে। শুক্রবার থেকে ঢামেকের মেডিসিন বিভাগে আছেন তিনি। তার ভাই আবু সায়েম বলেন, তার প্লাটিলেট কমে যাচ্ছিল। তাই আমরা ঝুঁকি না নিয়ে দ্রুত ঢাকায় নিয়ে আসলাম।
জিসানের মতোই বরিশাল থেকে ঢামেকে ছুটে এসেছেন রিপন। তিনি বলেন, সেখানে কয়েকদিন ভর্তি ছিলাম। কিন্তু সেখানে নিরাপদ মনে হয়নি। তাই ঢাকায় চলে এসেছি।
ঢামেকে আসা ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, জিসান ও রিপনের মতো অনেকেই জেলা সদরে ভালো চিকিৎসা না পাওয়ার শঙ্কা থেকে ঢাকায় ছুটে আসছেন।
বছর খানেক আগেও ঢাকার বাইরে তেমন একটা ডেঙ্গু রোগীর দেখা মিলতো না। কিন্তু এখন সেই চিত্র পাল্টে গেছে। ঢাকার বাইরেও প্রতিদিন অনেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন। দেশের ৬০ জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর তথ্য মিলেছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তার মতে, ঢাকায় ৬০ শতাংশ আর জেলা শহরে ৪০ শতাংশ মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী রয়েছে।
স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য বলছে, গত চব্বিশ ঘণ্টায় দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত নতুন রোগীর সংখ্যা ৮৩৬ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ৫১৬ জন এবং ঢাকার বাইরে ৩২০ জন। আর সারাদেশে এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন ২ হাজার ৭৫০ জন।
এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা বিভাগে ৩২ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ১১ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১১৭ জন, খুলনা বিভাগে ৩৩ জন, রাজশাহী বিভাগে ৯ জন, রংপুর বিভাগে ১০ জন, বরিশাল বিভাগে ৯৮ জন ও সিলেট বিভাগে ১০ জন নতুন রোগী সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন।
ঢাকায় থাকা ৫৩টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ডেঙ্গুর চিকিৎসা দিয়ে থাকে। তবে ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট, রংপুর ও যশোরে ডেঙ্গু রোগী ভর্তির তথ্য পাওয়া গেছে।
কিন্তু ঢাকার বাইরের বেশিরভাগ ডেঙ্গু রোগী থেকে ঢাকায় চিকিৎসা নিতে আসছেন। ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলার হাসপাতালগুলোর সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চলতি মাসে ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হওয়া বেশিরভাগ রোগীই ঢাকার বাসিন্দা বা ঢাকায় চাকরি করেন। তাদের কেউ গ্রামে বেড়াতে গেছেন। আবার কেউ ঢাকায় বেড়াতে এসে আক্রান্ত হয়ে জেলায় গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে জেলা হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নেওয়া ৪০ শতাংশ রোগী সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা এবং তারা আগে কখনো ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হননি বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রতিটি সদর হাসপাতাল ছাড়াও সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছে।
ঢামেকে চিকিৎসা নিতে এসেছেন ঢাকার নিকটস্থ উপজেলা দোহারের প্রবাসী জসিম ও ছাইফুল ইসলাম। জসিম জানান, তিনি গত সোমবার সৌদি থেকে ঢাকায় ফিরেছেন। ফেরার পরদিন থেকে জ্বরে আক্রান্ত। পরে স্থানীয় একটি হাসপাতালে পরীক্ষার পর জানতে পারেন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। আর ছাইফুল ইসলাম ঢাকার বাড্ডায় চাকরি করেন।
ডেঙ্গু মোকাবেলায় প্রস্তুতি নিয়ে সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন
ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. এনামুলে হক ঢাকা মেইলকে বলেন, এখন পর্যন্ত কাউকে ঢাকায় রেফার করতে হয়নি। মোট ৪৫ জন ভর্তি হয়েছে। সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে।
লক্ষীপুরের জেলা সিভিল সার্জন ডা. আহমেদ করিব বলেন, আমাদের কাছে ডেঙ্গুর সিরিয়াস রোগী এখনও আসেনি। যারা আসছেন তারা চিকিৎসা নেয়ার পর সুস্থ হয়ে যাচ্ছেন। তিনি জানান, তার হাসপাতালে (জানুয়ারি থেকে চলতি মাস পর্যন্ত ৯৭ জন) যারা ভর্তি হয়েছেন তাদের অধিকাংশই স্থানীয় বাসিন্দা।
চাঁদপুর সদর হাসপাতালের সুপারেনডেন্ট ডা. একেএম মাহবুবুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, জুন মাসে ছিল ৬৮ জন। আজ পর্যন্ত ৪০ জন। আমাদের পর্যাপ্ত কিট রয়েছে। রক্ত পরীক্ষার জন্য যা দরকার তাও আছে। তবে অনেক রোগী ঝুঁকি নিচ্ছে না, তারা নিজ উদ্যোগে ঢাকায় চলে যাচ্ছে। তিনি জানান, তার হাসপাতালে ৮০ শতাংশ রোগীই ঢাকা থেকে আসা কর্মজীবী মানুষ। ৯৫ শতাংশ পুরুষ, বাকিরা নারী ও শিশু।
মাগুরা জেলার ২৫০ শয্যা হাসপাতালের পরিচালক ডা. মহসিন উদ্দিন ফকির বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত ২৪ জনকে সেবা দিয়েছি। রোববার বিকেল পর্যন্ত ৩ জন ভর্তি হয়েছে। ডেঙ্গু আক্রান্তদের জন্য আমরা আলাদা ইউনিট রেডি করে রেখেছি। রোগীর সংখ্যা বাড়লে সেটি ব্যবহার করা হবে।
ফরিদপুর জেলার সিভিল সার্জন ডা. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বর্তমান আমার এখানে ৩৯ জন ভর্তি আছে। এখন পর্যন্ত কাউকে রেফার করতে হয়নি। পরীক্ষার জন্য কিট দুই সপ্তাহের আছে।
সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত চট্টগ্রাম জেলায়। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ইলিয়াস চৌধুরীকে কল করা হলে তিনি এ বিষয়ে মোবাইলে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে, চট্টগ্রাম জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় সরকারি ও প্রাইভেট হাসপাতাল মিলে ৩৭ জন ভর্তি রয়েছে। সবমিলে এই বিভাগে ১১৭ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাপসাতালের পরিচালক ডা. দিলরুবা ইয়াসমিন লিজা বলেন, এখান থেকে কোনো রোগীকে রেফার করা হয়নি। জানুয়ারি থেকে তার হাসপাতালে ৯৯ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। এখন ২৮ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন।
ঢাকার বাইরে থেকে ঢামেক হাসপাতালে আসছে রোগী
ঢাকার বাইরে আক্রান্ত অনেকে ঝুঁকি না দিয়ে দ্রুত ঢাকায় চলে আসছেন। তাদের অধিকাংশই ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। নরসিংদীর বেলাবো থেকে ঢামেক হাসপাতালে শুক্রবার এসেছেন রহিম সরকার। তিনি সেই এলাকায় একটি টেক্সাটাইল কোম্পানিতে চাকরি করেন। ছয়দিন ধরে জ্বর ছিল তার। চিকিৎসক জ্বরের ওষুধ দিলেও সারেনি। পরে তিনবার পরীক্ষা করান তিনি। জানতে পারেন তিনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। তার দাঁতের মাড়ি দিয়ে রক্ত বের হতে শুরু করে। পায়খানা কালো ছিল। এছাড়া চোখ-মুখ জ্বালা-পোড়া করত।
লক্ষীপুর সদর থেকে ঢামেকে এসেছেন রাজমিস্ত্রি সিরাজ উদ্দিন। তিনি সেখানেই থাকেন। টানা জ্বর দেখে ডেঙ্গু টেস্ট করান। ডেঙ্গু নিশ্চিত হওয়ার পরপরই তিনি ঢাকায় চলে আসেন।
এমআইকে