মাহফুজ উল্লাহ হিমু
৩০ জুন ২০২৩, ০৯:০২ এএম
দেশের অন্যতম ব্যয়বহুল স্বাস্থ্যসেবা হলো হৃদরোগের চিকিৎসা। সরকারি-বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই এই চিকিৎসা নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। এমনকি মধ্যবিত্তেরও নাগালের বাইরে। ফলে হৃদরোগের চিকিৎসা বলতে গেলে শুধু এলিট শ্রেণির অধিকারে পরিণত হয়েছে। অথচ প্রধান ৫টি মৌলিক অধিকারের একটি হচ্ছে চিকিৎসা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ৪০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় হৃদরোগে। অপরদিকে গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রগতির জন্য জ্ঞানের (প্রজ্ঞা) তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ২ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ হৃদরোগে মারা যায়। সরকারি ও অন্যান্য বেসরকারি সংস্থার তথ্যে মৃত্যুর সংখ্যায় ফারাক থাকলেও এটি বলা যায় দেশের মোট জনসংখ্যার একটা বড় অংশ হৃদরোগে আক্রান্ত। হৃদরোগের চিকিৎসায় সবচেয়ে বেশি আলোচিত শব্দ হার্টে রিং বা স্টেন্ট বসানো। হার্টে ব্লকের সংখ্যার উপর ভিত্তি করে এক বা একাধিক রিং বসানো হয়। অতিপ্রয়োজনীয় এই জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম বাংলাদেশে উৎপাদিত হয় না, আমদানি করতে হয়। আবার দেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় রিং বিক্রয় করা হয় না। ফলে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের যেখানেই রিং বসানো হোক না কেন রোগীদের গুনতে হয় বড় অংকের অর্থ। পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে আনুষাঙ্গিক খরচ অনেক বেশি হওয়ায় হৃদরোগের চিকিৎসা শুধু ধনীদের চিকিৎসায় পরিণত হয়েছে।
রিংয়ের দামের লাগাম টেনে ধরতে ২০১৭ সালে সর্বনিম্ন মূল্য ২৫ হাজার এবং সর্বোচ্চ মূল্য ৫০ হাজার টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছিল ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। তবে এর বাস্তবায়ন হয়নি। একটি রিংয়ের জন্য রোগীকে লক্ষাধিক টাকা পর্যন্ত গুনতে হয়। সর্বশেষ বিশ্বমন্দা ও এলসি সংকটের কথা বলে যে রিংয়ের দাম ছিল ৭২ হাজার টাকা, সেটি এখন ৮২ হাজার টাকা করা হয়েছে। একইভাবে ১ লাখ ৮ হাজার টাকার রিং এখন ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা এবং দেড় লাখ টাকার রিং এখন ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা।
রিংয়ের দাম কমানো ও জনগণের সুবিধা
গত ২৫ জুন হৃদরোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত তিন ধরনের স্টেন্টের দাম ১০০ ডালারের বেশি করে কমানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের দুটি প্রতিষ্ঠানের তৈরি দুটি স্টেন্টের নতুন দাম আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে এবং অপরটির দাম পরে কার্যকর হবে বলে জানিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর।
ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ জানান, যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাবোট ল্যাবরেটরিজ, বস্টন সায়েন্টিফিক— এই দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে তাদের। এর আগে প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থানীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছে প্রতিষ্ঠানটি। সেখানে হার্টের চিকিৎসায় ব্যবহৃত স্টেন্টের দাম কমানোর অনুরোধ করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে দাম কমাতে রাজি হয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে অ্যাবোটের তৈরি স্টেন্ট জায়েন্স প্রাইমের ভিত্তিমূল্য ৫৬১ ডলার থেকে কমিয়ে ৪২৫ ডলার, এক্সপেডিশনের বর্তমান ভিত্তিমূল্য ৮৩০ ডলার থেকে কমিয়ে ৬০০ ডলার হবে। আর বস্টন সায়েন্টিফিকের প্রোমাস প্রাইমার নামে একটি স্টেন্টের ভিত্তিমূল্য ৫৭০ ডলার থেকে কমে ৪৭০ ডলার হবে।
ইতিবাচক সিদ্ধান্ত তবে স্থায়ীভাবে কার্যকর নয়
ঔষুধ প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তকে অত্যন্ত ইতিবাচক বলছে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও সার্জনরা। তাদের মতে, সামগ্রিক বিবেচনায় এটি অত্যন্ত ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। রিংয়ের খরচ কমলে রোগীদের ওপর আর্থিক চাপ কমবে। তবে রিং বসানোর খরচে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে পার্থক্য কমানো না গেলে এই সিদ্ধান্ত কতটা উপকারে আসবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
এছাড়া দেশেই রিং উৎপাদনের সক্ষমতা ও ইচ্ছুক প্রতিষ্ঠান রয়েছে দাবি করে সংশ্লিষ্টদের সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। দাম কমানো কোনো কার্যকর সমাধান নয় জানিয়ে রিং উৎপাদন করা গেলে রোগীরা বেশি উপকৃত হবে বলে মনে করেন চিকিৎসকরা। এক্ষেত্রে অদৃশ্য বাধা দূর করতে সরকারকে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
এ বিষয়ে ঢাকা মেইলের সঙ্গে কথা বলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজি বিভাগের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কার্ডিওভাস্কুলার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সভাপতি এবং স্টেন্ট মূল্য নির্ধারণ কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. এসএম মোস্তফা জামান। তিনি বলেন, আমরা দীর্ঘদিন রিংয়ের দাম কমানোর দাবি করে আসছি। আমরা এটিকে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনতে কাজ করছি। গত বৈঠকে আমরা কোম্পানিগুলোর সাথে আলোচনায় দেশের মানুষের আর্থিক পরিস্থিতি তুলে ধরে দাম কমানোর বিষয়ে কথা বলেছি। কারণ ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনতে পারলে মানুষ সহজেই সেবা নিতে পারবে। তারা এতে রাজি হয়েছে। এর আগে তারা ডলার সংকট ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দাম বাড়ানোর দাবি জানিয়েছিল। তখন এক দফা দাম বাড়ানো হয়। এখন এটি আবার কমিয়ে আনা হয়েছে।
দাম কমানো কোনো কার্যকর সমাধান নয় জানিয়ে রিং উৎপাদন করা গেলে রোগীরা বেশি উপকৃত হবে বলে মনে করেন চিকিৎসকরা। এক্ষেত্রে অদৃশ্য বাধা দূর করতে সরকারকে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
দেশেই রিং উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তিনি বলেন, রিংয়ের দাম কমালে দেশের মানুষ উপকৃত হবে। তবে দেশেই রিং উৎপাদন করা সম্ভব হলে তা আরও কার্যকর হবে। বাংলাদেশে আমরা উচ্চমানের ওষুধ তৈরি করতে পারছি। রিংও তৈরি করতে পারব। দেশে রিং উৎপাদন করা গেলে প্রতিটি রিংয়ের দাম পড়বে ১৫-২০ হাজার টাকা। এ বিষয়ে আমরা প্রধানমন্ত্রীরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। এখন শুধু ধনীরা চিকিৎসা নিতে পারছে। দাম কমলে সব পর্যায়ের মানুষ এই সেবা নিতে পারবে। আমাদের দেশে অনেক শিল্পপতি ও প্রতিষ্ঠান আছে যারা রিং উৎপাদনে ইচ্ছুক। বিষয়টি সহজ করে দিলে দেশের মানুষ অনেক উপকৃত হবে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ঢাকা মেইলকে বলেন, রিংয়ের দাম কমানো মুখ্য বিষয় না। রিংয়ের দামের চেয়ে আনুসঙ্গিক খরচই রিং পরানোর প্রধান অন্তরায়। হৃদরোগের চিকিৎসায় একটি অরাজক পরিস্থিতি চলছে। রিং পরাতে সরকারি হাসপাতালে যে খরচ হয় তার চেয়ে বহুগুণ খরচ হয় বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে। সরকারি হাসপাতাল যেখানে রিং বসাতে ১৫-২০ হাজার টাকা নিচ্ছে, সেখানে বেসরকারি হাসপাতাল দেড় থেকে দুই লাখ টাকা নিচ্ছে। এমনকি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও খরচের তারতম্য রয়েছে। আর বেসরকারি হাসপাতালগুলো প্যাকেজের নামে রোগীদের কাছ থেকে অনেক বেশি টাকা আদায় করছে। অনেক প্রতিষ্ঠান ইচ্ছেমতো খরচ নির্ধারণ করছে। রিংয়ের পাশাপাশি অন্য খরচগুলোকেও নিয়মের মধ্যে আনা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের নজরদারি বাড়াতে হবে।
এমএইচ/এএস