রেজওয়ান সিদ্দিকী অর্ণ
২২ ডিসেম্বর ২০২২, ০১:০৫ পিএম
ঢালিউডের জন্য আশীর্বাদ বয়ে এনেছে ২০২২ সাল। খাদের কিনারায় পড়ে থাকা ইন্ডাস্ট্রিকে খানিকটা টেনে তোলা সম্ভব হয়েছে এই সময়ে। যদিও প্রথম তিন মাসে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাগুলো দেখে আন্দাজ করা যাচ্ছিল না যে বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য দারুণ একটা সময় অপেক্ষা করছে।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর এখন পর্যন্ত দেশের প্রেক্ষাগৃহে ৪৭টি ছবি মুক্তি পেয়েছে। ২৩ ও ৩০ ডিসেম্বর মুক্তি পাবে আরও চার ছবি। সব মিলিয়ে সিনেমার সংখ্যা ৫১টি। বাণিজ্যিক ছবির পাশাপাশি গল্পনির্ভর ছবিও আছে এর মধ্যে।
করোনার ধাক্কা সামলে ওঠার পর প্রযোজকরা বেশি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সিনেমা মুক্তি দিতে চাইছিলেন না। তারা অপেক্ষা করছিলেন রোজার ঈদের। ধারণা করা হচ্ছিল, এই উৎসব কেন্দ্র করে হলবিমুখ দর্শক হলমুখী হবেন। অতীতেও দেখা গেছে এমন চিত্র। অন্যান্য সময়ের তুলনায় ঈদেই প্রেক্ষাগৃহে দর্শকের উপস্থিতি বেশি থাকে।
জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত নয়টি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। বছরের প্রথম সিনেমা হিসেবে মুক্তি পায় এইচ আর হাবিবের ছিটমহল। কয়েক বছর গলার কাঁটা হয়ে থাকা সিনেমাটি মাত্র পাঁচটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। স্বাভাবিকভাবেই এটির প্রতি দর্শক আগ্রহ দেখাননি।
দেবাশীষ বিশ্বাসের শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ-২ সিনেমার মাধ্যমে কিছু দর্শক হলে ফেরা শুরু করেন। পরিচালকের দাবি, সিনেমাটি ব্যবসায়িকভাবে সফল হয়েছে। তবে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল মাল্টিমিডিয়ার সমন্বয়ক সুজন আহমেদ জানালেন, করোনা পরিস্থিতির মধ্যে তুলনামূলকভাবে ভালো চলেছে এই ছবি। ব্যবসায়িক সফলতার কথায় জোর দিলেন না।
সদ্য ডুবে যাওয়া প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান শাপলা মিডিয়া মাফিয়া-১ নামের একটি ওয়েব সিরিজকে জোড়া লাগিয়ে সিনেমা হিসেবে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দেয়। কিন্তু মুখ থুবড়ে পড়ে শাহিন সুমন পরিচালিত এই ছবি। পরে এটি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে প্রকাশ করা হয়।
মোশাররফ করিম-পরীমণি ও রোশানকে নিয়ে ‘মুখোশ’ সিনেমা বানিয়েছিলেন ইফতেখার শুভ। বড় তারকা সামনে রেখে প্রচারণায় কমতি রাখেননি। কিন্তু সিনেপ্লেক্সের কিছু দর্শক সিনেমাটি দেখলেও সিঙ্গেল স্ক্রিনে পাত্তা পায়নি ছবিটি। এমন ব্যর্থতায় ভবিষ্যতে আর কোনো সিনেমা নির্মাণ করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পরিচালক। যদিও পরে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন।
পরীমণির আরেক ছবি গুণিন নিয়েও আলোচনা হয়েছিল। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকি প্রযোজিত সিনেমাটির তুমুল প্রচারণা চালানো হয়। প্রথম সপ্তাহে ২০ প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়া এই ছবি প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়। পরে চরকিতে প্রকাশ করে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া হয়।
বিকল্পধারার শিমু নামের একটি সিনেমাও মুক্তি পেয়েছিল গুণিনর সাথে। উৎসবকেন্দ্রিক সিনেমাটি এলিট শ্রেণির দর্শকের কাছে প্রশংসিত হয়।
এ ছাড়াও তোর মাঝেই আমার প্রেম ও লকডাউন সিনেমা দুটি মুক্তি পায়। এই দুটি সিনেমা নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য হয়নি।
রোজার ঈদে একাধিক সিনেমা মুক্তির ঘোষণা দিলেও ৪টি সিনেমা মুক্তি পায়। সেগুলো হলো—বিদ্রোহী, গলুই, বড্ড ভালোবাসি ও শান। এর মধ্যে একটি সিনেমাও বিনিয়োগ তুলে আনতে পারেনি। তবে তুলনামূলকভাবে গলুই সিনেমাটি ভালো চলেছে। প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম, টিভি স্বত্ব, ডিজিটাল স্বত্ব থেকে বিনিয়োগ উঠে এসেছে বলে জানিয়েছেন ছবির অন্যতম প্রযোজক খোরশেদ আলম খসরু।
ঈদুল আজহায় মুক্তি পাওয়া সিনেমাগুলো বছরের হিসাব-নিকাশ পাল্টে দেয়। ধুঁকতে থাকা ইন্ডাস্ট্রি যেন প্রাণ ফিরে পায় এ সময়ে। সাইকো, পরাণ ও দিন: দ্য ডে—একসঙ্গে এই তিনটি ছবি মুক্তি পায়। এর মধ্যে পরাণ ছাড়া বাকি ছবি দুটি কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। যদিও নানাভাবে ছবি দুটি হাইপ তোলার চেষ্টা করে। বিশেষ করে দিন: দ্য ডে সিনেমা নিয়ে ছবির প্রযোজক ও নায়ক অনন্ত জলিল প্রোপাগান্ডা ছড়িয়েছিলেন। কিন্তু যারা একবার সিনেমাটি দেখেছেন তারা দ্বিতীয়বার ছবির পোস্টারের দিকেও তাকাননি! আর মুক্তির কয়েকদিন পরই পিছিয়ে পড়ে সাইকো।
তবে পরাণ রীতিমতো হইচই ফেলে দেয়। সত্য ঘটনার আলোকে নির্মিত সিনেমাটি মাল্টিপ্লেক্সে বেশি চলেছে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরের সিঙ্গেল স্ক্রিনগুলোতেও ভালো দর্শক টেনেছে। সিনেমার বাজেট কম হওয়ায় লগ্নিকৃত টাকা ফেরত এসেছে বলে জানিয়েছেন ছবির অন্যতম প্রযোজক ইয়াসির আরাফাত।
দুই ঈদের মধ্যে মুক্তি পাওয়া তালাশ, অমানুষ, বিক্ষোভ ও আগামীকাল দেখতে গাঁটের টাকা খরচ করেনি দর্শক। ফলে সিনেমাগুলো নাম লেখায় ফ্লপের তালিকায়।
বাংলাদেশে বিষয়ভিত্তিক ছবির বাজার উল্লেখ করার মতো ভালো ছিল না। তবে হাওয়া সেই মিথ ভেঙেছে। সফল হয়েছে ব্যবসায়িকভাবে। ছবির নির্বাহী প্রযোজক অজয় কুণ্ডু তেমনটাই জানিয়েছেন।
তারকাবহুল অপারেশন সুন্দরবন সিনেমাটি সাড়া জাগাতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছে। প্রথম সপ্তাহে কিছু দর্শক সিনেমা হলে আসলেও ধীরে ধীরে তা কমতে থাকে। একই সময়ে মুক্তি পাওয়া বিউটি সার্কাস অল্প সময়ে নিভে গেছে। তবে এলিট দর্শকের কাছে বেশ প্রশংসা পেয়েছে এই ছবি।
এর বাইরে প্রচারণার কৌশলে আলোচিত হয়েছে দামাল সিনেমা। কিন্তু ব্যবসায়িকভাবে সফল বলা যাবে না। তবে কম বাজেটের হওয়ায় ইমপ্রেস টেলিফিল্মের এই ছবি টেলিভিশন প্রিমিয়ার থেকে লগ্নিকৃত টাকা তুলে আনার সম্ভাবনা রয়েছে।
গত দুই বছরের তুলনায় ২০২২ সালে সিনেমা মুক্তির সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। ২০২১ সালে মুক্তি পেয়েছিল ৩২টি সিনেমা। করোনার বছর ২০২০ সালে মুক্তি পায় মাত্র ১২টি ছবি।
চলতি বছর সিনেমার সংখ্যা বাড়লেও ব্যবসায়িকভাবে সফল সিনেমার সংখ্যা হাতে গোনা। তবে করোনার ধকল কাটিয়ে এ বছর দর্শক যেভাবে হলমুখী হয়েছেন, তাতে অন্ধকার ফুঁড়ে আলোর আভাস দিচ্ছে।
ঢালিউডে বক্স অফিস না থাকায় ব্যবসার সঠিক তথ্য জানা সম্ভব হয় না। যার ফলে সৃষ্টি হয় ধোঁয়াশা। তারপরও চলচ্চিত্রের বিভিন্ন মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও ঢাকা মেইলের পর্যালোচনায় বছরের সেরা তিন ছবি হলো—হাওয়া, পরাণ ও গলুই।
এমন কিছু সিনেমা আছে যেগুলো হয়তো ব্যবসায়িকভাবে সফল হয় না, কিন্তু দর্শক দেখে মুগ্ধ হন। করেন প্রশংসা। এ বছরও তেমন কয়েকটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। সেগুলোর মধ্যে সেরা তিন সিনেমা হলো— কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া, রোহিঙ্গা ও শিমু। তবে এই তালিকায় বিশেষ বিবেচনায় বিউটি সার্কাস সিনেমাটিকেও রাখা যায়।
আরএসও/জেএম