রেজওয়ান সিদ্দিকী অর্ণ
০১ মার্চ ২০২২, ০৩:১৯ পিএম
বসন্তকন্যা লগ্নজিতা চক্রবর্তী। ঋতুরাজ বসন্ত আসে তার গানে ভর করে। শিশুসুলভ কণ্ঠ, অথচ তিনি কুহকময়ী। কণ্ঠতেই জাদু। সেই জাদুকরি সুরে মিলেমিশে একাকার গঙ্গা-পদ্মা। যদিও কখনও ভাবেননি, তার গান এভাবে ভূ-খণ্ড ছাড়িয়ে যাবে। বাংলা ভাষার মানুষের ঘরে ঘরে বাজবে। বসন্তের এক সকালে ঢাকা মেইলের সঙ্গে কথা হয় লগ্নজিতার। কথায় কথায় গান, ব্যক্তিজীবন আর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে মনের আগল খুলেছেন তিনি। পদ্মাপাড়ের শ্রোতারাও আপনার সুরের মূর্ছনায় মোহিত। সুর যে কোনো ভূ-খন্ডে আটকে থাকে না এটা প্রমাণিত সবসময়। তবুও এই যে, আপনার আন্তর্জাতিক পরিচিতি এটা ভাবতে কেমন লাগে?
এটা তো খুব ভালো লাগার বিষয়। ভাবতেও ভালো লাগে। বাংলাদেশের শ্রোতারা যে আমার গান পছন্দ করেন সেটা আমি ফেসবুক-টুইটারে প্রমাণ পাই। আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
আপনার শুরুর কথা জানতে চাই। যখন থেকে লগ্নজিতার কণ্ঠশিল্পী হয়ে ওঠা…
আমার আসলে গায়িকা হওয়ার কোনো পরিকল্পনাই ছিল না। মা-বাবার ইচ্ছা ছিল। ছোটবেলা থেকে আমি গানটা গাইতে পারতাম। তিন-সাড়ে তিন বছর থেকে গানের অনুশীলন করতাম। বাবার খুব কঠোর অনুশীলন ছিল। নিজ থেকে রেওয়াজ শুরু করেছি কয়েক বছর হলো। এর আগে পুরোটাই বাবার অনুশাসনে করা।
পড়াশোনা নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতাম সবসময়। অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ার গড়ার ইচ্ছা ছিল। পড়াশোনা শেষ করে কিছুদিন চাকরিও করেছি। দেশের বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তারপর মনে হলো, দেশে থেকে কিছু করার। এমন সময় হঠাৎ একদিন ‘চতুষ্কোণ’ সিনেমায় গান গাওয়ার প্রস্তাব আসে। সেই থেকে শুরু।
আপনার কণ্ঠ অন্য সবার মতো না। কেউ কেউ বলেন, শিশুসুলভ। দূর থেকে শুনলে যে কেউ বলে দিতে পারেন— এটা লগ্নজিতার গান। কণ্ঠের এই সক্রিয় ‘ব্র্যান্ডিং’ উপভোগ করেন?
উপভোগের লজিক্যালি কোনো কারণ নেই। আমার কণ্ঠ পুরোপুরি ঈশ্বরপ্রদত্ত। এতে আমার কোনো হাত নেই। আমি শুধু রেওয়াজের মাধ্যমে কণ্ঠকে আরও শ্রুতিমধুর করি। তবে আমি খুব লাকি যে, আমার কণ্ঠ ভিন্নরকম।
সেই ২০১৪ সালে গাওয়া ‘বসন্ত এসে গেছে’ গানটি আপনার জীবনে বসন্তের আমেজ এনেছে। এখন ২০২২ সালে এসে আপনার গানের সংখ্যা তুলনামূলক কম। কেন?
একটু আগে আপনি বলছিলেন, আমার কণ্ঠ অন্যদের থেকে ব্যতিক্রম। গানের সংখ্যা কম হওয়ার পেছনে এটি বড় কারণ। সব গানে আমার কণ্ঠ মানায় না। সেজন্য গান পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। যেহেতু সব গান আমার গলায় মানায় না, তাই আমাকে দিয়ে বাছাইকৃত কিছু গান করানো হয়। এই গান গাওয়া নিয়ে আমার খারাপ অভিজ্ঞতাও আছে।
কেমন সেটা?
দেখা গেল কোনো একটি সিনেমার গান আমাকে দিয়ে রেকর্ড করানো হলো। পরে অন্য কাউকে দিয়ে সেই গান গাওয়ানো হয়। খুব বেশি যে এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে তা নয়। ‘মেঘনাদবধ রহস্য’ ছবিতে ‘তোমার এখনও কি’ গানটি রেকর্ডিং করিয়েছিলাম প্রথমে। পরে সেটি নিকিতা গান্ধীকে দিয়ে গাওয়ানো হয়। তবে বিশ্বাস করুন, এতে আমি একটুও কষ্ট পাইনি। বরং আমার থেকে নিকিতা অনেক ভালো গেয়েছেন। ওর গলায় গানটা ভালো মানিয়েছে।
গানের সংখ্যা কম হলেও প্রতি বছর কোনো না কোনো গান হিট হয় আপনার। এটা খেয়াল করেছেন?
প্রতি বছর কেন আমার অন্তত একটি গান হিট হয়— সেটি আমার কাছে রহস্য মনে হয়। ভাগ্যদেবী সহায় থাকেন হয়তবা। তবে আমি প্রতিটি গান খুব যত্ন নিয়ে গাওয়ার চেষ্টা করি।
‘প্রেমে পড়া বারণ’— আপনার জনপ্রিয় একটি গান। কারণে-অকারণে প্রেমে পড়তে মানা করে দিয়েছেন এই গানে। অথচ আপনি নিজেই প্রেম করে বিয়ে করেছেন…
(হাসি) এটা তো আসলে গানের কথা। রণজয় ভট্টাচার্য দারুণ লিরিক্স লিখেছেন। ‘সোয়েটার’ সিনেমায় ব্যবহৃত হয়েছে গানটি। খুব জনপ্রিয় গান এটি। ২০১৯ সালের সিনেমা এটি। আমি প্রেমে পড়েছি তারও আগে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় সাত্যকির সঙ্গে আমার প্রেম হয়। আমরা দুজনেই গান ভালোবাসি। এই গানের নেশাই আমাদের কাছে এনেছে। প্রায় আট বছর প্রেমের পর ২০১৬ সালের ২১ জানুয়ারি বিয়ে করি। আমরা আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে সৎ ছিলাম। এখনও আছি। সামনেও থাকব।
শুনেছি, বিদেশে কনসার্ট করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সত্যি?
ঠিকই শুনেছেন। তবে একদম যে করব না, তা নয়। আপাতত করতে চাই না। ২০১৯ সালের পূজায় শেষবার বিদেশে অনুষ্ঠান করেছি। দেশের বাইরে স্টেজ-শো করার ব্যাপারেও কিছু খারাপ অভিজ্ঞতা আছে। যদিও বিষয়টি নিয়ে কিছু বলতে চাই না।
কিন্তু বাংলাদেশে কনসার্ট করার জন্য মুখিয়ে আছেন…
একদম তাই। বাংলাদেশ আমার কাছে বিদেশ নয়। পশ্চিমবঙ্গ আমার কাছে যেমন, বাংলাদেশও ঠিক তেমন। কিন্তু দেশটির প্রতি আমার খুব অভিমান জমে আছে। এখন অবধি আমি দেশটিতে একটি কনসার্টও করতে পারিনি। অথচ আমার বন্ধু-বান্ধব, সিনিয়র-জুনিয়ররা একবার হলেও বাংলাদেশে গান গেয়েছেন। এটা নিয়ে এক প্রকার দুঃখ আছে। আমি মন থেকে চাই, বাংলাদেশে স্টেজ-শো করতে।
কলকাতার অনেক কণ্ঠশিল্পী মুম্বাইতে ক্যারিয়ার প্রতিষ্ঠা করেছেন। আপনি কি তাদের পথ অনুসরণ করতে চান?
মুম্বাইতে ২০১৬ থেকে করোনা সংক্রমণের আগ পর্যন্ত ছিলাম। আমার বর চাকরিসূত্রে তামিলনাড়ুতে থাকেন। সেজন্য আপাতত মুম্বাই ছেড়েছি। জানি না ভবিষ্যতে সেখানে ফেরার সুযোগ হবে কি না। যদি সুযোগ হয় তাহলে আবারও মুম্বাইয়ে ক্যারিয়ার কন্টিনিউ করব। যদিও এখনও মুম্বাই থেকে টুকটাক কাজ আসে। সেগুলো আমার হোম স্টুডিওতে করে পাঠিয়ে দেই।
বলিউডে কেন প্রতিষ্ঠা পেতে চান?
বলিউডেই প্রতিষ্ঠা পেতে হবে আমাকে— তেমনটা নয়। বলিউড ছাড়াও মুম্বাইতে নানারকম কাজ হয়। আমি ন্যাশনালি কাজ করতে চাই। সব ভাষার শ্রোতার জন্য গান গাওয়ার ইচ্ছা। বাংলার মানুষ তো আমার গান শুনছেন, এর বাইরে অন্যদেরও গান শোনাতে চাই। মূলত সেই জায়গা থেকে মুম্বাই যাওয়া।
এছাড়া মুম্বাই যাওয়ার বালখিল্য একটি কারণও ছিল। আমি এ আর রহমানের অনেক ভক্ত। খুব করে চেয়েছিলাম এ আর রহমান ও অমিত ত্রিবেদীর জন্য গান গাইব।
বলছিলেন স্বামীর চাকরিসূত্রে তামিলনাড়ু থাকছেন। অথচ আপনার ক্যারিয়ার বাংলায়। সমন্বয় করেন কীভাবে?
এখন আপনার সঙ্গে আমি কলকাতা বসেই কথা বলছি। স্টেজ-শোয়ের সিজন চলছে। তাই গেল ডিসেম্বর থেকে আমি এখানে আছি। মূলত, একমাস তামিলনাড়ু থাকি তো আরেকমাস কলকাতায়। এভাবেই সমন্বয় করি।
তামিলনাড়ুতে নাকি নিজের কাজ নিজে করতে হয় আপনাকে! গায়িকা লগ্নজিতা কেমন রাঁধুনী?
(কিছুক্ষণ ভেবে) আমি ভালো রান্না করি। কিন্তু আমার থেকে আমার বর ভালো রান্না করেন। বন্ধের দিন তিনি নিজেই রান্না করে খাওয়ান। সপ্তাহের অন্যদিনগুলোতে আমি রান্না করি।
গানের বাইরে লগ্নজিতা কেমন মানুষ?
রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। খুব অল্পতে রেগে যাই। খানিকটা অলস প্রকৃতিরও। এগুলো আমার খারাপ দিক। ভালো দিকও আছে। আমি বেশ দয়ালু। সৎ থাকার চেষ্টা করি। কমিটমেন্ট ঠিক রাখি।
বাংলাদেশে কোনো পছন্দের শিল্পী আছে আপনার?
অর্ণব, কৌশিক হোসেন তাপস আমার পছন্দের শিল্পী। জেমস, আইয়ুব বাচ্চু তো আছেনই। এছাড়া বাংলাদেশের ইনডিপেনডেন্ট সিঙ্গারদের গানও আমি শুনি। শুধু টুংটাং গিটার বাজিয়ে কী সুন্দর গান করেন তারা! খুব ভালো লাগে তাদের গান।
আরএসও