রেজওয়ান সিদ্দিকী অর্ণ
১৫ আগস্ট ২০২২, ০৯:১৯ এএম
আপাদমস্তক দেশপ্রেমিক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে পাকিস্তান হটাও আন্দোলন— সবকিছুতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। তার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাঙালি পেয়েছে একটি স্বাধীন দেশ। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন।
বঙ্গবন্ধু শুধু রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনার মধ্যেই সমীবন্ধ থাকতেন না। তিনি একজন সংস্কৃতিমনা মানুষ ছিলেন। শত ব্যস্ততার মাঝে সময় বের করে গান শুনতেন। সিনেমাও দেখতেন। তাকে নিয়ে লেখা বিভিন্ন বই ও স্মৃতিচারণে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
চলচ্চিত্র ছিল বঙ্গবন্ধু আগ্রহের একটি জায়গা। তার একান্ত প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি)।
বঙ্গবন্ধু ১৯৫৭ সালের মার্চের ২৭ তারিখ পূর্ব-পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে ‘পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা’ বিলটি উত্থাপন করেন। একই বছরের ৩ এপ্রিল ওই বিলটি কিছু সংশোধনী আনার পর বিনা বাধায় আইন পরিষদে পাস হয়। আইনটি কার্যকর হয় ১৯ জুন। সেই থেকে যাত্রা শুরু করে ‘পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা’। দেশ স্বাধীনের পর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা (বিএফডিসি)।
চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াত মনে করেন, বঙ্গবন্ধু না থাকলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ভিত্তিভূমি তৈরি হতো না। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় চলচ্চিত্র শিল্প বিকশিত হতে থাকে।
অনুপম হায়াত ঢাকা মেইলকে বলেন, “রাশিয়ান কমিউনিস্ট বিপ্লবী লেনিন চলচ্চিত্রের গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুও ঠিক তেমন চলচ্চিত্রের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরেছিলেন। তার হাত ধরেই বিএফডিসি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ওই সময়ে খুব ভালো ভালো ছবির কাজ শুরু হয়েছিল। ‘আসিয়া’, ‘এ দেশ তোমার আমার’ ও ‘জাগো হুয়া সাভেরা’র মতো ছবি নির্মিত হয়েছে। তখন স্থপতি নাজির আহমেদ পরিকল্পনা দিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু সেগুলোর বাস্তবায়ন করেছেন। নাজির আহমেদ বলেছিলেন, কলকাতার ‘পথের পাঁচালি’র মতো না হোক, কাছাকাছি মানের ছবি নির্মাণ করতে। তারপর নির্মিত হয় ‘আসিয়া’ সিনেমাটি। এই ছবির কাহিনি ও সংলাপ নাজির আহমেদের।’
অনুপম হায়াত জানান, বঙ্গবন্ধু বিএফডিসি প্রতিষ্ঠা করলেও তাকে কখনও সেখানে নিয়ে যাননি কোনো চলচ্চিত্র পরিচালক। তিনি বলেন, ‘চলচ্চিত্রের অনেকে বড় বড় কথা বলেন, অথচ বঙ্গবন্ধুকে তারা কোনোদিন বিএফডিসিতে নেননি। শুধু তাই নয়, ১৯৮৫ সালে স্যুভেনিয়র বের করলেও সেখানে বঙ্গবন্ধুর নাম জায়গা পায়নি। অথচ তখন আওয়ামী লীগ সমর্থিত মানুষ ছিলেন। এটা তাদের ব্যর্থতা।’
বঙ্গবন্ধু সবসময় সোনার বাংলার মতো সিনেমা নির্মাণের কথা বলতেন। তিনি চাইতেন সিনেমায় যেন সোনার বাংলা মনোরম চিত্র উঠে আসুক— এমনটাই জানালেন চলচ্চিত্রের এই গবেষক।
ব্যস্ততার মাঝেও বঙ্গবন্ধু ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ ও ‘রূপবান’ সিনেমা দুটি দেখেছেন। এমনকি নবাব সিরাজউদ্দৌলার চরিত্রে অভিনয় করা আনোয়ার হোসেনের অভিনয়ে মুগ্ধ হয়েছেন।
অনুপম হায়াত ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চলচ্চিত্রের প্রতিনিধ দল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তখন তিনি আনোয়ার হোসেনকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, আসেন আসেন বাংলার নবাব। আমি আপনার ছবি দেখেছি। এ থেকে বোঝা যায়, তিনি ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ সিনেমাটি দেখেছেন।’
তিনি জানান, ১৯৪৬ সালের ‘মানে না মানা’ সিনেমার ‘হবে হবে জয়’ গানটি তিনি প্রায়ই গাইতেন। তবে সিনেমাটি তিনি দেখেছিলেন কি না— সেটা জানা যায়নি।
অনুপত হায়াত বলেন, ‘আবদুল গাফফার চৌধুরী, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, এবিএম মূসা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তখন তারা দেখেন, ঘরোয়া পরিবেশে পা তুলে বঙ্গবন্ধু এই গানটি গাইছেন।’
এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ‘রূপবান’ সিনেমাটি দেখেছেন চলচ্চিত্র প্রদর্শক ও পরিবেশক সমিতির জেষ্ঠ্য নেতা মিয়া আলাউদ্দিন। তিনি বলেন, “গুলিস্তানে ‘নাজ’ সিনেমা হলে বঙ্গবন্ধু, কাজী গোলাম মোস্তফা, সুলতান মাহমুদ, আলতাফ আহমেদ ও বাদশা মিয়া ‘রূপবান’ সিনেমাটি দেখতে গিয়েছিলেন। আমি কাকতালীয়ভাবে সিনেমা হলে উপস্থিত হই। তখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা। তার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম। বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেছিলেন, ‘লেখাপড়া রেখে সিনেমা দেখতে আইছোস’! তখন আমি বললাম, ‘লিডার, শুধু ‘রূপবান’ বলে দেখতে আসছি’।”
মিয়া আলাউদ্দিন জানান, চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসা থাকার কারণে ‘বঙ্গবন্ধু’ হওয়ার আগে শেখ মুজিবুর রহমান বিএফডিসি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
চলচ্চিত্রের মানুষদের উৎসাহ দিতে বঙ্গবন্ধু নিজেই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। ছোট একটি দৃশ্যে অভিনয় করলেও সেটির তাৎপর্য ছিল অত্যাধিক।
প্রয়াত চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ‘সংগ্রাম’ সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন তিনি। ছবির চিত্রনাট্যের শেষ দিকে ছিল, মুক্তিযুদ্ধের পর সদ্য স্বাধীন দেশের সামরিক বাহিনী বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্যালুট করছে।
দৃশ্যটি কীভাবে ধারণ করা যায়—সেটা নিয়ে চিন্তায় পড়েছিলেন চাষী নজরুল ইসলাম। একপ্রকার দুঃসাহস নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসেন ছবির নায়ক খসরু। কিন্তু বঙ্গবন্ধু প্রথমে রাজি হননি। পরে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মান্নানকে দিয়ে সুপারিশ করিয়ে অভিনয়ের জন্য তাকে রাজি করানো হয়। ১৯৭৪ সালে সিনেমাটি মুক্তি পায়।
আরএসও