মো: ইনামুল হোসেন
০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০২:০৮ পিএম
লালন সংগীতশিল্পী ফরিদা পারভীনের কণ্ঠ আর গাজী আবদুল হাকিমের বাঁশির সুর মিলে যেন তৈরি হয়েছিল নতুন এক বাদ্যযন্ত্র। যা শ্রোতাদের নিয়ে যেত অন্য ভুবনে। করে রাখত বুঁদ। আজ তা স্তব্ধ। স্ত্রীকে হারিয়ে গাজী হাকিমও যেন ডানা ভাঙা পাখি। হারানোর বেদনা বুকে পুষেই আছেন দায়িত্বে অটল। আগলে রেখেছেন ফরিদা পারভীনের আজীবনের স্বপ্ন, ‘অচিন পাখি একাডেমি’। ঢাকা মেইলের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায়, অশ্রুসিক্ত চোখে তিনি জানিয়েছেন, ফরিদা পারভীনের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখার তাগিদেই চলছেন পথ।
ফরিদা পারভীনের প্রয়াণের পর কেমন আছেন?
কঠিন প্রশ্ন। এক কথায় উত্তর দিতে পারব না। আছি, আল্লাহ্ পাক যেভাবে রেখেছেন।
তাঁর শূন্যতা অনুভব করেন?
শূন্যতা অনুভব করি না। আমি বিশ্বাসও করি না উনি চলে গেছেন। সারাক্ষণ আমার কাছেই আছেন। আমার ভেতরে। ‘অচিন পাখি’র প্রত্যেকটা ইট, কাঠ, জানালা, ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে তিনি বেঁচে আছেন।

দীর্ঘ পথচলায় এমন কোনো স্মৃতি আছে যা এই মুহূর্তে বিশেষভাবে মনে পড়ছে?
হাজার-লাখ-কোটি স্মৃতি রয়েছে। তিনি একজন আদর্শ মানুষ, আদর্শ স্ত্রী, আদর্শ মা, আদর্শ কন্যা, আদর্শ শিক্ষক এবং আদর্শ শিল্পী। ফরিদা এককভাবে কারও স্ত্রী-মা-বোন। আবার কারও কাছে বড় শিল্পী। তবে এগুলো ছাপিয়ে লালন ফকিরের গানকে একটা অঞ্চল থেকে বের করে তিনি নাগরিক সমাজে, উচ্চবিত্তের ড্রয়িং রুমে পৌঁছে দিয়েছেন। বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছেন। বাংলা ভাষাভাষীদের বাইরেও লালন ফকিরের কথা বিশ্বের সবাই বুঝতে পারছেন। তা না হলে আজকে এমনিতেই কী লালন ফকিরকে ইউনেস্কো জরিপে শ্রেষ্ঠ ভাব-সংগীতের শিরোমণি বলা হচ্ছে? লালনের বাণী সেই জায়গায় নিয়ে গেল কে? ফরিদা পারভীন ও গাজী আব্দুল হাকীম। বাঁশির সুর সবাই বুঝতে পারে। এটা সার্বজনীন। সংগীতের ভাষা বুঝতে কষ্ট হলেও যন্ত্রের ভাষা বুঝতে কষ্ট অসুবিধা হয় না। যন্ত্রের শব্দ শুনে সবাই বুঝতে পারে কোনটা সুখের, কোনটা দুঃখের। সুরের জন্য ফরিদার যে ত্যাগ তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। শুধু লালন সংগীত না, নজরুলসংগীত, লোকগীতি, আধুনিক গানও গেয়েছেন তিনি। তাঁর প্রতিটি গান মাইলফলক হয়ে রয়েছে। দেশের সুধী সমাজ থেকে শুরু করে বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী তা মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করেছেন।

ফরিদা পারভীনের মৃত্যুর পর বলেছিলেন ‘আপনার বাঁশির সুর হয়তো আর বাঁচবে না’। এখন বাঁশিতে সুর তুলতে পারছেন?
এখন দুইয়ের মধ্যে এক হয়ে গেছে। আগে ফরিদা পারভীন আর বাঁশি মিলেমিশে একাকার হতো। তিনি এখন বাঁশির সুরের মধ্যে চলে এসেছেন। দুইজন একজনের মধ্যে চলে এসেছে। এটা অনন্য সাধারণ একটা ব্যাপার। একবার ভেবেছিলাম হয়তোবা বাঁশি আর বাজবে না। আজ (শনিবার) দুই মাস ষোলো দিন হলো ফরিদা পারভীন আমাদের মাঝে নেই। এই কয়েক দিন কয়েক যুগের মতো মনে হচ্ছে। তাঁর মতো শিল্পী যুগে যুগে তৈরি হয় না। শতবর্ষে একবার এমন শিল্পীর জন্ম হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের অনেকে কণ্ঠশিল্পী এবং যন্ত্রশিল্পীর যুগলবন্দী তৈরির চেষ্টা করেছেন। বিশ্বের কোথাও কেউ এমন যুগলবন্দী গড়ে তুলতে পারেননি। একবার আমেরিকার ডেট্রয়েটে একটা প্রোগ্রামে গিয়েছিলাম। সেখানে পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘গাজীদা (গাজী আবদুল হাকিম) এবং দিদি (ফরিদা পারভীন) দুইজনে আলাদা একটা পৃথিবী তৈরি করেছেন। যেখানে আমরা কেউ প্রবেশ করতে পারব না।’ ওই অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন ওস্তাদ আমজাদ আলী খান, বিক্রম ঘোষ, ওস্তাদ রশিদ খান। প্রোগ্রামের পর তাঁরা বলেছিলেন, ‘এটা কখনও রেওয়াজ করে হবে না। ওনারা আলাদা একটি পৃথিবী তৈরি করে ফেলেছেন, যে পৃথিবীতে আমাদের প্রবেশের অধিকার নেই’। ফরিদা পারভীন যখন ২০০৮ সালে জাপানের ফুকুওকা অ্যাওয়ার্ড পান সেবার আমাদের রাজকীয়ভাবে অতিথি হিসেবে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার মনে আছে রাজা বলেছিলেন, ‘গানের ভাষা বোঝার দরকার নেই, ওনার বাঁশির সুর ধান ক্ষেতের কথা বলছে।’ অ্যাওয়ার্ড প্রদানের সময় রাজা বলেন, ‘একটা অ্যাওয়ার্ড কেন, অ্যাওয়ার্ড হবে দুইটা।’ সব জায়গায় আমাদের যে অবস্থানটা ছিল সে অবস্থান থেকে আমরা এখন একক হয়ে গেছি। এটা আমার জন্য অনেক কষ্টের ব্যাপার। ফরিদা পারভীনের মৃত্যুত পর ওনার কিছু ভক্ত আছেন, তাঁরা আমাকে শুধু একটা কথা বলেছেন, ‘বাঁশি আপনাকে বাজাতেই হবে’।

ফরিদা পারভীনের শেষ ইচ্ছা কী ছিল?
তাঁর একটাই ইচ্ছা— অচিন পাখি একাডেমি যেন কোনোভাবেই বন্ধ না হয়।
অচিন পাখি একাডেমি এখন কীভাবে চলছে?
প্রতিষ্ঠানের অবস্থা খুব নাজুক। আগে দুইজনের উপার্জনে চলত। এখন সেটা হচ্ছে না। প্রায় প্রতি মাসে ৫৫-৬০ হাজার টাকা ঘটতি আছে। ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে ৫৪-৫৫ হাজার টাকা ওঠে। ফ্ল্যাট ভাড়া, সার্ভিস চার্জ, তবলা, গান, গিটার, আর্ট, বাঁশির শিক্ষকদের বেতনসহ অন্যান্য খরচ-ই ওঠে না। গত মাসেও নিজের গাঁট থেকে টাকা দেওয়া লেগেছে। এ মাসেও দিতে হবে।

এভাবে কত দিন চালু রাখা সম্ভব হবে?
জানি না কত দিন চালু রাখা সম্ভব হবে। আমি সরকার এবং দেশের বহু বিত্তবান মানুষদের বলেছি অচিন পাখি চালু রাখতে পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। নাহলে এটা বন্ধ হয়ে যাবে। আর অচিন পাখি সংগীত একাডেমী বন্ধ হলেই সুর মরে যাবে। সুর মরে গেলে অসুরের জন্ম হবে। অসুর অশুভ শক্তির লক্ষণ। সুর আর অসুর একসাথে চলতে পারে না। যদি ছোট ছোট কোমলমতি বাচ্চাদের সুর না শেখান, তারা সু-সন্তান হিসেবে গড়ে উঠবে না। আদর্শ মানুষ তৈরি হবে না। কোমলমতি শিশু বাচ্চাদের ভেতরে যদি সুর জ্ঞান থাকে সে অসুর হবে না। কখনও অশুভ কাজ করতে পারবে না। মানুষকে আঘাত করতে পারবে না। কেননা সুর কখনও মানুষকে আঘাত করে না। দুনিয়ায় যত মারামারি হয়েছে— কোনো শিল্পী মারামারি-কাটাকাটি করেছেন? শিল্পীরা মারামারি-কাটাকাটি করে না।

নতুন প্রজন্মের কাছে ফরিদা পারভীন কীভাবে বেঁচে থাকবেন বলে মনে হয় আপনার?
লালন শাহ আর ফরিদা পারভীন একে অপরের পরিপূরক। লালন যদি বেঁচে থাকে, ফরিদা পারভীন বেঁচে থাকবেন। তিনি যদি না বাঁচেন তাহলে লালন বিকৃত হতে থাকবে। কাজী নজরুল ইসলামের গান একসময় বিকৃত হয়েছে কিন্তু শত বছর পর এসে আবার সঠিক সুরে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। লালনকে যতই অত্যাধুনিকতার ভেতর দিয়ে নিয়ে যেতে চান লালন তার স্বকীয়তা নিজেই রক্ষা করবে। এটা নিয়ে ভাবনার কিছু নেই, কারণ সে তার নিজস্ব গতিতে চলবে। যতই কিবোর্ডের ভেতর দিয়ে বাঁশি বাজান, বাঁশি তার নিজস্ব গতিতে চলছে। তেমনি সুর তার নিজস্ব গতিতে চলবে। এটা আমি বিশ্বাস করি। সুতরাং ফরিদা পারভীনকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে অচিন পাখি সংগীত একাডেমী বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তার যে ধারাটি বিশ্বময় সেই ধারাটিকে বাদ দিয়ে নতুন ধারা আনার চেষ্টা করলে সেটা জনগণ গ্রহণ করবে না।

ব্যক্তি ফরিদা পারভীন কেমন ছিলেন?
কোভিড মহামারির সময় আমরা দুইজন করোনা আক্রান্ত ছিলাম। করোনার পর উনি এক বছরের বেশি সময় ধরে লোকজন খাইয়েছেন। এখানে একটা এতিমখানা আছে। উনি এতিমখানার বাচ্চাদের খুব দেখাশোনা করতেন। গান গেয়ে যা ইনকাম করতেন, তার সিংহভাগ চলে যেত মানবসেবায়। অচিন পাখির বাচ্চাদের খাওয়াতেন, তাঁদের খুব আদর করতেন। এছাড়া লালনের আখড়া থেকে যারাই আসতেন, আম্মা বললে আর কোনো কথা নেই। তাঁদেরকে উনি সেভাবে দেখতেন। দুই হাত ভরে দিতেন। সম্রাজ্ঞী সম্রাজ্ঞীর মতন ছিলেন।

চিকিৎসার ক্ষেত্রে সরকার ফরিদা পারভীনের জন্য যতটুকু করেছে তাতে আপনি সন্তুষ্ট?
সরকার সর্বোচ্চ করেছে। প্রচুর সাহায্য-সহযোগিতার চেষ্টা করেছে। ফরিদা পারভীনকে সুস্থ করার জন্য মেডিকেল বোর্ড বসাতে বলেছিলাম। তাঁরা মেডিকেল বোর্ড বসিয়েছেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার কথা বলেছিলাম। কিন্তু অবস্থা এত তাড়াতাড়ি খারাপ হবে কেউ ভাবেনি। ওনাকে দীর্ঘদিন ভারতের ডাক্তার মণ্ডলকে দেখানো হতো। কিন্তু হঠাৎ করে এরকম হয়ে গেল! এটা আমার জন্য খুব কষ্টের। সরকারকে আমি কোনো দোষ দেব না। কেননা তাঁরা তো চেষ্টা করেছে এবং শেষ পর্যন্ত আমাকে বলেছিল, আপনি যেখানে কবরস্থ করতে চান সেখানে সমাধিস্থ করা হবে। আমি বলেছিলাম বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করলে এখানকার মানুষ সবাই দেখতে যেতে পারত। সেখানে হয়তো একটু সমস্যা ছিল। তাঁর সন্তানরা চেয়েছিল ফরিদা পারভীনকে মা-বাবার কবরে দাফন করা হোক। তাঁদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে কুষ্টিয়ায় দাফনের ব্যবস্থা করি। আমি বলেছিলাম সর্বস্তরের জনগণের শ্রদ্ধার জন্য লালন-সম্রাজ্ঞীর মরদেহ শহীদ মিনারে নেওয়া হোক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে তাঁর জানাজা হোক। সেটা হয়েছিল। যেটা যেটা বলেছিলাম সব হয়েছে। শুধু একটাই হয়নি, ঢাকায় কবরস্থ করতে পারিনি। আক্ষেপ রয়ে গেল। আজ দুই মাস ষোলো দিন হয়ে গেছে আমি তাঁর কবরটা দেখতে যেতে পারিনি। সবদিকে সামলাব না ওদিকে যাব? ঢাকায় থাকলে সবসময় আমার ছাত্ররা যেতে পারত, আমিও দেখতে যেতে পারতাম। যেকোনো কারণে হয়তো হয়নি। এটা আমারই ব্যর্থতা। তাঁর কোনো ব্যর্থতা নেই।
ইএইচ/