images

বিনোদন

দেরিতে ঘুম থেকে উঠতাম যেন একবেলা খেয়ে দিন কাটাতে পারি: জাহিদ নিরব

রাফিউজ্জামান রাফি

১৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:৪৮ পিএম

ক্যারিয়ারে বসন্ত পার করছেন জাহিদ নিরব। গায়ক, যন্ত্রশিল্পী, সুরকার ও সংগীত পরিচালক হিসেবে মেতে আছেন সৃষ্টিসুখের উল্লাসে। সম্প্রতি এই সুরের জাদুকর মুখোমুখি হয়েছিলেন ঢাকা মেইলের। 

ব্যস্ততা কী নিয়ে? 

ব্যান্ড ছাড়ার পর ভাবিনি লাইভ মিউজিক আমাকে এত টানবে। ভেবেছিলাম চিরকুট নেই মানে আমার স্টেজ নেই। আব্বা গান শেখাতেন। ছোটবেলায় তার প্রক্সি ক্লাস করতাম। গান শেখানোর প্রতি আগ্রহ তখন থেকেই। মিউজিক এডুকেশন সিস্টেম নিয়ে কাজ করতে চাওয়া, গানের স্কুল ডট কম নামের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে চাওয়া মূলত ওই ভাবনার-ই ফল। ঘটনাক্রমে এখন আবার লাইভ মিউজিকের ব্যস্ততা শুরু হয়েছে। উপভোগ করছি। পাশাপাশি বিজ্ঞাপনের ব্যস্ততা আছে। বড় বাজেটের একটি সিনেমার কাজ করছি। আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা হয়নি বলে বিস্তারিত জানাতে পারছি না। ওটিটি কনটেন্টের দুটি গান ও বিজিএম বানাচ্ছি। ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’ নিয়ে প্রতি মাসে ব্যস্ততা থাকে। এটি একসঙ্গে আট পর্ব করে রিলিজ হয়। অর্থাৎ ১৬০ মিনিট। ১৬০ মিনিটের মিউজিক করা মানে বিশাল ব্যস্ততা। পাশাপাশি ইনডিপেনডেন্ট আর্টিস্টদের নিয়ে কাজ করতে চাচ্ছি। যারা গান লেখেন, সুর করেন, ভালো গান আছে কিন্তু প্রকাশের সুযোগ নেই। তাদের নিয়ে কাজের আগ্রহ আছে। নিজেকে দিয়ে শুরু করেছি। বন্ধুদেরও কিছু কাজ করছি। 

IMG_7309

ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরে প্রশংসা কুড়াচ্ছেন। সংগীত পরিচালনা ও বিজিএম তৈরিতে পার্থক্যগুলো কীরকম?

যদি মজা করে বলি— মাঠ ফাঁকা তাই সুনাম আছে। এ মাঠে হাতেগোনা ৫-৬ জন মিউজিক করেন। টেকনিক্যালি বললে, ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর যত না মিউজিকের তারচেয়ে মোটা দাগে সিনেমার অংশ। আমি সব সময় একটি উদাহরণ দেই— সত্যজিত রায়ের একটা ট্র্যাক আছে মহানগরের যে ট্র্যাকটা। সেটা শুনে আমার খুব অস্বস্তি হয়েছে। উনি কীভাবে পাখোয়াজটা বেসুরা রেখে দিলেন! এ নিয়ে আশফাক নিপুন ভাইয়ের সাথে আড্ডাও হয়েছে। উনি বলেছেন, এই যে তোমার ভেতর যে অস্বস্তি তৈরি হচ্ছে, সেটি তৈরির জন্যই হয়তো এটা এভাবে রাখা। ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের ক্ষেত্রে মিউজিক্যালি পারফেক্ট হওয়ার চেয়ে ইমোশন বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। কিছু ক্ষেত্রে মিউজিক্যালি পারফেক্ট হয় না কেওয়াজ তৈরি করতে হয়, তালের বাইরে যেতে হয়, সুর-তালের উর্ধ্বে উঠে ইমোশন, স্টোরি টেলিং বুঝতে হয়। এটাই মিউজিক স্কোরের মোদ্দা কথা। গান বানানোর ক্ষেত্রে আচার্য জয়ন্ত বোসের একটি কথা বলতে পারি— ‘আর্টিস্টরা কখনও নিজেকে ঠকায় না। তার মনের কথা শোনে’। ইনডিপেনডেন্ট আর্টিস্টরা গান বানায় আত্মতৃপ্তির জন্য। আমি জানি না ফকির লালন কারও জন্য গান লিখেছেন কি না। আমার মনে হয় তিনি নিজেকে চেনাজানার উপলব্ধি থেকে গান লিখেছেন। আর্টিস্টের অন্যকে তৃপ্ত করার কিছু নেই। তার সঙ্গে যারা নিজেকে যুক্ত করবেন তারা আপনা-আপনিই তৃপ্ত হবেন। 

 

আপনাকে এ সময়ের জনপ্রিয় সংগীত পরিচালক বলা হয়। নিজের এই সফলতাকে কীভাবে দেখেন? 

আমার মনে হয় বাংলাদেশের বড় বড় শিল্পীদের মধ্যেও নিজেকে সেলিব্রেটি ভাবার ব্যাপার বা গড়িমা কাজ করে না। এটা শিল্পীদের কম থাকে। দেখবেন অনেক বড় আর্টিস্ট পাড়ায় বা রাস্তায় গাইতে দেখে বসে যান। ব্যক্তিগতভাবে অনুভব করি আমরা মিউজিশিয়ানরা সেলিব্রেটি কোটায় পড়ি না। প্রি-সেলিব্রেটি বলা যায়। সেলিব্রেটিদের সাথে চলি (হা হা হা)। হয়তো দুই একজন আছেন যারা খুব বিখ্যাত। কিন্তু আমি নিজেকে সেলিব্রেটি মনে করি না। 

IMG_4046

ফ্রান্স সফরের অভিজ্ঞতা জানতে চাই… 

এটা আমার জীবনের সবচেয়ে সম্মানিত সফর। ইউনেস্কোর হেডকোয়ার্টারে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সবচেয়ে বড় স্টেজ, সব দেশের কূটনীতিকরা ছিলেন। তাদের সামনে বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করা আমার কাছে অনেক বড় ব্যাপার। আমাদের পরিকল্পনা ছিল ২০ মিনিটের ট্র্যাক বানিয়ে নিয়ে যাব। প্লাস ওয়ান রেকর্ডিং যেটাকে বলে। কিন্তু পরে জানতে পারলাম লাইভ বাজাতে হবে। আমার সঙ্গে থাকবেন মিঠুনদা (মিঠুন চক্র) জালাল (বাঁশি বাদক জালাল) ভাই। ওনারা বাংলাদেশের সেরা মিউজিশিয়ান। আমার বিশ্বাস পৃথিবীর টপ লিস্টেও থাকবেন। তাদের সাথে স্টেজ শেয়ার করা সৌভাগ্যের। তাছাড়া টুনটুন ফকিরের মতো বাউল, তরুণ সংগীতশিল্পী পারসা মেহজাবিন পূর্ণি, র‍্যাপার সেজান, শূন্য ব্যান্ডের এমিল (ইমরুল করিম এমিল) ভাই, এফ মাইনর ব্যান্ডের পিংকি (পিংকি চিরান) আপু, ইসলাম উদ্দিন পালাকার— সব আর্টিস্টকে ২০ মিনিটের মধ্যে এক ট্র্যাকে আনতে আমাকে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ভাই সাহায্য করেছেন। সব মিলিয়ে ফ্রান্স সফর জীবনের বড় অভিজ্ঞতাগুলোর একটি।  

 

ফ্রান্সের সঙ্গে বাংলাদেশের শিল্প সংস্কৃতির কীভাবে তুলনা করবেন? 

মিউজিক বা আর্ট কম্পিটিশন না কম্পোজিশনের ব্যাপার। আগে মনে হতো কথা-সুর পারফেক্ট হতে হবে। এখন মনে হয় অনুভূতিটা গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনে করি মিউজিক হলো অভিব্যক্তি প্রকাশের উপায়। যেটা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না সেটা মিউজিকে প্রকাশ সম্ভব। তা করতে গিয়ে সুর-তালের বেড়াজাল নাও থাকতে পারে। এতে অনেকে হয়তো বেসুরো বলবেন। আমি বলব না। আমি মনে করি যেটা আমার সুর সেটার অন্যের সুর নাও হতে পারে। এই সুর-তাল-লয় তো আমাদের-ই বানানো। সেখানে কোনো এক্সপ্রেশন এক্সপ্রেস করতে গিয়ে পাঁচ মাত্রার জায়গা সাড়ে পাঁচ মাত্রা হতেই পারে। সমস্যা দেখি না। প্যারিসকে পুরো একটা শুটিং সেট মনে হয়েছে। সেখানে সবাই একটা ক্যারেক্টারের মধ্যে আছে। শিল্প-সংস্কৃতিটা ওইভাবে অনুভব করা যায়। মনে হয় এখানেই হয়তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হেঁটে গেছেন। কেননা পৃথিবীর সবাই তো সেখানে গেছেন। সব মিলিয়ে একটি ভিন্ন অনুভূতি কাজ করে। 

 

আপনার বাবার গান রেকর্ড করেছেন। কীভাবে ভাবনাটি এলো? 

একটা সময় অন্যের স্টুডিওতে কাজ করেছি। ফরমায়েশি কাজ করছি৷ ক্রাইসিসের সময় বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানোর চিন্তা থাকে। নিজের জন্য কাজের পরিকল্পনা কম থাকে। এখন স্টুডিও হয়েছে। নিজের কাজগুলো করছি। তখন মনে হলো আব্বার রেকর্ড করা কোনো গান নেই। ছোটবেলায় ওনার অনেক গান রেডিওতে শুনতাম। সেগুলো রেকর্ড করা জরুরী। আমার স্টুডিও আছে আমার আব্বার গান করব না এটা কেমন দেখায়! ওই চিন্তা থেকেই শুরু। আব্বার বয়স হয়েছে। পাশাপাশি উনি রেকর্ডিংয়ে অভ্যস্ত নন। ওনারা রেকর্ড করছেন সবাই মিলে। আমাদের লাইভ রুম হয়ে গেছে। চাইলে সবাই মিলে রেকর্ড করতে পারব। 

IMG_6152

অনুভূতিটা কেমন? 

অনুভূতিটা খুবই ভয়ানক। কারণ অন্য আর্টিস্টদের অনেকক্ষণ চাপ দিতে পারি। আব্বাকে তো পারব না। তাছাড়া মাইক্রোফোন-হেডফোন ছাড়া উনি যে ডেলিভারি করেন মাইক্রোফোনের সামনে সেটা পারছেন না। শিল্পী হিসেবে তার একটা হতাশার জায়গা। প্রতিবন্ধকতাগুলো টেকনিক্যাল জায়গা থেকে দেখি। 

 

দেশের আনাচ কানাচে থাকা মেধাবী শিল্পীদের নিয়ে কাজের কোনো পরিকল্পনা আছে? 

আমরা সাইলেন্স অব সাউন্ড থেকে মিউজিশিয়ানদের ইনস্ট্রুমেন্টাল বানাব। যেমন আমাদের বাঁশি বাদক জালাল ভাই সারাজীব বাজিয়েছেন। কিন্তু ওনার নিজের ট্র্যাক নাই। কামরুল ভাইয়েরা তিন ভাই। তাদেরও ইনস্ট্রুমেন্টাল বানাতে চাই। নরসিংদীতে মানজুমা নামে তৃতীয় লিঙ্গের এক গায়ক আছেন। দারুণ ফোক গান করেন। আমার দুইজন লোক আছেন যাদের কাজ সারাক্ষণ ফেসবুক ঘেটে এরকম মেধা খুঁজে বের করা। আমাদের যেহেতু নাটক-সিনেমায় কাজে লাগানোর সুযোগ আছে সেহেতু নতুন কণ্ঠ কাজে লাগানোর চেষ্টা করি। আপাতত দুটি ভাবনা। ফোক শিল্পীদের নিয়ে একটি প্রজেক্ট করা। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মেধাবীদের তুলে এনে কাজে লাগানো। 

 

চিরকুট কেন ত্যাগ করলেন— জাতি এখনও জানতে যায়। 

চিরকুট আমাদের অনেককে প্ল্যাটফর্ম দিয়েছে। চিরকুটের প্রথম গিটারিস্ট মেঘদলের শোয়েব ভাই। পারভেজ ভাই ছিলেন ভোকাল। শারমিন সুলতানা সুমি আপু মেধাবীদের খুঁজে আনতে পারেন। আগামী পাঁচ বছর পর একটি ছেলে কোথায় যাবে উনি দেখতে পান। এভাবেই ইমন ভাই, পাভেল ভাইকে এনেছেন। আমাকে নিয়েছেন পাভেল ভাই। আবার ইমন ভাই দিদার ভাইকে এনেছেন। চিরকুট ছিল একটা স্কুলের মতো। সবাই এসেছে। চিরকুট থেকে শিখেছে। কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে তো মানুষ সারা জীবন থাকে না তবে বহন করে। চিরকুটও আমাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে আমারা এসেছি, শিখেছি। এরপর গন্তব্য বদলেছে। বের হয়ে কাজ করছি। এর বাইরে কোনো কারণ নেই। তবে মানুষ চায় নেতিবাচক কিছু খুঁজতে। তাদের প্রশ্ন, সবাই এত ভালোভাবে কেন বের হচ্ছে? নিশ্চয়ই কোনো কিন্তু আছে। কিন্তুটা নেই। তাছাড়া পরিবারের মধ্যে কিন্তু থাকলেও সেটা প্রকাশের কিছু নেই। 

 

চিরকুটের নতুন অ্যালবাম ‘ভালোবাসাসমগ্র’ শুনেছেন? 

হ্যাঁ, সবগুলো গান শুনেছি। ‘দামি’ গানটি বেশি ভালো লেগেছে। এরমধ্যে অনেকগুলো গান আমি থাকাকালীন বানানো। 

IMG_6552

নাটক, ওটিটি, সিনেমা— কোন জায়গায় বেশি আরাম বোধ করেন? 

কখন যে আর্টিস্টের আরামবোধ চলে আসবে সে নিজেও জানে না। যেমন আজ (গেল মঙ্গলবার) আমি খুব ব্যস্ত। এরমধ্যে মনে হলো একটা গানে চেলো বাজাব। আপনি আসতে আসতে বাজাচ্ছিলাম। চেলোর প্রতি আগ্রহ দেখে সাউন্ড ডিজাইনার বলছিল, ডেমোতে এত এফোর্ট কেন দিচ্ছেন। এই ফিলিংটা কখন কার যে কোন প্রজেক্টে চলে আসবে শিল্পী নিজেও জানে না। তবে নিজের গান বানানোর ক্ষেত্রে ইমোশন ফুটিয়ে তোলা যায়। তখন সেটা একটু বেশিই ভালো লাগে। 

 

চর্চা চলে, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাজগুলোতে আপনিসহ মুষ্টিমেয় কয়েকজনকে দেখা যায়। এ নিয়ে আপনার মন্তব্য কী? 

আমরা এখন ন্যাশনাল টিমে খেলছি। সরকার যেই আসুক গান তো আমরাই গাইবো। এটা অন্যভাবে দেখার কিছু নেই। ইউনেস্কোর উদাহরণ দিচ্ছি, সেখানে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ভাই আগে প্রীতম হাসান ভাইকে চেয়েছিলেন। প্রীতম ভাই ওই সময় ব্যস্ত ছিলেন। ইমন ভাইয়েরও (ইমন চৌধুরী) সময় ছিল না। আমি ছিলাম তৃতীয় পছন্দ। তার মানে, মুষ্টিমেয় কয়েকজন থাকার কথাটা ভুল। যারা কাজ করছেন মোটামুটি সবাইকে ডাকা হয়। 


অনেকে মনে করেন গান ভাইরাসের মতো। ভালো গান যেভাবেই হোক ছড়িয়ে পড়ে। আবার অনেককে বলতে শোনা যায়, ভালো গানগুলো সস্তা গানের দাপটে চাপা পড়ে যাচ্ছে। আপনি কী মনে করেন? 

আমি এতে বিশ্বাসী না। তবে মার্কেটিংয়ের ভাষায়— টুডেজ ক্লাস, টুমোরোজ ম্যাচ। আজ যেটা পাঁচজন শুনবে আগামীকাল সেটা ৫০০ জন শুনবে। আজ যেটা ৫০০ মানুষ শুনবে আগামীকাল কেউ শুনবে না। পেছনে তাকালে দেখবেন এটাই হয়ে আসছে। যেমন অর্ণব ভাইয়ের (শায়ান চৌধুরী অর্ণব) গান একসময় হাতে গোনা কয়েকজন শুনতেন। এখন সবাই শোনেন। তাছাড়া আমি মনে করি ভালো খারাপ শব্দগুলো গানের অভিধানে নেই। আপনার ইমোশন আপনি প্রকাশ করছেন। সেখানে আমি খারাপ বলার কেউ না। আপনার গান এক শ জন শুনছে। সেখানে আমার অনিরাপদ বোধ করার কারণ নেই। মান্না দের গান এক কোটি মানুষ শুনবে না, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লিরিক এক কোটি মানুষ বুঝবে না এটাই স্বাভাবিক। রবীন্দ্রনাথের গানও এক কোটি মানুষ শুনবে না। কারণ তার গানের অর্থ সবাই বুঝবে না। আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথও ভাবেননি যে তার গান সবার শুনতে হবে।

IMG_7326

অনেকে ম্যাশাপ নিতে পারেন না। আপনি কোন পক্ষে? 

একেক সময় একেক ট্রেন্ড আসে। এক সময় আমার মনে হতো মিউজিক মানেই মেহেদী হাসান, গুলাম আলী। মিউজিক মানেই কথা-সুর পারফেক্ট হতে হবে। এখন প্রশ্ন জাগে, ওনাদেরটাই শুধু যদি মিউজিক হয় তাহলে লিওনার্ড কোহেন, বব ডিলানদেরটা কি মিউজিক না? অবশ্যই মিউজিক। বব ডিলানের অনেক ট্র্যাকে দেখবেন গিটারটা একটু ডিসটউন আছে। মান্না দের ‘ওগো বর্ষা তুমি ঝরো না গো অমন জোরে’ গানে উনি ধরাতে একটু গ্যাপ দিয়ে তাল ছাড়া ধরেছেন। উনি এভাবে ওনার মিউজিক প্রকাশ করতে চেয়েছেন। তবে লিরিক্যালি প্রতিটি গানের একটি ভাবমূর্তি থাকে। ওই জায়গা থেকে ম্যাশাপের আইডিয়াটা ভুল। কিন্তু বিনোদনের দিক থেকে ভাবলে ঠিক আছে। 

 

দেশ-বিদেশের কোন শিল্পীরা সবসময় আপনার সঙ্গে থাকেন?

গান গাওয়ার ক্ষেত্রে আমি যেখানে থেমে যাই তিনি মেহেদী হাসান। মেহেদী হাসান শুনলে আর কিছু শুনতে ইচ্ছা করে না। সুরের ক্ষেত্রে সলিল চৌধুরী, আলাউদ্দিন আলী, মান্না দে খুব ভালো লাগে। গান লেখার ক্ষেত্রে সুমি আপা (শারমিন সুলতানা সুমি), আমার বন্ধু রায়হান ইসলাম শুভ্র আমাকে ভাবায়। গিটার বাজানোর দিক থেকে ইমন ভাই (ইমন চৌধুরী) আমাকে অনুপ্রেরণা দেন। কম্পোজিশনে হাবিব ওয়াহিদ, এ আর রহমান অনুপ্রাণিত করেন। দেশ-বিদেশের অনেকের গান শুনি। বিভিন্নভাবে তারা আমাকে ইন্সপায়ার করে। ব্যক্তিত্বের দিক থেকে ভালো লাগে বাব ডিলানকে। যিনি নোবেল ফিরিয়ে দিয়েছেন। 

 

স্ট্রাগলের কথা শুনতে চাই। 

আগে স্ট্রাগলের কথা বলতাম না। এখন বলতে চাই। এতে দশ জন হলেও উপলব্ধি করতে পারবেন এক সময় আমি এই ক্রাইসিসগুলো পার করেছি। একটু হলেও তারা অনুপ্রাণিত হবেন। ২০২১ সালে প্রথম গাড়ি কেনার পর একটি ইমোশনাল পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটি দেখে দিব্য (চিরকুটের বর্তমান গিটারিস্ট) আমাকে বলছিল আমার পোস্টটি তাকে নতুন করে মিউজিকে উৎসাহ দিয়েছে। তখন উপলব্ধি করলাম স্ট্রাগলের কথা লিখতে হবে। আমি শখে মিউজিক করতে আসিনি। পরিবারকে সাপোর্ট দিতে মিউজিকে এসেছিলাম। সংকট থেকে সম্ভবনা তৈরি হয়। সেটাই হয়েছে। মানুষের জীবনে ক্রাইসিস একেক সময় একেক রূপে আসে। তখন হয়তো থাকা-খাওয়ার চিন্তা করতে হতো। এখন মিউজিক নিয়ে নিজের উন্নতি নিয়ে ভাবতে হয়। যখন ঢাকায় আসি তখন কিবোর্ড ছিল না। কেনারও সামর্থ্য ছিল না। আমি যে ব্যান্ডে বাজাতাম তাদের একটা কিবোর্ড ছিল। সেটা নিয়ে শো করতে যেতাম। ভাড়ায়ও নিতাম। ৩০০ টাকায় ভাড়া পাওয়া যেত। স্ট্রাগলিং পিরিয়ড সবার জীবনে যায়। মগবাজারে যখন থাকতাম তখন দেরি করে ঘুম থেকে উঠতাম যেন একবেলা খেয়ে দিন শেষ করতে পারি। যদিও এটা খুব কম সময় হয়েছে। ওই সংকট ছিল বলেই হয়তো বেশি চর্চা করেছি। শোয়ের পর স্টুডিওর কাজ শেখার আগ্রহ ছিল। 

IMG_4045

কখনও মনে হয়নি অন্য পেশা বেছে নিলে ভালো হতো? 

সুযোগই ছিল না। কারণ স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে স্টেজে উঠেছি। তাছাড়া আমাদের হিসাব নিকাশ সৃষ্টিকর্তার সাথে মেলে না। আমরা এক যোগ এক দুই চিন্তা করি। সৃষ্টিকর্তা এক যোগ একে এগারো বানিয়ে দেন। ক্রাইসিস মোমেন্টে চিন্তা করতাম একটা শো করলে দুই হাজার টাকা পাই। মাসে পনেরোটা শো করলে তিরিশ হাজার টাকা পাব। এরমধ্যে যদি ১৮ হাজার টাকা বাসা ভাড়া চলে যায় তাহলে খাব কী থাকব কোথায়। কিন্তু এমনও হয়েছে এক শো করে এক লাখ টাকা পেয়েছি। এই হিসাব মেলাতে পারিনি তখন। এটা স্রষ্টাপ্রদত্ত ব্যাপার। আমি বলব হিসাব নিকাশ মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা ভালো। সততার সাথে নিজের কাজটা করে যেতে হবে। হয়তো আপনি ভাবছেন সরাসরি ফল পাবেন। তা না হলেও পরোক্ষভাবে পাওয়া যাবে।

 

সংগীত পরিচালক হিসেবে কোন কণ্ঠশিল্পীকে মাইক্রোফোনের পেছনে দেখার ক্ষুধা আছে? 

অরিজিৎ সিংকে। আমার মনে হয় ভারতের জন্য তিনি আশীর্বাদ। তাকে নিয়ে ইচ্ছামতো এক্সপেরিমেন্ট করতে পারবেন। অন্য আর্টিস্টকে নিয়ে পারবেন না। আমার মনে হয় বাংলাদেশের সব কম্পোজারের এই ক্ষুধা আছে। 

 

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? 

ভবিষ্যৎ নিয়ে একদম চিন্তা করি না। জীবন থেকে শিক্ষা নিয়েছি। ভবিষ্যতের জন্য যা চেয়েছি তার বেশি কিছু পেয়েছি । মান্না দের একটি গান আছে, ‘চেয়েছি অনেক কিছু পেয়েছি অনেক বেশি’। মোনাজাতে বলি আল্লাহ আপনি যেটা ভালো মনে করেন সেটাই করেন। উনি যেটা দেন সেটাই ভালো। সেজন্য ওই বিশ্বাসে আমি বিশ্বাসী। শুধু কাজের সাথে থাকতে হবে। বর্তমানকে গুরুত্ব দিতে হবে। 

IMG_1280

সুরকার, মিউজিশিয়ান, কণ্ঠশিল্পী— নিজেকে কোনটায় বেশি খুঁজে পান? 

এভাবে কখনও ভাবিনি। নির্দিষ্ট করে বলতেও পারব না। তবে আমার স্বস্তির জায়গা হচ্ছে হারমোনিয়াম বাজানো। যেহেতু হারমোনিয়ামটা বেশি চর্চা করেছি। তাই ওখানে আমার কমফোর্ট জোন। গত মাসে মুন্সীগঞ্জে নিজের এলাকায় আমাকে সংবর্ধনা দিয়েছে। আমার উচিত ছিল সেখানে নিজের ব্যান্ড নিয়ে যাওয়া। কিন্তু আমি কামরুল ভাই, পল্লব দাকে নিয়ে গিয়েছিলাম। মান্না দে, নজরুল সংগীত গেয়েছি। ওটাই আমার কমফোর্টজোন।

আরআর