images

বিনোদন

কানে জাফর পানাহির ‘স্বর্ণপাম’ ঘিরে প্রশংসা ও রাজনৈতিক আলোড়ন

আলমগীর কবির

২৫ মে ২০২৫, ১০:৫০ পিএম

ইরানি ভিন্নমতাবলম্বী চলচ্চিত্র নির্মাতা জাফর পানাহি কান চলচ্চিত্র উৎসবের ৭৮তম আসরে তাঁর চলচ্চিত্র ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট–এর জন্য স্বর্ণপাম (পাম দ’র) পুরস্কার লাভ করেছেন। তাঁর এই অর্জন বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হয়েছে।

ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট চলচ্চিত্রটি ইরানি সিনেমার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতীকি বিজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে এই পুরস্কার ইরানের সরকারপন্থি গণমাধ্যম থেকে তীব্র সমালোচনাও আহরণ করেছে।

পানাহি, যিনি একসময় রাজনৈতিক বন্দী ছিলেন এবং এক দশকের বেশি সময় ধরে ভ্রমণ ও চলচ্চিত্র নির্মাণে নিষেধাজ্ঞার মুখে ছিলেন, ২৪ মে পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে থাকা অভ্যর্থনা লাভ করেন।

অস্কারজয়ী অভিনেত্রী কেট ব্ল্যাঞ্চেট শনিবার রাতে স্বর্ণপাম পুরস্কারটি পানাহির হাতে তুলে দেন। তাঁর পুরস্কার গ্রহণ ভাষণে পানাহি ঐক্যের বার্তা দেন এবং দেশ-বিদেশের ইরানিদের ‘ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সম্মিলিতভাবে গণতন্ত্র, মর্যাদা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করার আহ্বান জানান।

আরও পড়ুন—

তিনি বলেন, ‘আমাদের কী পরবে, কী করব, কিংবা কী চলচ্চিত্র বানাব—এসব কেউ আমাদের বলে দিতে পারবে না।’ তাঁর এ বক্তব্যে হলভর্তি দর্শক বারবার করতালিতে ফেটে পড়েন।

ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাঁ-নোয়েল বারো এই মুহূর্তটিকে ‘দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীকী কাজ’ হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি এক্স-এ লেখেন, ‘জাফর পানাহির স্বর্ণপাম বিশ্বজুড়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য নতুন আশার সঞ্চার করেছে।’

একটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মুহূর্ত
এই বিজয় ইরানি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বহু প্রভাবশালী ব্যক্তির আবেগঘন প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।

ইরানে কারাবন্দী নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী নারগেস মোহাম্মদি লেখেন, ‘জাফর পানাহি এক সাহসী ও বিশিষ্ট নির্মাতা,’ যাঁর স্বীকৃতি বহু বছরের নিরলস মানবিক ও নাগরিক মূল্যবোধ তুলে ধরার শিল্পচর্চার ফল।

ইরানের সাবেক রাজপরিবারের উত্তরাধিকারী প্রিন্স রেজা পাহলভি পানাহিকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, এই পুরস্কার ইরানের জন্য ‘এক মহান সম্মান।’ তিনি আশা প্রকাশ করেন, একদিন ইরানি নির্মাতারা নিজেদের দেশে ‘নির্বিচারে বা নিষেধাজ্ঞা ছাড়াই কাজ করতে পারবেন।

মানবাধিকার কর্মী হামেদ এসমাইলিয়ন পানাহিকে ‘এক সত্যিকারের নায়ক’ বলে অভিহিত করেন এবং বলেন, “নির্যাতন ও সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে তাঁর দৃঢ়তা আমাদের সবাইকে অনুপ্রাণিত করে।’

কারাবন্দী রাজবন্দী মেহদি মাহমুদিয়ান, তেহরানের এভিন কারাগার থেকে বলেন, ‘এই পুরস্কার শুধু একটি চলচ্চিত্র সম্মান নয়, বরং এটি সত্যের বিজয়।’

ইরানি-ব্রিটিশ অভিনেত্রী নাজানিন বোনিয়াদি পানাহির ভাষণকে প্রশংসা করে বলেন, তিনি এমন এক সময় ‘ঐক্য ও দৃষ্টিভঙ্গির খোঁজ করা’ ইরানিদের জন্য ‘একীভূত কণ্ঠস্বর।’

১৩৫ জন বেসরকারি, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী এক যৌথ বিবৃতিতে পানাহিকে শিল্পীসত্তা ও মানবাধিকার চর্চার প্রতীক হিসেবে অভিহিত করেন।

তাঁদের মতে, পানাহি এখন মাইকেলাঞ্জেলো আন্তোনিওনি এবং রবার্ট আল্টম্যানের মত কিংবদন্তিদের কাতারে এসে দাঁড়ালেন—যাঁরা বার্লিনের গোল্ডেন বিয়ার, ভেনিসের গোল্ডেন লায়ন এবং এখন কান-এর স্বর্ণপাম জয় করেছেন।

আরও পড়ুন—

ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট, একটি রাজনৈতিক থ্রিলার, ইরানে গোপনে এবং সরকারি অনুমোদন ছাড়াই চিত্রায়িত হয়েছে, যেখানে বাধ্যতামূলক হিজাব আইনকেও অমান্য করা হয়েছে।

চলচ্চিত্রটির নির্মাণ প্রক্রিয়া এবং সেন্সরশিপ আইন অমান্য করে পানাহির প্রকাশ্য অবস্থান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র মহল ও মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর কাছ থেকে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে।

কান উৎসবের জুরি পানাহিকে উৎসবের নাগরিকত্ব পুরস্কারও প্রদান করেছে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ।

ক্রমবর্ধমান সংখ্যক ইরানি নির্মাতা এখন দেশটির কঠোর আদর্শগত সেন্সরশিপকে উপেক্ষা করে বিদেশে প্রদর্শনের জন্য সরকারি অনুমোদন ছাড়াই চলচ্চিত্র বানাচ্ছেন।

গত বছর খ্যাতনামা ইরানি নির্মাতা আসগর ফারহাদি ঘোষণা করেন, তিনি যতদিন না ইরানে হিজাববিহীন নারীদের দেখানোতে নিষেধাজ্ঞা ওঠানো হচ্ছে, ততদিন দেশে কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন না।

আরও পড়ুন—

cannes-2

তেহরানে সরকারপন্থী ক্ষোভ
অন্যদিকে, ইরানের সরকারি ও সরকারপন্থী সংবাদমাধ্যমে এই পুরস্কার নিয়ে নীরবতা বা রোষ দেখা গেছে।

রক্ষণশীল দৈনিক ফারহিখতেগান, যা ইসলামিক আজাদ বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা পরিচালিত, হেডলাইন দেয়: ‘স্বর্ণপাম (পাম দ’র) মরিচা ধরল।’

সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ইউরোপীয় চলচ্চিত্র উৎসবগুলো ‘ওরিয়েন্টালিস্ট পক্ষপাত’ দেখাচ্ছে এবং পানাহির স্বীকৃতি মূলত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, শিল্পগুণ নয়।

স্টুডেন্ট নিউজ এজেন্সি (এসএনএন) পানাহিকে ‘মধ্যস্বত্বভোগী’ ও ‘ইরান-বিক্রেতা’ বলে আখ্যা দেয়। তারা এই অনুষ্ঠানের নাম দেয় ‘রাজনৈতিক নাটক,’ যা ‘পিআর মার্কেটারদের’ দ্বারা পরিকল্পিত।

তবে সমালোচনার মাঝেও পানাহির বিজয় বিশ্বব্যাপী ইরানিদের মধ্যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, শিল্পী প্রতিরোধ এবং জাতীয় ঐক্য নিয়ে নতুন করে আলোচনা সৃষ্টি করেছে।

কান-এর মঞ্চ ছেড়ে যাওয়ার সময় পানাহি একটি সহজ কিন্তু হৃদয়স্পর্শী আশাবাদ ব্যক্ত করেন—‘আমি এমন একটি ইরানের স্বপ্ন দেখি, যেখানে শিল্পীদের কণ্ঠরোধ করা হয় না, যেখানে সত্যের কোনো সীমানা নেই, এবং যেখানে একটি গল্প বলার জন্য কেউ ভয় পায় না।’

//