রাফিউজ্জামান রাফি
১৭ মার্চ ২০২৫, ০৩:৫০ পিএম
শ্রাবণের মেঘগুলো জড়ো হলো আকাশে, অঝোরে নামবে বুঝি শ্রাবণে ঝড়ায়ে, আজ কেন মন উদাসী হয়ে, দূর অজানায় চায় হারাতে— প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অক্সিজেন সরবরাহ করছে গানটি। শহরের ইট-কাঠ ছাড়িয়ে গ্রামের ধানী জমির আলে কান পাতলেও শোনা যায় সে সুর। কখনও কি জানতে ইচ্ছা করে না দেশের ব্যান্ড সংগীতে ইতিহাস সৃষ্টিকারী এই গানের সৃষ্টির কথা? সে গল্প জানতে যোগাযোগ করা হয় গানটির গীতিকার-সুরকার আশরাফ বাবুর সঙ্গে। শুরুতেই বাবুর অভিযোগ গানটি সৃষ্টির গল্প বিকৃত করা হচ্ছে। এরপর ঢাকা মেইলকে আশরাফ বাবু শোনালেন ‘শ্রাবণের মেঘগুলো জড়ো হলো আকাশে’ সৃষ্টির আসল গল্প।
গল্পটি রচিত হয়েছিল খুলনা শহরে। এই চিত্রনাট্যের প্রধান দুই চরিত্রের নাম বাবু। একজন গানটির স্রষ্টা আশরাফ বাবু, অন্যজন গায়ক আলী আহমেদ বাবু। কলেজ ছাত্র আশরাফ বাবু তখন নতুন নতুন গান লিখছেন, সুর করছেন। আলী আহমেদ বাবু কয়েকজন বন্ধু নিয়ে ‘রিপল ট্র্যাক’ নামে একটি ব্যন্ড করেছেন যেটিকে পরে ‘ডিফরেন্ট টাচ’ নাম দেওয়া হয়।
আশরাফ বাবু বলেন, ‘আলী আহমেদ বাবু আমার এক বছরের সিনিয়র ছিলেন। দুজনেই আজম খান সরকারি কমার্স কলেজে পড়তাম। সে সময় তিনি রিপল ট্র্যাক ব্যান্ডের গিটারিস্ট ও ভোকাল। এই ব্যান্ড থেকেই ডিফরেন্ট টাচ অ্যালবাম বের করা হয়। যাই হোক আমি একদিন প্র্যাকটিস প্যাডে যাই। ওই ব্যান্ডের গায়ক হিসেবে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করি। সেদিন বাবু সেখানে ছিলেন না। বাকি যে সদস্যরা ছিলেন তারা জানালেন তাদের তিনজন গায়ক আছেন। নতুন করে কাউকে নেওয়ার সুযোগ নেই।’
বাবু যোগ করেন, ‘‘এরপর আলী আহমেদ বাবুর সঙ্গে দেখা হলে তিনি আমাকে বললেন, তুমি তো গান লেখ ও সুর করো। আমাকে গান দিও। আমরা ব্যান্ড থেকে অ্যালবাম করতে যাচ্ছি। তিনজন গায়ক। একেক জন চারটা করে গান করব। এরপর আমার গানের খাতা থেকে তিনি তিনটি গান পছন্দ করেন। পরে অ্যালবাম করার সময় আরেকটি গান দরকার হয়। আমাকে তাড়া দেন বাবু। ওই সময় এক সন্ধ্যায় গানগুলো তুলে দিতে আমি তার বাসায় যাই। তার বাসা থেকে আমার বাসার দূরত্ব ছিল আধঘণ্টার। টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছিল। সে ইলশেগুড়ি মাখা সন্ধ্যায় পথ চলতে চলতে আমার মাথায় ‘শ্রাবণের মেঘগুলো জড়ো হলো আকাশে’ গানের কথাগুলো আসে। পরে বাবুর বাসায় গিয়ে গানটি খাতায় তুলি। এরপর চারটি গান ক্যাসেটে তুলে দিয়ে আসি। পরে তারা প্র্যাকটিস করে এবং ঢাকায় গিয়ে গানগুলো রেকর্ড করে।’’
একটি গানের ক্ষেত্রে অবহেলা বা অভিমানের বেশিরভাগই বরাদ্দ থাকে গীতিকারের ভাগ্যে। এ যেন চিরায়িত রীতি। আশরাফ বাবুর সঙ্গেও এরকম হয়েছে। ‘শ্রাবণের মেঘগুলো জড়ো হলো আকাশে’ গানটি লিখে দেওয়ার পর তার কোনো খোঁজ নেননি রিপল ট্র্যাক থেকে ডিফরেন্ট টাচ নামধারী ব্যান্ডের সদস্যরা। নিজের গানগুলো প্রকাশের খবরও জানতেন না বাবু। একদিন এক পরিচিতের থেকে জানতে পারেন ডিফরেন্ট টাচের নামে প্রকাশিত অ্যালবামে তার গানগুলো আছে।
দোকানে গিয়ে ফিতার সে ক্যাসেট খুলেই বৈষম্য চোখে পড়ে বাবুর। অন্যদের নাম সম্পূর্ণ লেখা হলেও তার নামটি ছিল সংক্ষেপে। ব্যাখ্যা চাইলে জায়গা সংকটের অজুহাত দেওয়া হয়। যদিও সে যুক্তি সেসময় যৌক্তিক মনে হয়নি বাবুর কাছে।
১৯৮৯ সালে প্রকাশ পায় ‘শ্রাবণের মেঘগুলো জড়ো হলো আকাশে’। কোনো পারিশ্রমিক পাননি বাবু। উল্টো ব্যান্ডের ম্যানেজার তার কাছে গানের খরচ বাবদ অর্থ দাবি করেছিলেন। বাবুর ভাষ্য, ‘সে সময় তাদের ব্যান্ডের ম্যানেজার আমার কাছে টাকা দাবি করেছিল। বলেছিলেন তোমার গানটি করতে অনেক টাকা পয়সা খরচ হয়েছে। তুমি দিও। তবে বিষয়টি ব্যান্ডের অন্য সদস্যরা জানতেন না। এই হচ্ছে গানটি সৃষ্টির আসল ইতিহাস। কিন্তু আজকাল গানটির পেছনের গল্প বিকৃত করা হচ্ছে। এটা খুব উদ্বেগজনক। ’
আশরাফ বাবু বলেন, ‘‘শ্রাবণের মেঘগুলো জড়ো হলো আকাশে’ ছাড়াও ডিফরেন্ট টাচ অ্যালবামে আমার লেখা ও সুর করা আরও তিনটি গান ছিল। সেগুলো হলো ‘দৃষ্টি প্রদীপ’, ‘স্বর্ণলতা’ ও ‘রাজনীতি’। এরমধ্যে ‘শ্রাবণের মেঘ’ ও ‘স্বর্ণলতা’ গেয়েছিলেন আলী আহমেদ বাবু। ‘দৃষ্টি প্রদীপ’ কণ্ঠে তোলেন মেজবাহ রহমান। ‘রাজনীতি’ গানটি ব্যান্ডের সকলে সম্মিলিত কণ্ঠে গেয়েছিলেন। পরে মনমালিন্যের জেরে ব্যান্ড আলী আহমেদ বাবু ব্যান্ড ত্যাগের পর থেকে ‘শ্রাবণের মেঘ’-এ কণ্ঠ দেন মেজবাহ।’’
বলে রাখা ভালো, ‘শ্রাবণের মেঘগুলো জড়ো হলো আকাশে’ গানটি সবার জন্য উন্মুক্তকরে দিয়েছেন আশরাফ বাবু। নতুন প্রজন্ম যেন স্বাচ্ছন্দ্যে গাইতে পারে সে কথা বিবেচনা করে বাঁধেননি কপিরাইটে। সম্প্রতি গানটির জন্য টেলিভিশন রিপোর্টার্স ইউনিটি অব বাংলাদেশ (ট্রাব) কর্তৃক সম্মাননা প্রদান করা হয় তাকে।