রেজওয়ান সিদ্দিকী অর্ণ
০৩ জুলাই ২০২৩, ০২:৪৪ পিএম
পাকিস্তানে আয়োজিত ‘মিস পাকিস্তান ইউনিভার্সাল-২০২৩’ সুন্দরী প্রতিযোগিতায় সেরার মুকুট জয় করেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কপোতাক্ষী চঞ্চলা ধারা। পৈত্রিকসূত্রে তিনি ঝিনাইদহের কোর্টচাঁদপুরের মেয়ে। মায়ের বাড়ি যশোরে। পেশায় চিকিৎসক কপোতাক্ষীর জন্ম বেড়ে ওঠা সবই পাকিস্তানে হলেও তিনি বাংলাদেশকে মনেপ্রাণে ধারণ করেন। সময় সুযোগ পেলেই বাংলাদেশে আসেন। আত্মীয়স্বজনের সাথে সময় কাটিয়ে ফিরে যান।
ঢাকা মেইল কথা বলেছে পাকিস্তান জয় করা বাঙালি কন্যার সঙ্গে। সেই কথোপকথনে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে মনের আগল খুলেছেন তিনি।
অভিনন্দন জানানোর জন্য ধন্যবাদ। আমি শুরুতে ভাবিনি ‘মিস পাকিস্তান ইউনিভার্সাল’ জয়ী হব। ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন ধরনের এক্সট্রা কারিকুলাম একটিভিটিসের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। যখনই চেষ্টা করেছি তখনই সফল হয়েছি। সেটা সুইমিং হোক কিংবা ক্রিকেট। সেই আত্মবিশ্বাস থেকে সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের ইচ্ছা জাগে। গত বছর আমি এই প্রতিযোগিতায় আবেদন করি। যদিও তখন আমি ভাবিনি যে, প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হব। আমি জাস্ট অংশগ্রহণ করেছি। প্রতিযোগিতায় যা যা স্টেপ ছিল, সবগুলো আমাকে বলা হয়েছে। সেগুলো সঠিকভাবে পূর্ণ করেছি। সৃষ্টিকর্তা যা করেন ভালোর জন্যই করেন। আমি শুধু চেষ্টা করে গেছি। ফলাফল আপনাদের চোখের সামনে।
পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া একদম সহজ ছিল না। আমার ডিউটি টাইম অনেক বেশি থাকে। বেশিরভাগ সময় আমি হাসপাতালে কাটাই। ঘরে অনেক কম থাকি। কিন্তু আমি সবসময় বিশ্বাস করি, যখন কোনো বিষয়ের দিকে আগ্রহ থাকে, ওই জিনিসটা করতে চান তখন ব্যস্ততার মাঝেই সেটার জন্য সময় বের করা যায়। প্যাশনের কাছে সময় বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।
পাকিস্তান প্যাজেন্ট ওয়ার্ল্ড মূলত ভার্চুয়ালি করা হয়। শুধু গ্র্যান্ড ফিনালেতে সশীরের ডাকা হয়। সেখানেই বাকি প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করা হয়। গত বছর আমি পাকিস্তান ওয়ার্ল্ড ডটকম ওয়েবসাইটের মাধ্যমে এই প্রতিযোগিতায় নিবন্ধন করি। সেখানে থাকা ক্রাইটেরিয়া আমার মধ্যে ছিল। বয়স, হাইট, শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে ফরম পূরণ করতে হয়েছে। কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। তারপর ফটোশুটের পোর্টফোলিও দিতে হয়। যেহেতু আমি কোনো প্রফেশনাল মডেল নই, সেহেতু সেরকম পোর্টফোলিও ছিল না। সাধারণ মোবাইল দিয়ে তোলা ছবিগুলো পাঠাই। কিন্তু আয়োজক কর্তৃপক্ষ আমার কাছে ই-মেইলের মাধ্যমে প্রফেশনাল পোর্টফোলিও সাবমিট করতে বলে। তারপর আমরা এই প্রতিযোগিতার জন্য আমাকে বিবেচনা করা হবে। এরপর করাচি থেকে আমি দুইবার প্রফেশনাল ফটোশুট করিয়েছে। সেই ছবিগুলো পাঠিয়েছি। এবার ছবিগুলো একসেপ্ট করে। আমাকে ফোন করে সেটা জানানো হয়। বলা হয়, একটা ভার্চুয়াল সাক্ষাৎকারও নেওয়া হবে। অনলাইনে আমি তাদের প্রশ্নের উত্তর দিই। কিছুদিন পরে জানানো হয়, এই স্টেজটায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছি। তারপর জানায়, আমার ছবিগুলো তারা আন্তর্জাতিক পেজেন্টগুলোতে সেন্ড করবে।
ছবিগুলো সেসব জায়গায় পাঠানো হয়। পরে একদিন আমাকে জানানো হয় আমি ফাইনালিস্ট। এ জন্য একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অ্যামাউন্ট ফি হিসেবে দিতে হবে। আমি সেটা দিই। এরপর ক্রাউনিংয়ের আগে আমিসহ অন্য প্রতিযোগীদের ডাকা হয়। প্রশ্ন দেওয়া হয়। প্রায় তিন শ’ প্রশ্ন ছিল, যা আমাকে উত্তর দিতে হয়েছে। আমাদের হাইট, পারসোনালিটি, শিক্ষাগত যোগ্যতা, একস্ট্রা কারিকুলাম একটিভিটিস, আইকিউসহ নানা বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হয়েছে। তারপর চূড়ান্ত পর্বের আগের দিন আমাকে জানানো হয়, আমি ‘মিস পাকিস্তান ইউনিভার্সাল-২০২৩’ বিজয়ী হয়েছি। গ্র্যান্ড ফিনালেতে আমার কাছে দুটি প্রশ্ন করা হয়। তারপর আমাকে ক্রাউন, স্যাশ আর শিল্ড দেওয়া হয়। সাথে গিফট হ্যাম্পার।
এই পেজেন্টের প্রেসিডেন্ট সোনিয়া আহমেদ শুরু থেকেই জানতেন, আমার ব্যাকগ্রাউন্ড বাঙালি। তবে এটা নিয়ে তার কোনো সমস্যা ছিল না। রেজিস্ট্রেশন ফরমে আমার সম্পর্কে বিস্তারিত ছিল। সবাই জানতেন এটা। এ ধরনের প্রতিযোগিতায় শ্রেণি কিংবা বর্ণ বৈষম্য করা হয় না। এখানে মানবতাই মুখ্য বিষয়। তবে হ্যাঁ, প্রতিযোগী পাকিস্তানি কি না— সেটা দেখা হয়। আমি তো জন্মগতভাবে পাকিস্তানি। আমার পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট সবই তো পাকিস্তানি।
এখানে বিশেষভাবে মূল্যায়নের কিছু নেই। অন্যদের যেভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে, আমিও সেভাবে মূল্যায়ন পেয়েছি। তবে আমি যখন বিজয়ী হই তখন আমাকে আমার নামের বিষয়ে কথা বলতে হয়। তখন আমি বলি, এটা বাঙালি নাম। এটা নিয়ে কেউ নেতিবাচক ভাবেনি। বরং ইতিবাচকভাবে নিয়েছেন। আমার মতো একজন অন্য সংস্কৃতির মেয়ে পাকিস্তানকে ভিন্নভাবে তুলে ধরবে ভেবে সবাই আমাকে বাহবা দিয়েছেন।
আমি পাকিস্তানে জন্মেছি। কিন্তু আমার বাবা-মা বাংলাদেশি। তাই আমার কালচার বাংলা। জিনিসটা এভাবে ভাবি যে, আমি একসাথে দুটি দেশকে গর্বিত করতে পারছি। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় হয়ত পাকিস্তানের হয়েই যাব, কিন্তু এর মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষও গৌরব করবেন। ভারতেও কিন্তু বাঙালি আছে। সুতরাং আমি সারা বিশ্বের বাঙালিদের গর্বিত করতে চাই।
এরপর ইন্টারন্যাশনাল পেজেন্টে গিয়ে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করব। এ মাসে আমি শ্রীলংকা যাচ্ছি ‘মিস পাকিস্তান ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম’ প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে। সেখানে আমি পাকিস্তানের পর্যটন শিল্পকে তুলে ধরব। এ ছাড়া আরও তিন-চারটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেব। সেভাবেই নিজেকে প্রস্তুত করছি।
এই পেজেন্টগুলোতে আমরা চ্যারিটি নিয়ে কাজ করি। অবশ্যই সেটা পাকিস্তানের ভালোর জন্য। আমি যদি পাকিস্তানের অর্থনীতির জন্য কিছু দিতে- করতে পারি, বিশেষ করে ট্যুরিজম নিয়ে; তাহলে আমার জন্য সেটা আনন্দের হবে। যেহেতু আমি ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজমে যাচ্ছি। যদি সারা বিশ্বে পাকিস্তানের ট্যুরিজমকে তুলে ধরতে পারি, তাহলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করব। আমি মানবাধিকার নিয়েও কাজ করতে চাই। নারীদের নিয়ে কাজ করতে চাই।
এ ছাড়া আমি পেশায় চিকিৎসক, তাই অসহায় মানুষদের ফ্রি চিকিৎসা দিতে চাই। সুযোগ পেলে তাদের জন্য হাসপাতাল তৈরি করতে চাই। সেখানে তাদের ফ্রি চিকিৎসা হবে।
এখানে বাঙালিরা কিন্তু আটকে নেই। তারা কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তবে শুনতে পাই যাদের ভোটাধিকার নেই, লেখাপড়া জানেন না— তারা সমস্যায় আছেন। এর বাইরে যারা শিক্ষিত বাঙালি আছেন, তাদের সমানভাবে মূল্যায়ন করা হয়। আমি নিজেও বাঙালি হিসেবেও কোথাও সমস্যার সম্মুখিন হইনি।
এখন সবেমাত্র আমি সুন্দরী প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছি। আমার এখন লক্ষ্য, পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরা। তা ছাড়া আমি চিকিৎসক, সেটাতেও ফোকাস রাখতে চাই। তবে যদি কখনও সুযোগ পাই, তাহলে কেন নয়? আমি আমার জীবনে সবগুলো সেক্টরে একটু করে হলেও কাজ করতে চাই। দেখা যাক, সামনে কী হয়!
বাঙালি সংস্কৃতি অনেক সমৃদ্ধ। টেলিভিশনের মাধ্যমে আমি পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি সম্পর্কে জেনেছি। সেকারণে বাঙালি কালচার সম্পর্কে পাকিস্তানের মানুষও জানেন। এখানে অনেক ধরনের কালচারের মানুষ থাকেন। সবাই একে অন্যের কালচারকে শ্রদ্ধা করেন। কেউ যদি আমার কাছে বাঙালি সংস্কৃতি সম্পর্কে কিছু জানতে চান, তাহলে তাকে আমি বুঝিয়ে বলি।
এখন পর্যন্ত সাত থেকে আটবার বাংলাদেশে গিয়েছি। ছোটবেলা থেকেই যাওয়া-আসা করেছি। আগে সহজে যেতাম। এখন পাকিস্তান-বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো না। তাই ভিসা পাওয়া কঠিন। তবে কয়েকমাস আগে বাংলাদেশে গিয়ে আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করে এসেছি।
তেমন কাউকে চিনি না। তবে আমার মনে আছে ছোটবেলায় বাংলাদেশে আমার কাজিনের সাথে হারমোনিয়াম বাজাতাম। তখন সাবিনা ইয়াসমিনের ‘রেললাইনের ওই মেঠো পথটার ধারে দাঁড়িয়ে…’ গানটা গাইতাম। তার গান আমার ভালো লাগে।